পোকামাকড়ের বর্ষা

১ / ৫
বৃষ্টির জন্য মানুষের কত আকুতি-মিনতি। গান গেয়ে, ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে গ্রামগুলোয় রীতিমতো প্রার্থনার আসর বসানো হয়। একই সময়ে পোকামাকড়েরা হয়তো বিপরীত প্রার্থনায় বসে। কারণ বৃষ্টি তাদের একদমই পছন্দ নয়। আকাশ থেকে নেমে আসা হঠাত্ ঝুমবৃষ্টি তাদের কাছে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ফেলা বোমার মতো, তবে পারমাণবিক বোমা নয়, এ যেন পানির বোমা! আমাদের কাছে যা এক আঁজলা পানি, পোকামাকড়ের কাছে তা যেন মহাসমুদ্র! একপশলা বৃষ্টিই এমন মহাসমুদ্র তৈরির জন্য যথেষ্ট। কী করে তারা এই মহাসমুদ্র পাড়ি দেয়, চলুন জেনে নেওয়া যাক
ডিসকভারিজ
২ / ৫
মৌমাছির মৌচাকের সঙ্গে আমাদের শহরের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের তুলনা করা যায়। অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য যেমন ইন্টারকমের ব্যবস্থা থাকে, মৌচাকে সে রকম ব্যবস্থা থাকলে খুব ভালো হতো। তাহলে দ্রুত বৃষ্টির মতো দুর্যোগের কথা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া যেত, যাতে বৃষ্টিতে কেউ বের না হয়। কারণ বের হলেই সর্বনাশ। বড়সড় বৃষ্টির ফোঁটা ১০০ মিলিগ্রামের একটা মৌমাছির ওপর পড়লে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে সে। ঝিরিঝিরি হালকা বৃষ্টি হলেও রক্ষা নেই। মৌমাছির লোমশ গায়ে আটকা পড়বে ধুলা আর পানির ছিটা। শরীর ভারী হয়ে আর উড়তে পারবে না। তবে পানি যে তাদের জন্য শুধুই অভিশাপ তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু মৌমাছির কাজই হলো উড়ে উড়ে পানি সংগ্রহ করা। মৌচাকের আর্দ্রতা রক্ষার জন্য আর বাচ্চা মৌমাছির পুষ্টির জন্য পানির দরকার। বাচ্চা বড় হওয়ার সময়টাতে বড় মৌমাছিরা গড়ে ২০০ গ্রাম করে পানি বয়ে নিয়ে যায় মৌচাকে।
ডিসকভারিজ
৩ / ৫
পিঁপড়ার চেয়ে ঘাসফড়িং পানিতে বেশ স্বচ্ছন্দ। যদিও এরা পানিতে থাকে না। জলাশয় যেমন চলাফেরার জন্য অসুবিধা, তেমনি ঘাসফড়িংয়ের খাদ্যেরও বেশ সংকট ওখানে; বরং ঘাসের সবুজ রঙের সঙ্গে সবুজরঙা ঘাসফড়িংয়ের দিব্যি দিন কেটে যায়। কিন্তু বর্ষায় সবুজ মাঠঘাটও পানিতে তলিয়ে যায়। তখন কী করে ঘাসফড়িং? সাঁতরে বেড়ায় পানিতে? না, সাঁতার সে জানে না; বরং লাফিয়ে লাফিয়ে পাড়ি দেয় জলাবদ্ধ দীর্ঘ পথ। লাফানোর জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তার পেছনের পায়ের বিশেষ পেশিকে। শক্তিশালী অ্যাথলেটের মতোই হাই জাম্ক, লং জাম্ক দিতে জানে সে। পানি থেকে ৩ ফুট ওপরে উঠে যেতে পারে লাফিয়ে। অলিম্কিকে অংশ নিলে হয়তো মেডেল পেয়ে যেত ঘাসফড়িং! অবশ্য লাফিয়ে মেডেল পাওয়ার সাধ হয়তো তার নেই। কারণ খুব দ্রুত লম্ফঝম্ফ পর্ব শেষ করে শুষ্ক, নিরাপদ স্থানে ফিরে যেতে চায় সে।
ডিসকভারিজ
৪ / ৫
গঙ্গাফড়িংদের তিড়িংবিড়িং একফোঁটা বৃষ্টির পানিতেই শেষ হয়ে যায়। আহা! কত সুন্দর করেই না তারা আপনার বাগান ঘুরে ঘুরে বেড়াত, ঘণ্টায় ৪০ মাইল বেগে! এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যেই এরা দিক পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। এদের সবচেয়ে বড় সম্কদ এদের চোখ! এদের চোখকে আসলে বলে জটিল পুঞ্জাক্ষি। সোজা ভাষায়, অনেকগুলো চোখের সমষ্টি হলো এই জটিল পুঞ্জাক্ষি। প্রায় ৩০ হাজার ছোট ছোট আলাদা ইউনিট দিয়ে তৈরি এক একটি চোখ। এত জটিল চোখের ক্ষমতাও অসাধারণ। আমরা চোখে যতগুলো রং দেখি তার থেকে বেশি রং দেখতে পায় এরা। হালের ক্যামেরাগুলোয় ৩৬০ ডিগ্রি কোণে যে ছবি তোলার চল শুরু হয়েছে, সেই রকম ছবি গঙ্গাফড়িং তার ছোট দুটি পুঞ্জাক্ষি দিয়েই দেখতে পায়! ১৩০ ফুট দূরের কোনো শিকারকেও এরা দেখতে পারে এবং প্রবল গতিতে শিকারের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলে! তবে বৃষ্টি এলে গঙ্গাফড়িংয়ের শিকারেরা একটু নিশ্চিন্তে জিরিয়ে নিতে পারে। কারণ বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাই ফড়িংয়ের হাই রেজল্যুশনের চোখ দুুটিকে কাবু করতে যথেষ্ট। পানির সংস্কর্শে এরা অন্ধপ্রায়! শিকারকে তো খুঁজেই পায় না; বরং নিজেই অন্য কোনো প্রাণীর শিকারে পরিণত হয়। গঙ্গাফড়িংয়ের ইংরেজি নাম কিন্তু ড্রাগন ফ্লাই। নামের সার্থকতা রাখতেই হয়তো বৃষ্টি থেকে অন্ধ ফড়িংকে উদ্ধারের জন্য প্রকৃতি একটা ব্যবস্থা রেখেছে। বৃষ্টি এলেই যেমন গাড়ির গোটানো উইন্ডশিল্ড বের হয়ে আসে, তেমনি ড্রাগন ফ্লাইয়ের মাথার কাছে গোটানো থাকে এক জোড়া কাঁটাযুক্ত পা। চোখে পানি পড়লেই ওই পা জোড়া মেলে দিয়ে পানি পরিষ্কার করে নিতে পারে।
ডিসকভারিজ
৫ / ৫
তেলে-জলে যেমন মেশে না, পিঁপড়া আর জলেও তেমনি মেশে না। পানিকে এরা বড় ভয় পায়। সাধারণত পিঁপড়াদের দল বেঁধে থাকতেই দেখা যায়, বৃষ্টির সময় এই দলীয় বন্ধন আরও জোরদার হয়। এ সময় তারা একে অপরের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সেতুবন্ধ তৈরি করে। মানবন্ধনের মতো পিঁপড়াবন্ধন! এভাবে একত্র হয়ে নিজেদের রক্ষা করে। কিন্তু চলার পথে আর কোনো পিঁপড়াকে কাছে না পেলে? ডাক শুনে কেউ না এলে একলা তো চলতেই হবে। এ ক্ষেত্রে পানিই বরং পিঁপড়াকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। পানির ঢল নেমে না এলে শুধু স্থির পানির ওপর হেঁটেই চলাচল করতে পারে পিঁপড়া, পানির পৃষ্ঠটান এ ক্ষেত্রে সাহায্য করে। আরও সাহায্য করে পিঁপড়ার পানিরোধী পা আর কম ওজন। তবে তাপমাত্রা একটু বেশি হলেই বিপদ, তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই পানির পৃষ্ঠটান কমে আসবে, পিঁপড়াও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে পানিতে। তবে ডুবসাঁতার দিয়েও পিঁপড়া বেঁচে থাকতে পারে অনেকক্ষণ। কতক্ষণ? যতক্ষণ পর্যন্ত এর ট্রাকিয়া বাতাস ধরে রাখতে পারবে। ট্রাকিয়া পিঁপড়ার শ্বসন অঙ্গ, ঠিক যেমন আমাদের ফুসফুস। নাকের ছিদ্র দিয়ে যেমন আমরা অক্সিজেন নিই, পিঁপড়াদের শরীরেও তেমন ছিদ্র আছে, নাম স্কাইরাকল। এই স্কাইরাকল খুব ছোট, প্রায় ১ মিলিমিটারের হাজার ভাগের এক ভাগ। ছিদ্রগুলো ছোট হওয়ার সুবিধা হলো খুব বেশি পানি চট করেই শরীরে ঢুকতে পারে না। আবার পিঁপড়ার শরীরে খুব দ্রুত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না, কয়েক ঘণ্টা এরা শ্বাস আটকে রাখতে পারে। এর মধ্যে পানির ধারা পার হয়ে শুকনো জায়গায় চলে আসতে পারলেই হলো, আর ডুবে মরার আশঙ্কা নেই। তবে আকারে বড় পিঁপড়াদের ডুবে মরার আশঙ্কা কিন্তু বেশ। এদের শরীর বড়, শরীরে অক্সিজেনের অনেক বেশি ও দ্রুত দরকার পড়ে। তাই বেশিক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে পারে না। আবার স্কাইরাকলের আকার অনেক বড়, সহজেই বেশি পানি ঢুকে পড়ে। পানির স্রোতের কাছে বড় সাইজের পিঁপড়াই হার মানে বেশি।
ডিসকভারিজ