অন্ধকারকে ভয় করুন

গল্পটা প্রিয় নামের একটা ছেলেকে নিয়ে। সে সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিল। তারপর ঢাকায় চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করবে। উঠেছে ফার্মগেটের কাছে নাখালপাড়ার এক ছয়তলা বাড়িতে। চারতলার একটা রুম। সঙ্গে থাকবে দুই বন্ধু। ভাড়াও সস্তা। খারাপ দিক একটাই, রুমটার কোনো জানালা নেই। তবে কয়েকটা মাসই তো! দেখতে দেখতে চলে যাবে।

বিকেলবেলা ওরা সবাই কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতে যায়। আর বাকিটা সময়ে প্রচুর পড়ে। মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি যে হয় না, তা নয়। সেদিনই ওরা অ্যাডভেঞ্চারে নামে, পায়ে হেঁটে উত্তরায় যায়! তবে অ্যাডমিশনের সময় বলে কথা, ধীরে ধীরে এসব কমে যায়। ওরা সারা দিন রুমে থাকে। চেয়ারে বসে কিংবা ম্যাট্রেসে শুয়ে শুয়ে পড়ে। গুজব রটে, পাশের মেসের এক ছেলে নাকি বাথরুমেও...!

দুমাস পার হয়ে যায়। প্রিয়র বাবা সেলিম সাহেব ছেলের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসেন। দু-এক দিন প্রিয়র আচার-ব্যবহার দেখে তার মনে খটকা লাগে। ওর বন্ধুদের কাছে জিনিসগুলো স্বাভাবিক লাগলেও বাবার মন তো, কিছু না থাকলেও অনেক কিছু দেখে ফেলেন।

প্রিয় রোজ সকালে বড্ড দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। এত বছর ধরে সকাল ৮টায় ক্লাস করে আসা ছেলে ১২টায় উঠবে ঘুম থেকে, সেলিম সাহেবের মানতে কষ্ট হয়। নাওয়া-খাওয়ারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই, তাই পেটের সমস্যায় নিয়মিত ভোগে। মনমরা হয়ে থাকে সব সময়ই। অ্যাডমিশনের সময় মনমরা সবাই থাকে, এটা ঠিক কিন্তু ছেলেটা অহরহ ক্লাস মিস দেয়, চুপ হয়ে থাকে। কোনো কোনো দিন বিছানা থেকে ওঠেই না। খাবার ঠিকমতো না খাওয়া, গোসল ঠিকমতো না করা তার রুটিন। ছেলেটার মলিন মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। পড়াশোনাতেও ভালো করছে না আর। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা নিয়ে যে ছেলে ঢাকায় এসেছে, এই দুই মাসে সে কী করে এমন হয়ে গেল!

সেলিম সাহেবের বন্ধু ডা. হাদী পিজি হাসপাতালে একজন মনোচিকিত্সক। তিনি ছেলেকে বন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন। সব শুনে ডা. হাদী বললেন, ছেলে একধরনের ডিপ্রেশনে ভুগছে, তবে চিন্তার কিছু নেই। কয়েক দিনে ঠিক হয়ে যাবে তার দেওয়া পথ্য (দাওয়া?) মেনে চললে। প্রেসক্রিপশন পড়ে প্রিয় একদম চমকে গেল। চিকিত্সক তাকে প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা ছাদে গিয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে পড়তে ও আধা ঘণ্টা ব্যায়াম করতে বলেছেন! ভিটামিন ডি ট্যাবলেটের কৌটা ধরিয়ে দিলেন। এই, আর কিছু না!

প্রিয় যে ধরনের ডিপ্রেশনে ভুগছে, তার নামই হলো স্যাড (Seasonal Affective Disorder)! এর প্রকোপ সাধারণত দেখা যায় মেরুর দিকের দেশগুলোতে। শীতকালে, যখন সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া মুশকিল। এমন সময়ে আত্মহত্যার হার চূড়ায় চলে যায়। দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জনে ৫ জন মানুষ স্যাডে আক্রান্ত হয়ে এই সময়ে আত্মহত্যা করে। সব কটি আত্মহত্যার পেছনে স্যাডের কবল না থাকলেও আত্মহত্যার হারের বৃদ্ধির সঙ্গে স্যাডের প্রকোপ বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক আছে।

সূর্যের আলোর সঙ্গে স্যাডের কী সম্পর্ক? উত্তরটা হলো ভিটামিন ডি-তে। ভিটামিন ডি তৈরি হয় মানুষের ত্বকে, সূর্যের আলোতে থাকা অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে। মানবদেহে ভিটামিন ডি যেমন ক্যালসিয়াম ডিপোজিশনে সহায়তা করে হাড় মজবুত করে বলে আমরা জানি। কিন্তু এর কাজ এখানেই থেমে নেই। ভিটামিন ডি-এর সক্রিয় রূপ এক হাজারের বেশি জিনের প্রকাশে জড়িত।

এসব জিনের মধ্যে মস্তিষ্কের রসায়নকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন জিনও আছে। তাই ভিটামিন ডি-এর অভাবে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বাধাগ্রস্ত হয়, এর একটা ফলাফল হলো ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন বেশ জটিল একটা মানসিক রোগ।

যদিও স্যাড ডিপ্রেশন সারিয়ে তোলা সহজ, ডিপ্রেশনের অন্য ধরনগুলোর পথ্য এত সরল নয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জিনগুলোর প্রকাশে ভূমিকা রাখে ভিটামিন ডি ছাড়া আরও অনেক রাসায়নিক সংকেত। মানসিক রোগগুলো তাই শুধু একটা ভিটামিন দিয়েই সারিয়ে তোলা যায় না।

প্রকৃতির সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক অনেক গভীর। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সব ধরনের ডিপ্রেশন ও অনেক ধরনের মানসিক রোগ সারিয়ে তুলতে খোলামেলা প্রকৃতি ও সূর্যালোক ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজে ও কারখানায় সূর্যের আলো ও প্রকৃতিকে দেখার সুযোগ না থাকলে কর্মস্পৃহা হ্রাস পায় ও মনের সন্তুষ্টি কমে যায়। মানুষের মনমানসিকতা তার চারপাশের সবকিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইট-পাথরের শহরে বাস করে তাই আমরা শুধু দূষণজনিত রোগে ভোগার ঝুঁকিতেই থাকি না, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ক্রমে দুর্বল হয়ে যায়। পার্কে ঘোরাফেরা করা, সকালবেলা কিছুটা সময় রোদে কাটানো তাই শাকসবজি খাওয়ার মতো অতিপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়।

প্রিয় একা নয়। ঢাকা শহরে বর্তমানে বাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ। পৃথিবীজুড়ে শহর এলাকায় বাস করে ৩৭৫ কোটির বেশি মানুষ। এই মানুষগুলোর একটা বড় অংশ সারাটা দিন পার করে দেয় কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা ছাড়াই। ফ্লোর স্কেচের আক্রা দরের ঠেলায় অফিসগুলোতে চাকরিজীবীদের থাকতে হয় ছোট ছোট অনেক কিউবিকলে। জানালাওয়ালা অফিস রুম পাওয়া, সে এক বিশাল মর্যাদার ব্যাপার।

অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মালিকেরাও ‘কবুতরের খোপ’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। এমন রুমে মানুষকে থাকতে হয়, যেখানে জানালা থাকলেও সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া যায় না। বাতাস আসে শুধু বাইরে থেকে।

প্রকৃতির ইতিহাসে বিগত দুই লাখ বছর ধরে মানুষ সব সময়ই দৈনিক যথেষ্ট পরিমাণ সূর্যের আলো দেখে ও উন্মুক্ত পরিবেশে চলাফেরা করে অভ্যস্ত। তাই প্রকৃতির সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক অনেক গভীর। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সব ধরনের ডিপ্রেশন ও অনেক ধরনের মানসিক রোগ সারিয়ে তুলতে খোলামেলা প্রকৃতি ও সূর্যালোক ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজে ও কারখানায় সূর্যের আলো ও প্রকৃতিকে দেখার সুযোগ না থাকলে কর্মস্পৃহা হ্রাস পায় ও মনের সন্তুষ্টি কমে যায়।

লেখক: বায়োটেক আর অ্যান্ড এইচ অফিসার, হেলকেয়ার ফার্মাসিটিউক্যাল, ঢাকা

সূত্র: এম নাথানিয়েল মেডের ‘বেনিফিট অব সানলাইট: আ ব্রাইট স্পট ফর হিউম্যান হেলথ’ প্রবন্ধ অবলম্বনে

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়