ওষুধশিল্পের এক কালো অধ্যায়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ঘটনা। মানসিক অবসাদ বা অ্যাংজাইটি তখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ১৯৫৭ সালে পশ্চিম জার্মানির কেমি গ্রুনেনথল ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি ‘কন্টার্গান’ নামে বাজারে নিয়ে আসে এক জাদুকরী ড্রাগ। এটা তৈরি হয় থ্যালিডামাইড নামের এক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে। সিডেটিভ, ট্রানকুইলাইজার বা উত্তেজনা নিরোধক হিসেবে এই ওষুধের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে যেতে থাকে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ইউরোপ-আমেরিকা সবখানেই এই ড্রাগের তখন জয়জয়কার। বিপুলভাবে শুরু হয় এই ওষুধের ব্যবহার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতি সাতজনে একজন এই ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালের মধ্যে এই ড্রাগ ছড়িয়ে যায় বিশ্বের ৪৬টি দেশে।

এর কিছুদিন পরই অস্ট্রেলিয়ান চিকিত্সক উইলিয়াম ম্যাকব্রাইড লক্ষ করেন, গর্ভবতী মায়েদের জন্যও ড্রাগটি ব্যবহার করা যেতে পারে। গর্ভবতীদের মর্নিং সিকনেস ব্যাধির চিকিত্সায় ভালো ফল আনে এই ওষুধ। গর্ভবতী মায়েদের এটি একটি পরিচিত অসুখ।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) তখনো ড্রাগটিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বৈধ ঘোষণা করেনি। কানাডিয়ান ফার্মাকোলোজিস্ট ফ্রান্সেস কেলসি এই ওষুধের বৈধতা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি এফডিএতে একজন ড্রাগ রিভিউয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তখন। এই নারী বিজ্ঞানী থ্যালিডামাইডের অনুমোদন ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে অনেক চাপের মুখেও স্থগিত করে রেখেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি সহকর্মীদেরও সহযোগিতা পেয়েছিলেন। থ্যালিডামাইডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে তিনি আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে মত দেন। অন্যদেরও ড্রাগটি নিয়ে আরও গবেষণার আহ্বান জানালেন।

কয়েক বছরের মধ্যেই মিলল কেলসির কথার সত্যতা। পৃথিবীজুড়ে কাতারে কাতারে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হতে লাগল। এক গবেষণায় দেখা গেল, যেসব মা গর্ভকালে এই থ্যালিডোমাইড ড্রাগ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের শিশুই জন্ম নিচ্ছে কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা নিয়ে। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও মস্তিষ্কের বিকাশ অপরিপূর্ণ বা কারোর অন্য কোনো অর্গান ফেইলিয়র। শিশুর এই প্রতিবন্ধিতা নির্ভর করত গর্ভাবস্থার কোন সময়ে ড্রাগটি গ্রহণ করা হচ্ছে তার ওপর। যেমন গর্ভাবস্থার ২০তম দিনে গ্রহণ করা হলে বিকৃত মস্তিষ্কের শিশু জন্মাত। ২১তম দিনে হলে চোখ, ২২তম দিনে মুখ, ২৪তম দিনে হাত আর ২৮তম দিনে পায়ের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মাত। পরে দেখা যায়, থ্যালিডামাইড ড্রাগ পুরুষের শুক্রাণুর মধ্য দিয়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে। দ্রুতই এই ওষুধের ভয়াবহতা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ড্রাগটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ওষুধশিল্পে এই কালো অধ্যায়কে থ্যালিডামাইড ট্র্যাজেডি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া এই ড্রাগ এখন ক্রয়-বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ফ্রান্সিস কেলসির এই দূরদর্শিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তাঁকে ভূষিত করেন প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর ডিস্টিংগুইশড ফেডারেল সিভিলিয়ান সার্ভিস পদকে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রথম পাতায় তাঁকে একজন জাতীয় বীর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬২ সালে ওষুধ নিয়ে কঠোর আইন প্রণয়নের পেছনে থ্যালিডামাইড নিয়ে তাঁর প্রচেষ্টার ভূমিকা ছিল।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত