উইলসনস রোগ নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতি

২০১৯ সালের আগস্ট মাসে নওগাঁ সদরের এক কৃষিজীবীর (৪৭) পুরো শরীরে চুলকানি শুরু হয়। একপর্যায়ে পেট ফুলে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে জন্ডিসের চিকিৎসা চলে। কিন্তু সুস্থ না হওয়ায় ২৬ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এ দিন চিকিৎসকের পরার্মশে স্বামীর প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য ঢাকায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে এসেছিলেন এক নারী। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল, স্বামী উইলসনস রোগে আক্রান্ত।

উইলসনস ডিজিস জন্মগত রোগ। একশ বছর আগে মার্কিন স্নায়ুচিকিৎসক আলেক্সান্ডার কিনিয়ার উইলসন প্রথমবারের মতো রোগটি সম্পর্কে বিবরণ দেন। কিন্তু রোগটি নির্ণয়ের প্রচলিত পদ্ধতি বেশ জটিল। কপারমুক্ত চার লিটারের বিশেষ পাত্রে রোগীর প্রস্রাবের নমুনা চব্বিশ ঘণ্টা সংরক্ষণ করতে হতো। এই পদ্ধতিকে সহজ করে তুলেছে বাংলাদেশেরই একদল গবেষকের উদ্ভাবন। এখন শুধু সকালবেলার প্রথম প্রসাবের নমুনা (২০ মিলি) থেকেই রোগটি নির্ণয় করা হচ্ছে।

উইলসনস রোগের প্রকাশ হয় লিভার অথবা মস্তিষ্কের প্রদাহের মাধ্যমে। জন্মের পর থেকে ৬০ বছরের যেকোনো বয়সে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। প্রতি ৩০ হাজার মানুষের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি লিভারের প্রদাহ কিংবা লিভার সিরোসিসের কারণ হিসেবে ভাইরাসকে চিহ্নিত করা না গেলে উইলসনস রোগের পরীক্ষা করা হয়। প্রস্রাবে কপারের পরিমাণ নির্ণয়ই এ রোগ শনাক্তের অন্যতম উপায়। রোগটি নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতিটি বের করেছেন পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামশাদ বি কোরাইশীর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী। তাঁদের গবেষণা নিবন্ধটি গত বছর ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিনজার নেচারের বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োলজিক্যাল ট্রেস এলিমেন্ট রিসার্চ–এ ছাপা হয়েছে।

প্রচলিত পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়ে রোগীর চব্বিশ ঘণ্টার প্রস্রাব চার লিটারের কপারমুক্ত পাত্রে সংরক্ষণ করতে হতো। আগে পরীক্ষার ফলাফলের জন্য ৬০ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। নতুন পদ্ধতিতে শুধু সকালের প্রথম প্রস্রাব থেকে ২০ মিলিলিটার পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। ছয় ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়। নমুনা পরীক্ষার খরচও কমে এখন ১০ হাজার টাকা থেকে ৮০০ টাকা হয়েছে।

মানুষ যে খাবার খায়, তার সঙ্গে ধাতব কপারও থাকে। কপার মানবদেহের জন্য একটি প্রয়োজনীয় মৌল। একজন মানুষ দৈনিক ১-২ মিলিগ্রাম কপার খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে শরীরের জন্য প্রয়োজন মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ মিলিগ্রাম কপার। বাকিটা শরীর থেকে বের হয়ে যায়। মানুষের লিভারে এটিপিসেভেনবি নামের একটি জিন থাকে, যা সেরুলোপ্লাজমিন নামের এনজাইম তৈরি করে।

কপার সেরুলোপ্লাজমিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রক্তে ও পিত্তরসের সঙ্গে বের হয়। কিন্তু এটিপিসেভেনবি জিনের মিউটেশনের ফলে সেরুলোপ্লাজমিন উৎপন্নে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে কপার লিভারে জমা হয়। একপর্যায়ে লিভারে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মুক্ত মূলক (ফ্রি-রেডিক্যাল) উৎপন্ন হয়। এতে লিভারের কোষ ভেঙে কপার বের হয়ে আসে। শরীরে কপারের বিপাকক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দেয়। এর ফলে লিভার, মস্তিষ্ক, কিডনি ও চোখে কপার জমতে থাকে। যকৃৎ আক্রান্ত হলে বমি, পা ফুলে যাওয়া, তলপেটে পানি জমা, চুলকানি ও ত্বক হলুদাভ থাকে। মস্তিষ্কে কপার বেড়ে গেলে মাংসপেশিতে জড়তা তৈরি হয়। রোগীর অনেক সময় কথা বলতে সমস্যা হয়, আচরণে পরিবর্তন আসে, বিষণ্নতা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। একপর্যায়ে মৃত্যুও হতে পারে। আগেভাগে রোগ শনাক্ত হলে যকৃৎ কিংবা স্নায়ুজনিত ক্ষতি থেকে রোগী বাঁচতে পারে। কিন্তু রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়।

গবেষকেরা ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৯০৩ জন রোগীর প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করেন।

শামশাদ বি কোরাইশীর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী

গবেষক দলের প্রধান শামশাদ বি কোরাইশী বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, চব্বিশ ঘণ্টার প্রস্রাবে কপারের পরিমাণ সকালের প্রথম প্রস্রাবের ঘনত্বের সমান থাকে। বরং আগে দিনভর প্রস্রাব সংগ্রহ করা হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে কপারের ঘনত্বও কমতে থাকে। তা ছাড়া নমুনা থেকে পাত্রের গায়ে কপার শোষিত হতে পারে। তাই ওই পদ্ধতিতে রোগটি নির্ণয়ে ভুলের মাত্রা বেশি ছিল। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে শুধু সকালবেলার প্রথম প্রস্রাবের নমুনাই যথেষ্ট। এতে প্রায় শতভাগ নির্ভুলভাবে রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব।

দেশে উইলসনস রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাটি হয় শুধু ঢাকায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের রসায়ন বিভাগের অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার এই পরীক্ষা করা হয়। বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার নমুনা এখানে পরীক্ষার জন্য আসে। আক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের ও নিম্ন আয়ের। তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বয়স ২০ বছরের নিচে।

গত ২৮ অক্টোবর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছিলেন এক বাবা। বাড়ি কুমিল্লার তিতাসের একটি গ্রামে। তিনি বলেন, আট বছর বয়সে মেয়ের চোখ হলদেটে দেখা দেয়, খেতে পারত না, বমি করত। প্রথম পর্যায়ে জন্ডিসের চিকিৎসা চলে। কিন্তু তাতে সুস্থ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষার পর উইলসনস রোগ ধরা পড়ে। এখন বছরে তিন-চারবার প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষার পর রোগের মাত্রা দেখে চিকিৎসক ওষুধ দেন। মেয়ে এখন সুস্থ। কিন্তু তাকে আজীবন ওষুধ খেতে হবে।

উইলসনস রোগে বাংলাদেশে ঠিক কত মানুষ আক্রান্ত, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। এ বিষয়ে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষু বিভাগ, লিভার বিভাগ ও পরমাণু শক্তি কেন্দ্র যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছে।

এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বিএসএমএমইউর লিভার (হেপাটোলিজ) বিভাগের চেয়ারম্যান মামুন আল মাহতাব। তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে যকৃতের রোগে আক্রান্ত ৯৪১ জন রোগীকে ২০১৭-১৮ সালে প্রস্রাবে কপারের নমুনা পরীক্ষার জন্য পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ২১২ জনের (২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ) উইলসনস শনাক্ত হয়। এর বাইরে ২৩৯ জনের আশঙ্কা রয়েছে। এসব রোগীর কারও হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের সংক্রমণ ছিল না। তাদের কেউই ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ছিল না। তিনি বলেন, স্বল্প সময়ে, কম খরচে ও রোগীর কষ্ট ছাড়াই রোগটি নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতিটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: সাংবাদিক