ভেলক্রো

ভেলক্রো জিনিসটা আমরা প্রায় সবাই প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ব্যবহার করি। যারা পেছনে বেল্টওয়ালা জুতা পরে, পেছন থেকে বেল্টটা এনে একটা নাইলনের স্ট্র্যাপের ওপর যে আরেকটা স্ট্র্যাপ চাপ দিয়ে বসিয়ে দিই, এই স্ট্র্যাপ দুটোকে একসঙ্গে হুক অ্যান্ড লুপ ফাস্টেনার বলে। ভেলক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এই ফাস্টেনারগুলো ১৯৫০-এর দশক থেকে তৈরি করে আসছে বলে সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ভেলক্রো নামেই বেশি পরিচিত। আমরা যে জুতা পরি, সেই জুতায়, ব্যাগে, জ্যাকেটে, নানা ধরনের জামায়—অনেক জায়গাতেই ভেলক্রো ব্যবহার করা হয়। এসবই তো বোঝা গেল, কিন্তু এই জিনিসটা আসলে কীভাবে কাজ করে, এই প্রশ্নটা কি কখনো মাথায় এসেছে?

ভেলক্রো আবিষ্কারের কাহিনিটা মজার। ১৯৪১ সালে সুইডিশ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ ডি মিস্ট্রাল তাঁর কুকুরটা সঙ্গে নিয়ে আল্পস পর্বতমালায় শিকারে যান। ফিরে আসার পর তিনি তাঁর জামা ও কুকুরের গায়ের পশমে বার্ডক নামে একধরনের গাছ থেকে লাগা কাঁটা দেখতে পান। সেগুলো তুলে ফেলার সময় তাঁর মাথায় চিন্তা এল, এই কাঁটাগুলো এভাবে জামায় কিংবা পশমে লেগে গেল কেন! তিনি মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন, গাছ থেকে লাগা কাঁটাগুলো একধরনের হুক বা আংটার মতো কাজ করছে। আর জামা, কুকুরের গায়ের পশম কাজ করছে লুপের মতো, যে লুপে হুকগুলো আটকে গেছে। এটা দেখে ডি মিস্ট্রালের মাথায় চিন্তা এল, তিনি হয়তো বাস্তবে এমন একটা সিস্টেম তৈরি করতে পারবেন। এখানে দুটো জিনিস, একটা আরেকটার বিপরীতে থেকে আটকে থাকবে, ঠিক ওই হুক আর লুপের মতো। শুধু তাঁকে সে জন্য কৃত্রিমভাবে হুক আর লুপ তৈরি করতে পারতে হবে।

তিনি তাঁর আইডিয়াটা নিয়ে ফ্রান্সের লিয়নে গেলেন। লিয়ন তখন বুননশিল্পের কেন্দ্র ছিল। সেখানে তিনি একজন বুনন-কারিগরকে পেয়ে গেলেন, যিনি ডি মিস্ট্রালের আইডিয়া অনুযায়ী তাঁকে দুটো সুতার তৈরি স্ট্রিপ তৈরি করে দিলেন, যেগুলো হুক আর লুপের সাহায্যে একটা অন্যটার বিপরীতে আটকে থাকবে। সমস্যা হচ্ছে সুতা খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে গেল। তিনি এরপর সিনথেটিক দিয়ে চেষ্টা চালাতে লাগলেন এবং অনেকবার চেষ্টার পর তিনি নাইলন দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিকমতো হুক তৈরি করতে পারলেন। নাইলন দিয়ে লুপ বানানোর কাজটা তখনো বাকি ছিল। তিনি কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে নাইলন দিয়ে লুপ বানালে এমনিতে সেটা লুপের আকৃতিতে থাকতে চায় না, কিন্তু তাপ দেওয়ার মাধ্যমে নাইলনের তৈরি লুপকে স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়া সম্ভব। তিনি সেটাই করলেন (আমরা কিন্তু এখন জানি, আগুনে নাইলনকে পোড়ালে পোড়া অংশটুকু নির্দিষ্ট আকৃতিতে বাঁকা হয়ে থাকে)। এভাবে লুপ তৈরি তো ঠিকই করা গেল। কিন্তু সমস্যাও একটা দেখা দিল। সেটা হচ্ছে লুপগুলোকে ঠিক জায়গামতো কাটতে হতো, যাতে পুরো জিনিসটাকে অনেক অনেকবার ব্যবহার করা যায়।

এ ব্যাপারটা নিয়ে ডি মিস্ট্রাল যখন হতাশ হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর মাথায় আরেকটা নতুন আইডিয়া এল। তিনি একজোড়া লুপের স্ট্রিপ নিলেন, তারপর কাঁচি দিয়ে একটা স্ট্রিপের লুপের মাথাগুলো কেটে ফেলে দিলেন। এতে পারফেক্ট হুক পাওয়া গেল, যে হুকগুলো কিনা লুপের সঙ্গে ঠিকমতো আটকে থাকবে। পুরো কাজটা করতে তাঁর সময় লেগেছে ১০ বছর! হ্যাঁ, গবেষণা কিন্তু এক দিনে শেষ হয় না!

১৯৫১ সালে জর্জ ডি মিস্ট্রাল তাঁর আইডিয়াটার জন্য সুইজারল্যান্ডে প্যাটেন্টের আবেদন জমা দেন, ১৯৫৫ সালে তিনি প্যাটেন্ট পান। এর পরপরই ভেলক্রোর চাহিদা বেশ বেড়ে যায় এবং ডি মিস্ট্রাল বাণিজ্যিকভাবে ভেলক্রোর উত্পাদন শুরু করেন। প্যাটেন্ট পাওয়ার পর তিনি জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশে ভেলক্রোর দোকান শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভেলক্রো বিক্রি করা শুরু করেন।

বেশ কিছু পরিবর্তন ও উন্নতির পর ভেলক্রোর প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যবহার শুরু হয় অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে। নভোচারীরা তাঁদের বড়সড় স্পেস স্যুটে যাতে সহজে ঢুকতে এবং বের হতে পারেন, সে জন্য স্যুটে ভেলক্রো ব্যবহার করা শুরু হয়।

নিচের ছবিতে একটা মাইক্রোস্কোপের নিচে ভেলক্রোর হুক ও লুপ দেখতে কেমন লাগে, সেটা দেখানো হয়েছে। কোনটা হুক আর কোনগুলো লুপ, সেটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত