প্রাণের বর্ণমালা

জীব মানে বুঝি যার জীবন আছে। যার জীবন আছে সে সাধারণত চলাফেরা করতে পারে। আবার চলতে-ফিরতে পারে না এমন জীবও আছে। যেমন গাছ। গাছের প্রাণ আছে কিন্তু চলাফেরা নেই। কিছু জীব আছে অনেক ছোট। এত ছোট যে খালি চোখেই দেখা যায় না। যেমন ব্যাকটেরিয়া। এরা মাত্র একটা কোষ দিয়ে তৈরি। তবে জীবের প্রায় সব বৈশিষ্ট্য এদের আছে। এর চেয়েও ছোট জীব আছে যার কোনো কোষীয় গঠন নেই, তবে জীবের বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন ভাইরাস। এত ছোট যে জীবের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এদের নেই। কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের জীব বলা হয়। এদের বংশবিস্তার করার ক্ষমতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে এরা জড়ের মতো আচরণ করে। দীর্ঘ সময় নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে। কোনো বাহক পেলেই অমনি সে নিজের চরিত্র বদলে ফেলে জীবের রূপ ধরে।

মোটামুটিভাবে সব জীবের দেহ গঠনে একটা জিনিস দেখা হয়-প্রতিটি জীবদেহে সেই জীবন গঠনের অণু রয়েছে। কারও অনেক, কারও কম। এর ওপর নির্ভর করে একেক জীব একেক রকম। কেউ বড়, কেউ ক্ষুদ্র, কেউ পানিতে থাকে বা কেউ স্থলে। বিজ্ঞানীরা এই ক্ষুদ্র অণুর নাম দিয়েছেন ডিএনএ। সামান্য কিছু অনুন্নত জীবের দেহে ডিএনএ'র বদলে শুধু আরএনএ থাকে।

কিন্তু এই ডিএনএ আসলে কী? ডিএনএ হলো নিউক্লিক অ্যাসিড থেকে তৈরি হয় একধরনের রাসায়নিক যৌগ। একের পর এক নিউক্লিক অ্যাসিডের অণু যুক্ত হয়ে বিশাল ডিএনএ চেইন তৈরি করে। এই ডিএনএ চেইন জীবের দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশের সব সংকেত বহন করে। যেমন একজন মানুষ ছেলে হবে না মেয়ে হবে সে তথ্য ডিএনএর নকশাতেই থাকে। কোনো জীবের ডিএনএর নকশার সঙ্গে অন্য কোনো জীবের ডিএনএর নকশার মিল থাকে না। কিন্তু ডিএনএর গঠনপদ্ধতি সব জীবের একই রকম।

ব্যাপারটাকে একটু সহজ করা যাক। আমাদের বাংলা বর্ণমালায় ৫০টি বর্ণ রয়েছে। এই ৫০টি বর্ণ দিয়ে আমরা কতগুলো শব্দ লিখতে পারি? অনেক। বাংলা ভাষায় যত শব্দ আছে সব। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর সব শব্দও লেখা সম্ভব। আবার মাত্র ১০টি অঙ্ক দিয়ে যত ইচ্ছা সংখ্যা লেখা যায়। ডিএনএ'র ব্যাপারটিও তাই। এটা আসলে প্রাণের বর্ণমালা। এই বর্ণমালা সাজিয়ে জীবন গঠন করা যায়।

ডিএনএ বর্ণমালায় মাত্র চারটি অক্ষর A, T, C, G। এই চারটি অক্ষর দিয়েই সাজানো সব জীবের জীবনের নকশা। প্রক্রিয়ায় প্রথমে ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরি হয়। এক কোড থেকে আরেক কোড। আরএনএতেও চারটি অক্ষর (UCAG)। এবার এই চারটি অক্ষর থেকে প্রত্যেকবার তিনটি করে নিয়ে প্রথমে ৬৪টি আলাদা সংকেত (একে কোডন বলে) তৈরি করে। আর এই ৬৪টি কোডন সংকেত দিয়ে সে মূলত ২২ ধরনের পৃথক অর্থ বোঝায়। মানে একই অর্থ বোঝাতে একের অধিক সংকেত। নিচে ৪টি আরএনএ থেকে ৬৪টি কোডন সংকেত তৈরি।

এভাবে জীবনের শব্দ রচনা করে ডিএনএ। তাই প্রাণের ভাষা জানতে ডিএনএ অক্ষর চিনতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আমরা এখন খুব সহজেই এই ডিএনএ পড়তে পারি। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা পাটের জিনোম আবিষ্কার করেছেন। আসলে পাটের ডিএনএ পড়েছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা। এভাবেই চেষ্টা চলছে শত প্রাণের ডিএনএর কোড পড়ার চেষ্টা।

লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়