বন্ধু ভাইরাস!

ভাইরাস হলো প্রোটিনের খোলসে বন্দী এক টুকরো ডিএনএ অথবা আরএনএ, যাদের জীব বা জড় কোনোটাই বলা যায় না। হেপাটাইটিস, হাম, পক্স, পোলিও, এইচআইভি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, নিপাহ, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি নানা নামের ভাইরাসের ত্রাসে আমরা সবাই আতঙ্কিত। আমরা সবাই চাই জগতের সব ভাইরাস নিপাত যাক এবং আমরা রোগ-জরামুক্ত পৃথিবীতে নিঃশঙ্কচিত্তে বসবাস করি। কিন্তু জগতের সব ভাইরাসই কি আমাদের শত্রু? এমন কি কোনো ভাইরাস নেই, যাকে আমরা বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করতে পারি? কিছুদিন আগে আমরা জেনেছি ভাইরাস দিয়ে ক্যানসার দমনের বাস্তবিক প্রয়োগের কথা। এটি নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের একটি বড় আবিষ্কার। তবে এ রকম আর কি কোনো প্রয়োগ আছে ভাইরাসের?

ভাইরাস সাধারণত হোস্ট স্পেসিফিক হয়। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট ভাইরাস সুনির্দিষ্টভাবে একধরনের প্রাণী অথবা অণুজীবকে আক্রমণ করে। আর হোস্ট স্পেসিফিসিটি বৈশিষ্ট্যটিকে বিজ্ঞানীরা কাজে লাগাতে পারেন মানবকল্যাণে। বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার ২০৪ বছর আগে গরুর দেহে রোগ সৃষ্টিকারী কাউ-পক্স ভাইরাস কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছিলেন মানুষের স্মল-পক্স ভাইরাসের ভ্যাকসিন। বলা যেতে পারে, ভাইরাস নিয়ে আশাব্যঞ্জক গবেষণার শুরু সেটাই। পরবর্তী সময়ে ল্যাবরেটরিতে ভাইরাসদের চেহারা বদলে হাম, পোলিও ইত্যাদি ভাইরাসের ভ্যাকসিনও আবিষ্কৃত হয়েছে। আবার শুধু ভাইরাসের প্রোটিনকে কাজে লাগিয়েও ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা যেতে পারে, যেমনটা বিজ্ঞানীরা করেছেন হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে। অর্থাত্ রোগ সৃষ্টিকারী একটি ভাইরাস দমন করার মূল হাতিয়ার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই ভাইরাসকে বশ মানিয়ে অথবা কাজে লাগিয়েই প্রস্তুত করা হয়।

মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য সব প্রাণী, উদ্ভিদ এমনকি বিভিন্ন অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি) সবাই তাদের নিজেদের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। সুতরাং রোগ সৃষ্টিকারী ও ক্ষতিকর বিভিন্ন অণুজীবদের/জীবাণুদের দমন করতে ভাইরাসদের কাজে লাগানো যেতে পারে। লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিনেস নামক জীবাণু মারাত্মক রকমের খাদ্যজনিত অসুস্থতার (Food-borne illness) জন্য দায়ী। আবার ইয়ারসেনিয়া পেসটিস নামক জীবাণু ভয়ংকর প্লেগ রোগের কারণ। উভয় জীবাণুই প্রাথমিকভাবে ইঁদুরের শরীরে বিস্তার লাভ করে এবং ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ইঁদুরের শরীরে মিউরিন-গামা-হারপিস-ভাইরাস-৬৮ প্রবেশ করিয়ে পরিবেশে লিস্টেরিয়া বা ইয়ারসেনিয়ার সংক্রমণ ও বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার দরুন ইঁদুরগুলোর শরীরে প্রতিরোধ কোষগুলো সজীব হয়ে ওঠে। ফলে ইঁদুরগুলোর শরীরে লিস্টেরিয়া বা ইয়ারসেনিয়ার সংক্রমণ আর সফল হয়ে ওঠে না। অন্য আরেক গবেষণায় ইঁদুরকে লিম্ফোট্রপিক ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করে তাঁর শরীরে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের নিরাময় সম্ভব হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায়, সঠিক গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও অনেক অসুখের প্রতিষেধক আমরা পেতে পারি বিভিন্ন ভাইরাস থেকে।

এসব গবেষণানির্ভর প্রয়োগের বাইরেও যুগ যুগ ধরে অনেক ভাইরাস দিয়ে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী উপকৃত হয়ে আসছে। সেটা সম্ভব হয়েছে মিথস্ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে দুই বা তার অধিক সংখ্যক জীব বা অণুজীব পরিবেশে আরও ভালোভাবে খাপ খাইয়ে থাকার তাগিদে একে অন্যকে প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণ দেয়। এভাবে যুগের পর যুগ সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের আর আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। যেমনটা ধারণা করা হয় যে কোষের শক্তির আধার নামে পরিচিত প্রাণিকোষের ভেতরের মাইটোকন্ড্রিয়া, যা কোনো এক সময় একটি একক বিচ্ছিন্ন আদিকোষ বা ব্যাকটেরিয়া ছিল। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের আদিকোষ, আধুনিক কোষ কিংবা উদ্ভিদ ও প্রাণীর শরীরে ঢুকে পড়ে সহাবস্থান করছে নানা রকম ভাইরাস। তবে ভাইরাস সহাবস্থানের বিষয়টা অবশ্য ঘটে জিনোমিক লেভেলে। অর্থাত্ কোষে অণুপ্রবেশকারী ভাইরাসের ডিএনএ কোষের ডিএনএর মধ্য ঢুকে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে এই মিথস্ক্রিয়া এতটাই প্রাচীন যে কোনটি কোষের নিজস্ব ডিএনএ আর কোনটি ভাইরাসের ডিএনএ, সেটা আলাদা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় সব আধুনিক কোষের মধ্যে রেট্রো-ভাইরাসের ডিএনএ রয়েছে সম্পূর্ণ অথবা খণ্ডিত অবস্থায়।

শুনতে আশ্চর্য হলেও সত্য যে প্রায় ৮ শতাংশ মানুষের ডিএনএ এসেছে কোনো না কোনো রেট্রো-ভাইরাস থেকে। প্রাণিকোষের ডিএনএ লেভেলে এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে রেট্রো-ভাইরাসদের প্রবেশ করতে হয় ভ্রূণকোষের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে সেই ভ্রূণকোষ থেকে যখন অন্যান্য কোষ গঠিত হয়, তখন সব কোষের মধ্যেই ভাইরাসটির ডিএনএ পরিচালিত হয়। ফলে সৃষ্ট নতুন কোষগুলো বহন করে ওই রেট্রো-ভাইরাসের ডিএনএ, যা কোষটিকে প্রদান করতে পারে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের কোয়ালারা ‘কে-ও-আর-ভি’ ভাইরাস আত্তীকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ওই ভাইরাস দ্বারা নিজেদের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পেরেছে। অন্যদিকে মধ্য বা উত্তর-অঞ্চলের কোয়ালারা ‘কে-ও-আর-ভি’ ভাইরাস আত্তীকরণ করতে না পারায় অসুস্থ হয় ওই ভাইরাস দ্বারা। শুধু প্রাণিদেহে নয়, উদ্ভিদদেহেও ভাইরাসের এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার প্রভাব দেখা যায়। এতে পরিবেশে কোনো কোনো উদ্ভিদকে অপেক্ষাকৃত প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

কিছু ভাইরাস আবার নিজেরা প্রাণিদেহে অসুখ সৃষ্টি করে অন্যান্য বড় অসুখের হাত থেকে প্রাণীদের রক্ষা করতে পারে। দীর্ঘকালের গবেষণায় দেখা গেছে, হেপাটাইটিস-জি ভাইরাসে আক্রান্ত এইডস রোগীদের মধ্যে এইডস রোগের তীব্রতা অন্যান্য রোগী, যারা হেপাটাইটিস-জি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত নয়, তাদের থেকে বহুলাংশে কম। আবার হেপাটাইটিস-এ ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর লিভারে নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট রোগের প্রবণতা অনেক কমে যায়। এসব ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর একটি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার দরুন শরীরে আরেকটি বেশি ক্ষতিকর ভাইরাসের বিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়।

ভাইরাসবিষয়ক গবেষণার একদিকে যেমন বিজ্ঞানীরা আমাদের নিত্যনতুন ভ্যাকসিন উপহার দিয়ে থাকেন, ঠিক অন্যদিকে ডিএনএ পর্যায়ে জীবের উত্পত্তি, গঠন, বিকাশ সম্পর্কে আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানকে প্রসারিত করে। এসব জ্ঞান আমাদের বেঁচে থাকাকে সুন্দর করে আর আমাদের আমাদের চারপাশের পরিবেশের প্রতি করে তোলে সহনশীল ও সচেতন।

লেখক: গবেষক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য

সূত্র: Nature Reviews Microbiology

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত