ন্যানো ডেন্টিস্ট্রি

ন্যানো অর্থ একশ কোটি ভাগের এক ভাগ। অতি ক্ষুদ্র এসব কণিকার কাজ করার বৈশিষ্ট্য বা গুণ বড় বড় কণা বা পদার্থদের থেকে অনেক আলাদা হয়। ন্যানো ডেন্টাল কণিকার আবিষ্কার দাঁতের চিকিত্সাবিজ্ঞানকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। ন্যানো পাউডার, ন্যানো কম্পোজিট এবং এ ধরনের আরও ন্যানো কণিকা, ন্যানো ফিলার ও অন্যান্য ন্যানো যন্ত্রের বিকাশ দন্ত চিকিত্সাকে উন্নত করছে দিন দিন।

দাঁতের চিকিত্সায় আজকাল সাদা কম্পোজিট ফিলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে সিলিকা ও জিরকোনিয়ামের ন্যানো কণিকার মিশ্রণ। ন্যানো কম্পোজিট রেজিন বাড়িয়ে দিচ্ছে ফিলিংয়ের স্থায়িত্ব। দাঁতের স্বাভাবিক রঙের সঙ্গে এর রঙের মিল রয়েছে। তাই ফিলিংয়ের পরে দাঁত দেখতে আর কটু হচ্ছে না, সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন থাকছে প্রায় শতভাগ। আবার ক্রাউন বা ব্রিজ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ন্যানো আকৃতির ইট্রিয়াম, যা ক্রাউনের স্থাপনাকে করছে আরও মজবুত।

এসব ন্যানো কণিকার অনেকেরই থাকে সেলফ-হিলিং ক্যাপাসিটি। তাই এরা ক্ষয়প্রাপ্ত হলে নিজেরাই সেই ক্ষয় রোধ করতে সক্ষম। এরা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঠেকিয়ে দিতে পারে। ফলে দাঁত অনেক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

ন্যানো কণিকা ব্যবহার করা হচ্ছে দাঁতের রোগ শনাক্ত করতেও। দাঁতের ক্ষয়রোগের প্রধান কারণ দাঁতের ওপর জীবাণুদের বিস্তার। দীর্ঘ সময় ধরে জীবাণুরা দাঁতের ওপর একধরনের বায়োফিল্ম বা পরত তৈরি করে। এসব জীবাণু ধ্বংস করতে হলে তাদের আগে চিহ্নিত করতে হয়। আর এই প্রক্রিয়া অনেক লম্বা।

ন্যানো ডেন্টিস্ট্রিতে এসব জীবাণু শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কোয়ান্টাম-ডট ন্যানো কণিকা। এসব কোয়ান্টাম-ডট দাঁতের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এলেই জ্বলে ওঠে। ফলে সহজেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আলোতে শনাক্ত করা যায়। কোয়ান্টাম-ডট তার প্রতিপ্রভা ক্ষমতার মাধ্যমে মুখগহ্বরে কোনো ক্ষতিকর কোষ থাকলে আলো নিঃসরণ করতে পারে। মুখের ক্যানসার নির্ণয়েও খুবই কার্যকর হতে পারে এই প্রযুক্তি।

টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং ডেন্টিস্ট্রি বিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। মুখের ফ্র্যাকচার, কার্টিলেজ বা লিগামেন্ট পুনর্গঠন, হাড়ের বৃদ্ধি ইত্যাদিতে টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভূমিকা অপরিসীম। এই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ব্যবহূত বিভিন্ন জৈব পলিমারের সঙ্গে ন্যানো উপাদান যুক্ত করে পুনর্গঠিত লিগামেন্ট বা হাড়কে আরও মজবুত ও স্থায়ী করা যেতে পারে। ইদানীং অনেক টুথপেস্টেও ব্যবহার করা হচ্ছে ন্যানো আকৃতির ক্যালসিয়াম কার্বনেট। ফলে রিমিনারালাইজেশন প্রক্রিয়ায় দাঁতের এনামেলের প্রাথমিক ক্ষত সারানো সম্ভব হয়েছে। কিছু কিছু পেস্টে যুক্ত করা হয়েছে সিলভারের ন্যানো কণিকা। এই কণিকাগুলো দাঁতের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেপটোকক্কাস মিউট্যান্সের বিস্তার কমিয়ে দিতে পারে। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে ক্ষত সৃষ্টির হার কমে যায়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ন্যানো ডেন্টিস্ট্রিই হবে ভবিষ্যতের মূল দন্ত চিকিত্সা। এই পদ্ধতিতে ন্যানো কণিকা ব্যবহারের পাশাপাশি ডেন্টাল হাইজেনিস্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট ও টেকনিশিয়ানদের ভূমিকা পালন করবে কার্বন ‘ন্যানো রোবট’। ভবিষ্যতের এই রোবটগুলো আকৃতিতে ১০০ ন্যানো মিটারের কাছাকাছি হবে। এরা কাজ করতে পারবে কোষ থেকে শক্তি নিয়ে। কম্পিউটারের সঙ্গে সিগন্যালের মাধ্যমে যুক্ত থাকবে এই রোবটগুলো। ফলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে অনায়াসে।

ভবিষ্যতে দাঁতের চিকিত্সকেরা ডেন্টাল রোবটগুলো ব্যবহার করবেন দাঁত অবশ করতেও। কোলয়ডাল সাসপেনশনে থাকা মিলিয়ন মিলিয়ন ন্যানো রোবট মাড়ির পাশ দিয়ে প্রায় ১০০ সেকেন্ডের মধ্যে দাঁতে ঢুকতে পারবে। তারপর পাল্পে করে দাঁতের কম্পিউটারের নির্দেশ অনুযায়ী দাঁতের স্নায়ুগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সুতরাং দাঁতের চিকিত্সক ও রোগী উভয়ের জন্যই এ ধরনের ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার সুবিধাজনক হবে।

দাঁত শিরশির করার সমস্যা অর্থাৎ ডেন্টিন সেনসিটিভিটিতে কমবেশি সবাই ভোগেন। ডেন্টিন হলো দাঁতের দ্বিতীয় স্তর। ধারণা করা হয়, ডেন্টিন টিউবিউলগুলো নার্ভাস সিস্টেমকে সিগন্যাল পাঠিয়ে উদীপ্ত করে। ফলে দাঁতে শিরশির অনুভূতি হয়। সাধারণ চিকিত্সা পদ্ধতিতে এই অনুভূতি থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু স্থায়ী মুক্তি মেলে না। ন্যানোরোবট ব্যবহার করে শিরশিরে অনুভূতির জন্য দায়ী ডেন্টিন টিউবিউলগুলোকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া যাবে।

অর্থোডেন্টিক ইউনিট আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করার বিষয়টি সমাধান করে। দাঁতের ব্রেইসের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এই পদ্ধতিতে দাঁত সোজা করতে লেগে যায় বছরের পর বছর। দীর্ঘমেয়াদি এই চিকিত্সাপদ্ধতিকে বদলে দিতে পারে ভবিষ্যতের অর্থোডেন্টিক ন্যানো রোবট। এই রোবটগুলো সরাসরি দাঁতের চারপাশের টিস্যু, পেরিওডন্টাল লিগামেন্ট, সিমেন্ট, হাড় ইত্যাদির গঠন বদলে প্রয়োজনমতো দাঁতের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। এভাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করে ফেলতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করছেন দন্ত বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, শিগগিরই ন্যানো টেকনোলজির কল্যাণে দাঁতের সমস্যা শনাক্তকরণ, দাঁত অবশকরণ থেকে শুরু করে দাঁতের সব ধরনের চিকিত্সায় ব্যবহৃত উপাদান এবং অস্ত্রোপচারের আমূল পরিবর্তন আসবে। ন্যানো উপাদান, ন্যানো রোবট, ন্যানো সার্জারি, ন্যানো ওষুধ ইত্যাদির প্রয়োগ দাঁতের চিকিত্সাব্যবস্থাকে নিয়ে যাবে ভিন্ন স্তরে।

লেখক: সহকারী দন্ত চিকিত্সক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য

সূত্র: ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ডেন্টিস্ট্রি

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত