আইবিএসের মিথ ও বাস্তবতা

কল্পনা করুন, আপনি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। হঠাৎ আপনার তলপেটে বিশেষ ধরনের ব্যথা শুরু হল। পেটের ভেতর সবকিছু যেন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে।

কপাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ল গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের ওপর। কারণ, আপনি জানেন, কাছের কোনো পাবলিক টয়লেটে যদি এখন আপনাকে যেতে হয়, হাতে মাত্র কয়েকটা মিনিট সময় রয়েছে। না হলে হয়তো এই মাঝ রাস্তায় গাড়ির ভেতরই বাথরুম হয়ে যেতে পারে।

প্রচণ্ড ভয় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আপনাকে, পাগলের অপেক্ষা করছেন পরবর্তী স্টপের।

কিছুক্ষণ পর জানতে পারলেন, সামনের স্টপেই একটি টয়লেট রয়েছে।

স্টপটিতে থামালেন, প্রচণ্ড জোরে লাগালেন গাড়ির দরজা। উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেলেন সেই টয়লেটের দরজার দিকে। বাথরুম সেরে অবশেষে আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, সিমপ্যাথেটিক ড্রাইভটা আপনা থেকেই কমে এল।

যদি ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস (IBS) থাকে, তাহলে আপনার দৈনন্দিন জীবনের চালচিত্রটা অনেকটা এমনই হবে। আইবিএস আমাদের অন্ত্রের একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। এখানে অন্ত্রের অনিয়মিত নড়াচড়া, পাকস্থলীতে তীব্র ব্যথা, ব্লটিং বা পেটের ভেতরে অস্থিরতা বেশি দেখা যায়। এটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ভেতরই দেখা যায়। এই রোগীদের প্রতি তিন জনের দুজনই হলেন নারী। ধারণা করা হয়, আইবিএসে নারীদের বেশি ভোগার পেছনে বেশ কিছু জৈবনিক উপাদান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাদের পিরিয়ড চলাকালীন প্রোস্টাগ্লান্ডিন নামের একটি পদার্থের পরিমাণ শরীরে হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। ফলে তাদের জরায়ুর কন্ট্রাকশন বা কুঞ্চন হয় এবং ধারণা করা হয় একইসঙ্গে অন্ত্রেও কুঞ্চন ঘটে। ফলে সৃষ্টি হয় আইবিএস ।

আইবিএস মূলত আমাদের অন্ত্রকে বিশেষ করে বৃহদান্ত্র বা লার্জ বাওয়েলেক আক্রান্ত করে। অন্ত্র কিন্তু আমাদের শরীরের সবচেয়ে বৃহদাকার এবং জটিল গঠনের অঙ্গগুলোর একটি। আমাদের চামড়া যে পরিমাণ সারফেস এরিয়া দখল করতে পারে, অন্ত্র তার থেকে প্রায় ৪০ গুণ বেশি জায়গা দখল করতে সক্ষম।

আমরা যখন খাবার খাই, সেগুলো নানা ধরনের হরমোন ও এনজাইমের প্রভাবে ভেঙে সরল খাদ্য উপাদান হিসেবে শোষিত হয়। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন অন্ত্রের নালীগুলোর একসাথে সংকোচন ও প্রসারণ ঘটে। ব্যাপারটিকে ইংরেজিতে বলা হয় পেরিস্টালসিস। এই পেরিস্টালসিসের মাধ্যমে খাবারের ভাঙা সরল রূপ মুখগহ্বর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের মলদ্বারে পৌছায়। দূর্ভাগ্যবশত যাদের আইবিএস রয়েছে তাদের এই অন্ত্র অতি মাত্রায় সংবেদনশীল। যখন খুব দ্রুত সংকোচনটা ঘটে, তখনই ডায়রিয়া দেখা দেয়। আবার যখন এই সংকোচনটা খুবই ধীরে ঘটে, তখন আবার কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়। তাই বলা যায়, আইবিএসের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য, কিংবা এদের উভয়ের মিশ্রণে রোগী রয়েছে।

আইবিএসের প্রকৃত কারণ আসলে কি, সেটা নিয়ে কিন্তু এখনো গবেষণা চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণগুলো বিভিন্ন মানসিক সমস্যা, যেগুলো কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা সিবিটি দিয়ে কিছুটা নিরাময় করা সম্ভব।

আরেকটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, আমাদের চামড়া এবং অন্ত্রে এক ধরনের বিশেষ রিসেপ্টর থাকে—সেগুলো এলার্জি বা চুলকানির জন্য দায়ী। এই রিসিপ্টরগুলোর প্রভাবে ব্যথার সৃষ্টি হয়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাট ইচ (Gut Itch)। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ব্যাখ্যা দেয়া যায়। সেই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে কিছু বিশেষ ধরনের খাবার থেকে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট ইমিউনো রেসপন্সের কারণে হিস্টামিন নিঃসৃত হয়ে চুলকানি সৃষ্টি করে।

পেটে ব্যথা বা এই ধরনের শারীরিক সমস্যা তো বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। চিকিৎসকরা বিভিন্ন লক্ষণ এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য পেটের রোগে আক্রান্তদের সঙ্গে আইবিএসে রোগীদের আলাদা করেন। আপনি যদি এগুলোর বাইরে আইবিএসের আরও কিছু কারণ খুঁজতে যান, সেগুলোর তালিকাও হয়েতা আপনাকে অবাক করতে পারে। এদের ভেতর রয়েছে স্ট্রেস বা মানসিক অশান্তি, বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন, কিছু ওষুধ এবং খাবার।

আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রায় দুশ্চিন্তামুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন আসলেই বেশ কঠিন। তাই চিকিৎসকরা এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসায় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বেশি ব্যবহার করেন। যখন আপনি কোনো ইন্টারভিউ, পরীক্ষা, কিংবা গণজমায়েতে যান, এই ধরনের সমস্যাগুলো বেশি হয়। তখন এই ওষুধগুলো ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা উভয় ধরনের আইবিএস প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

কিছু রোগী আবার দাবি করেন, এই ওষুধের সাথে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে তারা আরও ভাল ফল পেয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ভিটামিন ডি এর ব্যবহার অনেকটাই বির্তকিত। কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, ভিটামিন ডি রোগের মাত্রা অনেকটা কমায়। আবার আরেক গবেষণায় বলা হচ্ছে, যেসব রোগীদের আইবিএসে পেটে ব্যথা থাকে, তাদের ভিটামিন ডি তেমন কোনো উপকারেই আসে না।

আবার যাদের আইবিএস খাবারের সাথে সম্পর্কিত, চিকিৎসক তাদের সেসব খাবার থেকে দূরে থাকবার পরামর্শ দেন। গম ও গমের তৈরি খাবার যেমন, রুটি, বিস্কুট, কেক, বিভিন্ন বেকারি প্রোডাক্ট, রাই, রসুন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য যেমন, আইসক্রিম, মিষ্টি, তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার, পোলাও, বিভিন্ন ধরনের ডাল, শাক, বিভিন্ন ধরনের ফল, মধু, চা, কফি এসব মুখরোচক খাবার আপনার এই অসুখকে আরও খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিছু বিশেষ ধরনের শর্করা খুব ধীরে ক্ষুদ্রান্ত্র বা স্মল ইনটেস্টাইনকে অতিক্রম করে। ফলে এগুলো পানিকে আকর্ষণ করে এবং বৃহদান্ত্রে খাবারের পচন ঘটায়। এদেরকে ফার্মেন্টেবল ওলিগো-ডাই-মনোস্যাকারাইডস অ্যান্ড পাইরল বা সংক্ষেপে এফওডিএমএপি (FODMAP) বলা হয়। এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন, এফওডিম্যাপ ডায়েট মেনে চলুন।

সাধারণত আইবিএস রোগীদের অন্ত্র যেকোনো ধরনের প্রভাবকের প্রতি খুবই সংবেদনশীল হয়।

তাই অন্ত্রের দেয়ালের যে কোন ধরনের প্রসারণ এবং সংকোচনের ফলে পেটে ব্যথা হতে পারে। তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে গ্যাস তৈরি হওয়া এবং পেটে অস্বস্তি লাগা এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

এফওডিএমএপি ডায়েট এই ধরনের আইবিএস সৃষ্টিকারী শর্করাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। মূলত আইবিএস প্রতিরোধ করতেই এই ধরনের ডায়েট তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে অনেকটাই সফল বলা যায়। দেখা গেছে, এই ডায়েট প্রতি চারজনের তিনজন রোগির আইবিএসের মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

আইবিএস প্রতিরোধের সব রোগির জন্য বাধা ধরা নিয়ম আসলে খাটে না। এক কাপ কফিতে যে পরিমাণ ক্যাফেইন থাকে, তা হয়েতা একজন মানুষের পেটে ব্যথার কারণ হতে পারে। আবার দেখা যাবে, এই পরিমাণ ক্যাফেইনে লোকটির পাশে বসা তার বন্ধুর পেটে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না।

তাই ঠিক কোন কোন খাবার কিংবা কী কারণে আপনার পেটে সমস্যা হচ্ছে, সেটির একটি তালিকা করে নিশ্চিত হতে হবে।

লেখক: মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মিরপুর, কুষ্টিয়া।

সূত্র: ডেভিডসন’স প্রিন্সিপালস অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব মেডিসিন/সম্পা: ইয়ান ডি পেনাম, স্টুয়ার্ট এইচ. র‍্যালস্টন, মার্ক ডব্লু জে স্ট্রাচান ও রিচার্ড পি হবসন, সায়েন্স অ্যালার্ট ও উইকিপিডিয়া