করোনা তীব্রতার কারণ কি মানুষের জিনোমে লুকিয়ে আছে

সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাপী অজানা এক ভাইরাস একের পর এক জনপদে হানা দেয়, কেড়ে নেয় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। আমাদের দেখিয়ে দেয় প্রকৃতির রুদ্ররোষের কাছে মানুষ কত অসহায়! ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল পর্যন্ত কেবল হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় গোটা বিশ্ব করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2) মহামারির কবলে পড়ে। প্রতিদিনই দীর্ঘ হতে থাকে মৃত্যুর মিছিল। অতিসংক্রামক এই ভাইরাস তখনও বাংলাদেশে আসেনি। করোনায় আক্রান্ত হলে জীবন রক্ষার উপায় কী—এ কথা ভেবে পুরো দেশ ছিল আতঙ্কিত।

কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। ১৮ মার্চ এ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। স্বাভাবিকভাবে দুদিনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। আবাসিক হলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বহু শিক্ষার্থী ফিরে যায় গ্রামে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের কিছু অকুতোভয় তরুণ গবেষক ও স্নাতক শিক্ষার্থী গ্রামে ফেরেননি। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল এবং রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে তাঁরা আরটি-পিসিআর (RT-PCR) যন্ত্র স্থাপন করেন। শেখাতে শুরু করেন এর ব্যবহার পদ্ধতি। এভাবে তাঁরা দ্রুত করোনা ভাইরাসের আরএনএর (RNA) উপস্থিতি নির্ণয় করে রোগী শনাক্তের কাজে ভূমিকা রাখেন। যদিও আমরা—বিভাগীয় শিক্ষকেরা—গবেষণাগার বন্ধ থাকায় কিছু করতে পারিনি।

আরও পড়ুন
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ—যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইটালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হার অনেক কম।

আমাদের বিভাগের তৎকালীন চেয়ারপার্সন ছিলেন অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ। জুম সভায় অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ করোনা গবেষণার সম্ভাবনা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। সে সময় আমাদের বিভাগে করোনার মতো একটি অতিসংক্রামক ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল। সেই সঙ্গে গোটা দেশে ছিল লকডাউন। এমন পরিস্থিতিতে এই অজানা ভাইরাস বা করোনায় আক্রান্ত রোগীর রক্তের নমুনা নিয়ে কীভাবে বিভাগে গবেষণা করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমাদের কয়েকজন সহকর্মী বিভাগের গবেষণাগারে করা সম্ভব, এমন গবেষণা প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে উদ্যোগী হন। বিশেষ করে অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন হাওলাদার এবং সজীব চক্রবর্তী খুব আগ্রহী ছিলেন। আমরা সে সময় করোনার বিশ্ব পরিস্থিতি, আক্রান্তের হার, মৃত্যু হার, ভাইরাসের নতুন ধরন, ভাইরাস নিয়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ, ভ্যাকসিন গবেষণার অগ্রগতি ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি। পাশাপাশি দেশে করোনা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত শতকরা ২০ ভাগের শরীরে রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। আবার অনেকের মধ্যে সংক্রমনের তীব্রতা এত বেশি হয় যে তাঁদের নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। রোগের তীব্রতা আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স, বংশগতির উপাদানের (DNA) বৈশিষ্ট্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, শরীরে বিদ্যমান অন্যান্য রোগের উপস্থিতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ।    

আমরা লক্ষ্য করি, পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ—যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইটালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হার অনেক কম। এ ছাড়াও একই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ব্যক্তির শরীরে রোগের উপসর্গের ধরন ও মাত্রায় বিভিন্নতা দেখা যায়। আমরা ধারণা করলাম, করোনায় আক্রান্ত রোগীর শরীরে সংক্রমণের মাত্রা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিকারী জিনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলো হলো কিছু হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (HLA) জিন, প্রত্যেকের শরীরেই থাকে। এই জিন থেকে উৎপন্ন প্রোটিন আমাদের শরীরে  শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে, যা বিভিন্ন ধরনের বহিরাগত অ্যান্টিজেনকে চিহ্নিত ও প্রতিরোধ করে। আর তাই দেহকোষের ভেতরে বিদ্যমান ডিএনএতে এইচএলএ তৈরিতে ব্যবহৃত জিনগুলো জিনোমের (সব জিনের সমষ্টি) যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেটি বেশি বহুরূপী। এইচএলএতে যেকোনো পরিবর্তন বহু রোগের অবস্থা—যেমন কম বা বেশি তীব্রতার সঙ্গে সম্পর্কিত। অতএব এইচএলএর জিনগত বৈচিত্র্যের জন্য যেকোনো ব্যক্তির সংক্রামক রোগের উপসর্গ প্রকাশের ধরন ভিন্ন হবে। আগের কিছু গবেষণায় দেখা যায়, HLA-B*46:01 জিনোটাইপ ধারণকারী ব্যক্তিদের দেহে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ হলে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হয়। অপরদিকে HLA-A*02: 05 ধারণকারী ব্যক্তিদের দেহে হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস বা এইচআইভির (Human Immunodeficiency Virus—HIV, এইডস সৃষ্টির জন্য দায়ী) সংক্রমণ হলে রোগের তীব্রতা হয় কম। অন্য গবেষণায় দেখা যায়, HLA-DRB1*04:01 এবং HLA-DRB1*04 জিনোটাইপ  ধারণকারী ব্যক্তিরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগের উপসর্গ অনেক কম থাকে। 

আরও পড়ুন
বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা ৭২ ভাগের বেশি মানুষ ইতিমধ্যে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) নিয়েছেন। বর্তমানে করোনা সংক্রমন খুব কম। তবু আমাদের এ গবেষণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগ পুরোদমে চালুর পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হয় আবারও। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে গবেষণা পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের কাছে প্রকল্প প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। অনেকগুলো প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া হয় আমাদের বিভাগ থেকে। অনুমোদনের পর কাজ শুরুর আগে করোনায় আক্রান্ত রোগীর রক্ত নিয়ে গবেষণা হবে, এমন তিনটি প্রকল্পের জন্য আমরা একত্রে রক্তের নমুনা (Blood Sample) সংগ্রহ করতে থাকি। কারণ, করোনা রোগীর সংখ্যা তখন খুব কম ছিল। আমাদের গবেষণার জন্য করোনার তীব্র, মধ্যম এবং অতিসামান্য সংক্রমণ হয়েছে—এমন রোগীর রক্তের প্রয়োজন ছিল। আমরা ঢাকা শহরের দুটি বড় হাসপাতাল থেকে রোগীর রক্ত জোগাড় করি। এ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত হয়নি, এমন ব্যক্তির রক্তও সংগ্রহ করি। এসব রক্তের নমুনা থেকে ডিএনএ আলাদা করার পর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি (NGS Technology) ব্যবহার করে সম্পূর্ণ এক্সোম সিকোয়েন্সিং (Whole Exome Sequencing—WES) করা হয়। এরপর বিভাগের গবেষণাগারে ডব্লিউইএসের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করা হয় বিভিন্ন বায়োইনফরমেটিকস টুলের সাহায্যে।

তারপর প্রথমে গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত সবার ডিএনএতে থাকা HLA-DRB1 জিনে বিদ্যমান জিনোটাইপগুলির পৌনঃপুনিকতা (Frequency) নির্ণয় করি আমরা। করোনার তীব্র সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর HLA-DRB1 জিনের Exon 2-তে আমরা কিছু রূপান্তরিত বৈচিত্র্য (Nonsynonymous Variants) লক্ষ্য করি। এগুলো ভালোভাবে বোঝার জন্য কয়েকটি প্রাইমার নকশা তৈরি করি, যা দিয়ে পিসিআর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জিনের ওই অংশগুলো কপি করে সংখ্যা বাড়িয়ে নিই। তারপর স্যাঙ্গার সিকোয়েন্সিং (ডিএনএর বেসগুলো, যেমন A, T, C, G-এর ক্রম) করা হয়। গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায়, HLA-DRB1 জিনের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে উপস্থিত দুই ধরনের জিনোটাইপ বৈচিত্র্য rs17878703 এবং rs3175105-তে যথাক্রমে AA এবং CC পরিবর্তন বহনকারী ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমণের তীব্রতার সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের গবেষণার এ ফলাফল অতিসম্প্রতি জিন রিপোর্টস সাময়িকীতে অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে (জুলাই, ২০২৩)।

বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা ৭২ ভাগের বেশি মানুষ ইতিমধ্যে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) নিয়েছেন। বর্তমানে করোনা সংক্রমন খুব কম। তবু আমাদের এ গবেষণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সার্স-কোভ-২ একটি আরএনএ ভাইরাস। তাই এর জিনোমে আরও অনেক পরিবর্তন হতে পারে, আসতে পারে এর অতিসংক্রামক নতুন ধরন। তখন বর্তমানে ব্যবহৃত ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা নাও থাকতে পারে। এমনকি ভাইরাসে কোনো পরিবর্তন না হলেও এই ভ্যাকসিনগুলো কতদিন পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, নতুন এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এবারই প্রথম এ টিকা দেওয়া হয়েছে।

তবু যেকোনো জনগোষ্ঠীর ডব্লিউইএস ডাটা অন্য অনেক রোগ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার ওপর আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, করোনা সংক্রমনে HLA-DRB1 জিনের rs17878703 এবং rs3175105 জিনোটাইপে যথাক্রমে AA এবং CC পরিবর্তন বহনকারী (ঢাকায় কিছু রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে এটি জানা সম্ভব) ব্যক্তিদের জন্য নিবিড় পরিচর্যার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এই আক্রান্তদের চিকিৎসা আরও ভালোভাবে করা যাবে।

এ গবেষণা নিয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে এই ঠিকানায়:

https://www.sciencedirect.com/science/article/abs/pii/S2452014423000821

লেখক: লেখকদ্বয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।

আরও পড়ুন