কীটপতঙ্গ দমনে পারমাণবিক শক্তি

কীটপতঙ্গ একদিকে আমাদের বন্ধু, অন্যদিকে দুর্জেয় এক শত্রু। এই শত্রু আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি আর বালা-মুসিবতের কারণ। এগুলো নানাভাবে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়েও আমরা এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এদের বিপুল সংখ্যাধিক্য, সহনশীলতা ও সর্বভূক জাতীয় খাদ্যাভ্যাসই এর মূল কারণ বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

জীবজগতের সব গাছগাছালি ও ছোট-বড় প্রাণীর শতকরা ৫০.৮ ভাগ কীটপতঙ্গ। আবার উদ্ভিদ জগেক বাদ দিলে এককভাবে প্রাণিজগতের ৭২ শতাংশই কীটপতঙ্গ। কীটপতঙ্গের প্রজাতি পরিসংখ্যানে এযাবৎ ১০ লাখ কীটপতঙ্গ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে।

কীটপতঙ্গ কোথায় নেই? এক মেরু অঞ্চল ছাড়া পৃথিবীর সব জায়গায় এদের দেখা যায়। এদের উষ্ণ প্রস্রবণ, লবণাক্ত হ্রদ, পেট্রোলিয়াম-ডোবা সব জায়গায় দেখা যায়। এমনকি হিমালয় পর্বতের ১৯ হাজার ৬৮৫ ফুট ওপরেও বেশ কিছু জাতের কীটপতঙ্গ স্থায়ীভাবে বসবাস করে।

এক হিসাবে দেখা যায়, পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে কীটপতঙ্গই আমাদের বড় এক শত্রু। কেননা, সারা পৃথিবীতে আমরা যে খাদ্যশস্য ধান-চাল-গম, তৈলবীজ, মসলা উত্পাদন করি, গোলাঘরে এর ১০ থেকে ১৫ ভাগ বিনষ্ট করে কীটপতঙ্গ। আমাদের মতো বিজ্ঞানে অনুন্নত দেশে অনেক সময় তা হয়ে দাঁড়ায় ৩০ ভাগের মতো।

এ ধরনের ক্ষতি যে কেবল গোলাঘরেই হয় তা নয়, খেতখামারেও এর উপদ্রব একই রকমের। ধান, গম, ভুট্টা, পাট, ইক্ষু ও অন্যান্য ফসলের খেতে এদের আক্রমণ কৃষককে প্রতিনিয়ত অসহায় অবস্থায় ফেলে।

সাধারণভাবে আমরা জানি, কীটপতঙ্গের উত্পাতে জনজীবন অতিষ্ঠ। গবাদিপশু-পাখিও এদের উত্পাত থেকে রক্ষা পায় না। মশা-মাছি, ছারপোকা, উকুন ইত্যাদি কীটপতঙ্গ প্রতিদিন ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েড, ডেঙ্গুর মতো ভয়ংকর রোগ ছড়িয়ে চলেছে।

তবে কীটপতঙ্গ থেকে আমরা যে অর্থকরী রসদসামগ্রী পাই, যেমন রেশম (সিল্ক), মধু, মোম ও গালা (শেলাক), অন্য কোনো সূত্রে বা কৃত্রিম উপায়ে তা পাওয়া সম্ভব নয়। পরাগায়নে কীটপতঙ্গের যে ভূমিকা, এর বিকল্প নেই। আবার অনেক কীটপতঙ্গ কৃষকের ফসল বিনষ্টকারী পোকামাকড় খেয়ে বাঁচে।

এক হিসাবে দেখা গেছে, পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে কীটপতঙ্গের সংখ্যা ৩০ কোটি গুণ বেশি। এদের উপকারের কথা বাদ দিয়ে এই বিপুলসংখ্যক কীটপতঙ্গ যখন খাদ্য ও বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সবকিছুতে ভাগ বসায়, তখন অনেক সময় আমাদের দিশেহারা হওয়ারই কথা। কীটপতঙ্গ (বিশেষ করে Pest) দমনের বড় সমস্যা হলো আনুমানিক ৩৫ কোটি বছর আগে (ডেভোনিয়ান যুগ) পৃথিবীতে এদের আবির্ভাব ঘটেছিল। কাজেই দেখা যায়, কীটপতঙ্গ সুদীর্ঘ সময়ের নানা প্রতিকূল অবস্থার জটিলতা পেরিয়ে টিকে আছে। কাজেই প্রকৃতিতে এদের সহনশীলতা অনেক বেশি। এ ছাড়া এগুলো এদের আশপাশের সবকিছুই খেতে পারে। এদের খাদ্যাভ্যাসের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ এবং নতুন ও উদ্ভূত পরিবেশে এরা সহজে টিকে থাকতে পারে। আবার ফাঁকি দিতে পারে আমাদের আবিষ্কৃত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা দমন-কৌশলও।

সাধারণভাবে আমাদের কৃষিপণ্য বা ঘর-গৃহস্থালির ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে এর মধ্যে: (ক) রাসায়নিক কীট বিষ (খ) হরমোনের ব্যবহার গ) ভৌত পদ্ধতি (তাপ-আলোর ব্যবহার) (ঘ) যান্ত্রিক পদ্ধতি (হাত বা ফাঁদে আটকানো) (ঙ) জৈবিক পদ্ধতি (এদের শত্রুকে উত্সাহ-সাহায্য করা) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এসব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কার্যকারিতার দিক দিয়ে দুর্বল। কারণ ধরা যাক, রাসায়নিক কীট বিষ প্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কীট বিষ কয়েকবার ব্যবহার করলে টার্গেট কীটপতঙ্গ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়। ফলে সেই রাসায়নিকের কার্যকারিতা হারায়। এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানী মহলও বসে নেই। তাঁরাও নতুন নতুন দমন পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পারমাণবিক রশ্মির সাহায্যে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনের চেষ্টা তেমনি একটি উদ্যোগ। আমাদের দেশে পারমাণবিক রশ্মি ব্যবহারের ভাবনা ও গবেষণার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। গত শতাব্দীর ৬০ দশকে তা শুরু হয়েছিল।

পারমাণবিক রশ্মি ব্যবহার

পারমাণবিক শক্তি থেকে আসা তেজস্ক্রিয়তা ও এর ব্যবহারিক প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে বর্তমান সময়ের আবিষ্কার। প্রকৃতিতে যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ (Radioactive element) রয়েছে, এর সূত্রপাত মাদাম কুরির রেডিয়াম আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। পরে দেখা গেল, কোনো বস্তু বা পদার্থকে তেজস্ক্রিয় করা যায়, যা থেকে পারমাণবিক রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় শক্তির (ওড়হরুরহম ত্ধফরধঃরড়হ) বিকিরণ হয়। কিন্তু এই শক্তি যে জীবন, দেহের জন্য ক্ষতিকর তা শনাক্ত করা হয় আরও পরে (বেকেরেল, ১৯০১)। আরও পরে অণুজীবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই তেজস্ক্রিয় রশ্মি যেকোনো জীবনের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর হতে পারে তা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন। এই মূল মন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে কৃষি, খাদ্য, ওষুধ ছাড়াও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এর প্রয়োগের ওপর কাজ শুরু হয়।

আমাদের দেশে ১৯৭৯ সাল থেকে পারমাণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (অঊজঊ) সাভারের বিজ্ঞানীরা কীটপতঙ্গ দমনে তেজস্ক্রিয় রশ্মির ওপর কাজ শুরু করেন। সেই সময়ে সাভারের পারমাণবিক প্রতিষ্ঠানে একটি ৫০০০ কুরি (৫০০০ ঈর ঈড়৬০) কোবাল্ট রশ্মি সোর্স স্থাপিত হয়েছিল। সেই রশ্মি সোর্স থেকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের বিভিন্ন স্তরের ওপর তা প্রয়োগ করে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়।

গুদামঘরের ধান-গম-ডাল-তেলবীজ, মসলাপাতির ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ যথা Sitophilus, Tribolium, Trogoderma, Callosobruchus ইত্যাদির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, শূন্য দশমিক ৪ কিলোগ্রে (0.4 kgy) মাত্রায় তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগ করে এদের সব স্তরের (ডিম, শূককীট, মূককীট, পরিণত) কীটপতঙ্গ বিনষ্ট করা যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে পারণবিক রশ্মির প্রয়োগ ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ (Pest) নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর পদ্ধতি। এর ব্যবহারে খাদ্যদ্রব্যে কোনো অবশিষ্টাংশ থাকে না। কারণ, রশ্মি একটি ভৌত শক্তি, যা যেকোনো বস্ত্র ভেদ করে চলে যায়। অন্যদিকে সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত রাসায়নিক কীট বিষ প্রয়োগে গুদামজাত শস্যকণায় অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর।

বিশ্বের প্রায় ৪০-৫০টি দেশে খাদ্য সংরক্ষণ ও কীটপতঙ্গ দমনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক রশ্মির নিয়মিত ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু আমরা এখনো গবেষণাগার ছাড়িয়ে এর ব্যবহারে যেতে পারিনি। এর প্রধান কারণ এই পদ্ধতির উপকরণগুলো আমদানিকৃত ও ব্যবহার পদ্ধতি যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ফলে কীটপতঙ্গ দমনে তেজস্ক্রিয় রশ্মির ব্যবহার বাণিজ্যিক হারে ব্যবসায়ী মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। তবে আমাদের আমদানিকৃত খাদ্যশস্য যখন সমুদ্রবন্দর দিয়ে দেশে ঢোকে, বাণিজ্যিক রশ্মিযন্ত্র (Irradiator) বসিয়ে কনভেয়ার বেল্টের সাহায্যে এই শক্তি প্রয়োগ করা যায়। এতে অন্য দেশ থেকে আগত জীবাণু ও কীটপতঙ্গ রোধ করা সম্ভব হয়। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনে তা সরকারি উদ্যোগে করা যেতে পারে।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন; খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়