বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব?

মৃত্যু চিরন্তন বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। ফলে অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বয়ঃপ্রাপ্তি জীবনের এক অনিবার্য পরিণতি। একেও বর্জন করার কোনো উপায় নেই। তবে বয়ঃপ্রাপ্তি দেহের ওপর, মনের ওপর যে ভিন্ন মাত্রার রেখাপাত সৃষ্টি করে এবং দেহ ও মনকে ক্রমেই নাজুক করে তোলে, একে কি খানিক ঠেকিয়ে রাখা যায় না? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে শুরুতেই জানা দরকার, জীবনকাল ও বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটার প্রক্রিয়াটি কী।

কোনো জীব যত দিন বাঁচে, সেটি হলো সেই জীবের জীবনকাল। মানুষের জীবনকাল হলো একটি জটিল বৈশিষ্ট্য, যার পেছনে কাজ করে বহু ফ্যাক্টর। পারিবারিক ইতিহাস, জীবনাচরণ, রোগশোক এবং বসবাসের পরিবেশ—সবকিছু মিলে মানুষ কত দিন বাঁচবে কিংবা মানুষের জীবনকাল কত দিন হবে, তা নির্ভরশীল। এসব ফ্যাক্টরের পরিবর্তন ঘটলে কোনো একটি জনসমষ্টির গড় জীবনকালেও পরিবর্তন ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর হিসাবটা এখানে নিয়ে আসা যায়। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন সর্বাধিক, যা ৭১ দশমিক ৬ বছর।

এই যে গড় আয়ু বৃদ্ধি ঘটেছে, আমাদের জনগোষ্ঠীর তা ঘটেছে কতিপয় ফ্যাক্টরের পরিবর্তন ঘটার কারণেই। এই সময়কাল আমাদের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন হয়েছে এবং পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস তথা নিরাপদ প্রসব প্রযুক্তির প্রসার ও আমাদের জনগোষ্ঠীর গড় আয়ু বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। গোটা বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। আর তা বাড়ার পেছনে রয়েছে খাওয়ার পানি বিশুদ্ধকরণ ও বোতলজাত পানির ব্যবহার, বর্জ্য পানির শোধন, ব্যাপক টিকাদান কমসূচি এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও এর পরিসীমা বৃদ্ধি। স্বাস্থ্যরক্ষাবিষয়ক পরিবেশের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক জীবনযাপনের নানা উপাদান। যেমন: খাবার, ব্যায়াম এবং আর্থসামাজিক অবস্থার ও জীবনকালের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ নিয়মিত ব্যায়াম করে, যাদের খাদ্যে নিম্ন মাত্রার স্যাচুরেটেড চর্বি থাকে এবং অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেওয়া থেকে যারা বিরত থাকে, তারা বেশি দিন বাঁচে। এই ধরনের জীবনযাপন হৃৎপিণ্ডের রোগ ও ক্যানসার সৃষ্টির ঝুঁকিও হ্রাস করে। তাহলে কি বলা সম্ভব, জীবনকাল আংশিক হলেও জিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত? অর্থাৎ জীবনকালও কি বংশগত একটি বৈশিষ্ট্য?

নানা রকম পর্যবেক্ষণ থেকে এই দুটি প্রশ্নের জবাব আসে হ্যাঁ–বোধকই। বহু পরিবার নিয়ে পরিচালিত গবেষণা থেকে দেখা গেছে, লম্বা সময় বেঁচে থাকা কিছুটা হলেও বংশগত। সে কারণে জেনেটিক বা জিনগত। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া জীবনের ওপর দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বহু রকম পরিবর্তন নিয়ে আসে। মানুষের জীবনে নানা দিক থেকে এসব পরিবর্তন সাধিত হয়। জীবনের প্রথম দুই দশক ধরে, জন্ম থেকে সাবালকত্ব পর্যন্ত, বয়ঃপ্রাপ্তি শারীরিক বৃদ্ধি ঘটায় ও পরিপক্বতা নিয়ে আসে এবং মেধার বিকাশ ঘটায়। এসব পরিবর্তন স্পষ্টভাবেই লক্ষ করা যায় এবং জীবনের বাকি সময়ের তুলনায় এটি ঘটে তুলনামূলকভাবে খানিকটা দ্রুতই। দৈহিক পরিপক্বতা অর্জনের পর মানুষের দেহে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও স্পষ্টতর হতে থাকে।

দীর্ঘ সময় যাদের সূর্যালোকে এবং ঘরের বাইরে কাটাতে হয়, আগেভাগেই তাদের চামড়া শক্ত হতে শুরু করে এবং মুখমণ্ডল ও দেহে ভাঁজ পড়তে দেখা যায়। মানুষের অনুভূতিগুলো যেমন: দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ এবং গন্ধ, দিনে দিনে সূক্ষ্মভাবে তা হারাতে থাকে। দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তনের কারণে অনেক বয়স্ক মানুষের চশমা ব্যবহার করতে হয়। চুল পড়ে যেতে শুরু করে এবং চুলের রং বদলাতে থাকে। কম পরিশ্রম করে যেসব মানুষ, তাদের ওজন বাড়তে থাকে। চল্লিশের কোঠায় পড়লে নারীদের অনেকের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়। এটা তাদের সন্তান ধারণক্ষমতা শেষ হওয়ার লক্ষণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিগোচর হয় তেমন পরিবর্তনগুলো হলো, সময়ের সঙ্গে হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকা (বিশেষ করে মেয়েদের), মানসিক তীক্ষ্ণতা হ্রাস পাওয়া এবং স্মরণশক্তি লোপ পাওয়া।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের নানা রকম রোগশোক দেখা দেয়। মানুষের দেহে যে স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো বয়স্ক মানুষের হৃৎপিণ্ডের রোগ, ক্যানসার, স্নায়বিক রোগ ডেমেনসিয়া (dementia), গেঁটে বাত, অন্ধত্ব এবং শ্রবণসমস্যা দেখা দেয়। জিনগুলো ও পরিবেশগত ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে আন্তক্রিয়ার ফলে বয়স বাড়লে এসব জটিল রোগ দেখা দেয়। উদাহরণ হিসেবে আলঝেইমারস রোগের কথা বলা যায়। এই রোগের ফলে যেখানে রোগীর মগজে পরিবর্তন আসে। ফলে তার ভাবনা ও স্মরণশক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় বয়স বাড়লে যে পরিবর্তন হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হ্রাস পায়। এটি হলো ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষের সবচেয়ে সাধারণ ডেমেনসিয়ার রূপ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরল এলিলসমূহ আলঝেইমারস রোগ সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রাখে। বলা বাহুল্য, সাধারণ অনেক জিনের এলিলসমূহ নানা রকম রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। পরিবেশগত ফ্যাক্টর যেমন বিষাক্ত পদার্থের কারণেও বয়ঃপ্রাপ্তির সময় বেশি প্রভাব দেখা যায়। প্রোগেরিয়া (progeria) নামে বিরল এক রোগ আছে। এর কারণে দেহের টিস্যু স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ দ্রুত বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। এ রকম ক্ষেত্রে ২০ বছরের কম যার বয়স, তাকে দেখতেও অনেক বয়স্ক লাগে।

বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলছেন, রোগ সৃষ্টির পেছনে যেসব জিন রয়েছে তারা নয় বরং কিছু জিনই বয়ঃবৃদ্ধির বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ রকম ধারণা তাঁরা দুই রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে পেয়েছেন। অন্যান্য জীবে পরিচালিত গবেষণা আর কোনো কোনো মানব পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘ জীবনকাল অর্জন করার বিষয় থেকে তাঁরা এ ধারণা করেছেন। ইস্ট এবং গোলকৃমি নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণা দেখা গেছে, ১০টির বেশি জিন দীর্ঘজীবন এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে জড়িত। অতিসম্প্রতি ফল-মাছির ওপর পরিচালিত এক গবেষণা থেকেও একই রকম জিনের অস্তিত্ব জানা গেছে। এদের সঠিক কাজ কী, সেটি এখনো জানা যায়নি। তবে এদের এক বা একাধিক জিন যে বিপাকীয় হার কমিয়ে দেয়, তা বোঝা গেছে। ইঁদুর নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে খাদ্য গ্রহণ কমানো হলে বিপাক হ্রাস পায় আর তাতে বাড়ে জীবনকাল।

মানুষে সরাসরি এ রকম জিনের সন্ধান লাভ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, মানুষের দীর্ঘজীবন লাভের ওপর জিনের যে প্রভাব, তা পরীক্ষামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে দীর্ঘজীবন লাভের ওপর জিনের প্রভাব জানতে হলে নানা রকম ব্যাপক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘজীবন লাভকারী বহু ব্যক্তির ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ করে তাঁদের জীবনাচরণ, চিকিত্সার ইতিহাস এবং শেষ পর্যন্ত বংশগতির কী কী বিষয় তাঁদের সবার একই রকম রয়েছে, তা বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।

শতবর্ষী মানুষের ওপর অনেক পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সেসব পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ৯০ বছরের বেশি জীবনকালের সঙ্গে অনেক জিনের ভিন্নতা রয়েছে। যেমন দেহের প্রতিরক্ষা সিস্টেমের হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (HLA), অ্যাপোলিপোপ্রোটিন E (APOE), অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম (ACE), প্লজমিনোজেন অ্যাকটিভেটিং ইনহিবিটর ও I (PAI-1) এবং P53-এর সম্পর্ক জড়িত। এসব জিনের কিছু রূপ যেমন: APOE, ACE এবং P53 যথাক্রমে আলঝেইমারস রোগ, হৃৎপিণ্ডের রোগ এবং ক্যানসারের ঝুঁকির সঙ্গে জড়িত।

মানুষের দেহকোষে নিউক্লিয়াসের বাইরেও মাইটোকন্ড্রিয়ায় রয়েছে ডিএনএ এবং জিন। প্রতিটি মানবকোষে রয়েছে একাধিক মাইটোকন্ড্রিয়া। আবার প্রতিটি মাইটোকন্ড্রিয়ায় রয়েছে একাধিক মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA)। মাইটোকন্ড্রিয়া হলো কোষের ‘শক্তিঘর’। কারণ, মাইটোকন্ড্রিয়া চিনি, চর্বি এবং অন্যান্য জ্বালানি অক্সিজেনের সাহায্যে দহন করে শক্তি উত্পাদন করে থাকে। অক্সিডটিভ ফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় মানবকোষের মাইটোকন্ড্রিয়াতে অধিকাংশ শক্তি উত্পাদিত হয়। এই প্রক্রিয়ায়, মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতরের ঝিল্লির ভেতরে থাকা সিরিজ প্রোটিন কমপ্লেক্সের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন পরিচলিত হয়। এসব ইলেকট্রন পরিচলন শক্তি অবমুক্ত করে। সেই ঝিল্লির মধ্যে সংরক্ষিত থাকে এবং ADP-কে ATP-তে রূপান্তরের জন্য ব্যবহৃত হয়। অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন বিষাক্ত অক্সিজেনকে পানিতে রূপান্তরের কাজটি করে। এটাই মানুষের জন্য একটি প্রতিরক্ষামূলক জীবজ সুবিধা দেয়। আবার এই অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন মানুষের ক্ষতির কারণও হয়। এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় রি–অ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিস। যেমন: সিঙ্গলেট অক্সিজেন ও হাইড্রোক্সাইল মূলক। এগুলো কোষের ভেতরকার জাতীয় পদার্থ, প্রোটিন এবং DNA-এর ক্ষতি করে।

ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত প্রায় শতকরা ২ ভাগ ইলেকট্রন থেকে রি–অ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিস উত্পাদন করে। দেহে কোনো রোগ দেখা দিলে বা বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটলে প্রচুর পরিমাণ রি–অ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিস উত্পাদিত হয়, যা কোষের সামগ্রিক অবনতি ঘটায় এবং বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়ারও তাত্পর্যপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।

দেহে উত্পাদিত মুক্ত মূলকগুলোর ক্ষতিকারক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। দেহের কোনো কোনো ব্যবস্থা মুক্তমূলক তৈরিতে বাধা দেয়। ক্যাটালেজ, গ্লুটাথিওন পার–অক্সিডেজ—দেহে উত্পাদিত এসব এনজাইম এ ধরনের কাজ করে। দেহের আরেক রকম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে। এরা মুক্তমূলক থেকে আরও মুক্তমূলক তৈরি হওয়ার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটাতে বাধা দেয় বলে মুক্তমূলক থেকে মুক্তমূলক উত্পাদনবাহিত হয়। সুপার–অক্সাইড ডিসমিউটেজ, ভিটামিন ই, ইউরিক অ্যাসিড এসব এনজাইম এবং উপাদান শেষোক্ত কাজগুলো করে। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, মুক্তমূলক উত্পাদনে বাধা দেওয়া প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে বলে মূক্তমূলক উত্পাদন দিন দিন বাড়তে থাকে। ফলে বয়ঃপ্রাপ্তি সংঘটিত হয় এবং দেহে বয়ঃপ্রাপ্তির নানা মাত্রার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

বয়স বাড়লে মুক্তমূলক বাড়ে বলে মানুষকে অ্যান্টি–অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হয়। নানা রকম রঙিন শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। এক রকম নয় বরং প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে নানা রকম রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল খেলে অর্থাৎ নানা রকম অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট গ্রহণ করলে মুক্ত মূলকের আগ্রাসন হ্রাস পাবে এবং দেহ সতেজ থাকবে। এতে যে বয়ঃপ্রাপ্তি বন্ধ হয়ে যাবে, তা নয়, তবে দেহের সতেজতা ধরে রাখতে এবং সুস্থ–সবল জীবনযাপনের জন্য অ্যান্টি–অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ বয়স বাড়ার সঙ্গে অতি জরুরি।

মানুষের বয়ঃবৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে জড়িত শারীরিক পরিবর্তনের একাধিক কারণ বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি উদ্‌ঘাটন করতে পেরেছন। বয়স বাড়ার কারণে মানুষের যেসব শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে, তা প্রায় একই রকম। মানুষের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের যেসব কারণ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার একটি হলো কোষের মধ্যস্থ ডিএনএর ক্ষয়। ডিএনএকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিটি ডিএনএ অণুর প্রান্তে রয়েছে একেকটি ক্যাপ বা ঢাকনা। এসব ক্যাপই ডিএনএ অণুকে সুরক্ষিত রাখে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্যাপ বা ঢাকনার ক্ষয় হতে থাকে। তাই এরা ক্রোমোজোমগুলোর দিতে পারে না।

আমাদের দেহের মধ্যে অসংখ্য কোষ রয়েছে। এসব কোষের কাজের বিভাজন রয়েছে। সব কোষের আচরণ একই রকম নয়, তবে তা স্থানভেদে সুনির্দিষ্ট। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিএনএর মধ্যে থাকা জিনের প্রকাশে ক্রমেই খানিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর ফলে কোষের আচরণও পাল্টে যেতে থাকে। মানুষের দেহে কোনো কোষের ক্ষয় পূরণের জন্য নতুন নতুন কোষ সৃষ্টি হয়। বয়স বাড়লে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। দেহের ভেতর শর্করা বা চর্বিজাতীয় খাদ্য পরিপাকের মাধ্যমে দেহে প্রয়োজনীয় শক্তি উত্পাদিত হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের পরিপাক করার ক্ষমতা কমতে থাকে। দেহে শক্তির কারখানা হলো কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া। বয়স বাড়তে থাকলে মাইটোকন্ড্রিয়ার কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের স্টেমসেলের শক্তি কমতে থাকে। ফলে এদের পুনরুত্পাদনক্ষমতা হ্রাস পায়। স্টেমসেল হলো অপরিস্ফুরিত কোষ, যা থেকে বিশেষায়িত পরিস্ফুরিত কোষ সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া দেহের কোষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করার কৌশল বিদ্যমান থাকে। সারাক্ষণ কোষগুলো এই যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড বজায় রাখে। বয়স যত বাড়ে কোষগুলোর মধ্যকার যোগাযোগ তত কমে যায়। ফলে সমন্বিত কার্যক্রম চালানোর বিষয়টি ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া এসব কারণ পর্যালোচনা করলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। বয়স বাড়ার কারণে দেহের একাধিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে থাকে। কিছু কারণ কোষের গাঠনিক আর কিছু কারণ কার্যকারণগত। দুই ধরনের পরিবর্তনের পেছনে কাজ করে বিভিন্ন রকম জিন। এদের সংখ্যা কত আর এরা কোথায় কোথায় থাকে, তার অনেকটাই এখনো আমাদের অজানা। তবে বয়স বৃদ্ধির ফলে দেহের গাঠনিক ও কার্যকারণিক পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত জিনের সংখ্যা যে অনেক, সেটি অনুমান করা যায়। আর এত বেশি জিনকে সামলানোর কৌশল উদ্ভাবন যে খুব কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, জেনেটিক ও প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগ,

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা