মানবজাতির জীবনবিমা

রওয়ের এক শহর এসভালবার্দ। মানববসতি থাকা শহরগুলোর মধ্যে এসভালবার্দই ভৌগোলিকভাবে উত্তর মেরুর সবচেয়ে কাছের শহর। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই শহর ও তার চারপাশে পদার্থবিজ্ঞান, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ববিদ্যা ইত্যাদি নিয়ে অনেক গবেষণা চালানো হয়। এককালে তিমি শিকারের কেন্দ্র এই শহর তাই আধুনিক যুগের গবেষকদের এক তীর্থস্থান। গবেষক ও অরোরা বোরিয়ালিস দেখতে আসা ট্যুরিস্ট সবাই স্থানীয় অর্থনীতির এক বড় চালিকাশক্তি।

অনেক দেশের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে এসভালবার্দে। তবে একটা বিশেষ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার কারণে এসভালবার্দ মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তার আগে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। সভ্যতার সবচেয়ে বড় ভিত্তি কী বলে মনে হয় আপনার কাছে? কী না থাকলে সভ্যতা একদমই সম্ভব হতো না?

খাদ্য। শুধু খাদ্য নয়, বিপুল পরিমাণে উদ্বৃত্ত খাদ্য। মোট কথা কৃষিবিপ্লব ছাড়া সভ্যতা একদমই সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান সভ্যতা এতটা সফল কারণ আমাদের ফসল উত্পাদনের হার অনেক বেশি। এত বেশি পরিমাণে আমরা ফসল উত্পাদন করি যে অনাহারে যত মানুষ মরে, তার চেয়ে বেশি মানুষ স্থূলতা-সম্পর্কিত রোগ থেকে মারা যায়। আমাদের কৃষিব্যবস্থার এই অভূতপূর্ব উত্পাদন ক্ষমতার পেছনে আছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। যেমন উচ্চফলনশীল ও সহনশীল জাতের ফসল, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, সস্তা রাসায়নিক সার, আধুনিক যন্ত্র ইত্যাদি।

কিন্তু আমাদের কৃষিব্যবস্থা আজও যথেষ্ট উন্নত নয়। নতুন রোগ-বালাই, আবহাওয়া পরিবর্তন, দুর্যোগ এসব কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়। অত্যধিক পরিমাণে কীটনাশক, রাসায়নিক সার ব্যবহারও পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে। এই ব্যবস্থাকে উন্নত করতে গেলে যে কাঁচামাল দরকার তা হলো বৈচিত্র্য। কেমন? ধরুন আপনি বন্যায় নষ্ট হবে না এমন উচ্চফলনশীল জাতের ধান চান। আপনি এটা পেতে পারেন দেশি জাতের বন্যাসহিঞ্চু ধানের (যার উত্পাদনক্ষমতা কম হয়তো) সঙ্গে উচ্চফলনশীল জাতের ধানের সংকরায়ণ ঘটিয়ে। এমনকি জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে এটা করতে হলেও তাদের বন্যাসহিষ্ণুতার জন্য দায়ী জিনকে শনাক্ত করে আলাদা করতে হবে। এ কারণেই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে এমন শক্তিশালী কৃষিব্যবস্থার জন্য ভীষণ দরকার নানা জাতের ফসল সংরক্ষণ করে রাখা।

কষ্টের কথা আসবে এখন। বাংলাদেশ বিখ্যাত ছিল এর নানা জাতের আম ও ধানের কারণে। এর বেশির ভাগই অযত্নে আজ পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গেছে। ঠিক আমাদের মসলিনের ঐতিহ্যের মতো। মসলিন হয়তো ভবিষ্যতে কোনোভাবে তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু একবার কোনো ফসলের জাত হারিয়ে গেলে তা আর কোনোভাবেই ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না।

বাংলাদেশে মূলত চাষ হয় এখন গুটিকয়েক ধানের জাত। শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বজুড়েই আমরা খুব কম জাত ও প্রজাতির ফসলের ওপর ভরসা করি (প্রজাতি ও জাত আলাদা। যেমন ধান একটা প্রজাতির ফসল, তবে ধানের নানা জাত থাকতে পারে যেমন নাজিরশাইল, কালিজিরা ইত্যাদি)। পৃথিবীর দেড় বিলিয়ন হেক্টর চাষাবাদযোগ্য কৃষিজমির এক বিলিয়ন হেক্টরজুড়ে আছে মাত্র ৪০ প্রজাতির ফসল। ঠিক এ কারণেই আমাদের কৃষিব্যবস্থা দুর্বল। কোনো কারণে এক প্রজাতি বা জাতের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী রোগ ছড়িয়ে পড়লে ওই প্রজাতিটি চাষ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। এর আদর্শ উদাহরণ হলো ক্যাভেন্ডিশ জাতের কলা।

সাগরকলা বলে যে কলাকে আমরা চিনি, তাই হলো ক্যাভেন্ডিশ জাতের কলা। কলা বর্তমানে পৃথিবীর চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ফসল। গম, ধান, ভুট্টার পরই কলার অবস্থান। বার্ষিক ১০০ বিলিয়নেরও বেশি কলা আমরা খাই! ১০০ বিলিয়ন! এবং এর বেশির ভাগই ক্যাভেন্ডিশ কলা। এই জাত জনপ্রিয় হয় ১৯৫০ সালের পর থেকেই, যখন পানামা রোগে গ্রস মিশেল জাতের কলাগুলো খুব সহজে আক্রান্ত হতো।

চাষিরা তখন ক্যাভেন্ডিশ জাতের দিকে ঝুঁকে পড়ল। তবে পানামা রোগও নিশ্চুপ হয়ে রইল না। পানামা রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের একটা জাত ক্যাভেন্ডিশ কলাকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা লাভ করল এবং ধীরে ধীরে পানামা রোগ আবার ছড়িয়ে পড়ল ক্যাভেন্ডিশ জাতের কলার মধ্যে।

অনেক টাকার ক্ষয়ক্ষতি আবার হতে লাগল। আমার মনে হয় না আর বেশি দিন এই জাতের কলা দেখব, আবার অন্য কোনো জাত চলে আসবে। বাস্তবতা হলো আবহাওয়া পরিবর্তিত হবে, নতুন নতুন রোগ-বালাই আসবে। অনেক জাতের ফসল অকেজো হয়ে পড়বে। তখন নতুন জাতের ফসল লাগবে। প্রকৃতি এমনই। এ জন্যই দরকার বৈচিত্র্যময় জাতের ফসলের। নানা জাতের ফসল চাষ করা না হলেও সংরক্ষণ করে রাখতে হবে অন্তত। যেন পরে দরকারে সেগুলোকে পাওয়া যায়।

এত কথায় হয়তো এসভালবার্দ কী তাই ভুলে গেছেন! এই এসভালবার্দ শহরটা কৃষিব্যবস্থার জন্য, সভ্যতার জন্য, সুতরাং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটামাত্র স্থাপনার কারণে। পর্বত খুঁড়ে বানানো এই স্থাপনাটি হলো এসভালবার্দ বৈশ্বিক বীজ সংরক্ষণাগার। নরওয়ের সরকার, নর্ডিক জেনেটিক রিসোর্স সেন্টার (নর্ডজেন) ও ক্রপ ট্রাস্ট যৌথভাবে এই সংরক্ষণাগারের রক্ষণাবেক্ষণ করে। এখানে পৃথিবীর যেকোনো দেশ ও সংস্থা তাদের বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। প্রতিটা নমুনা ব্যাগে এক জাতের ৫০০টি বীজ থাকতে পারে এবং এমন ৪৫ লাখ নমুনা সংরক্ষণ করা যেতে পারে এখানে। কিন্তু এমন বীজ সংরক্ষণাগার তো আরও আছেই। এটা নিয়ে এত মাতামাতি কেন?

কারণ হলো এসভালবার্দের অবস্থান ও উদ্দেশ্য। এটা উত্তর মেরুর খুব কাছে। সুতরাং রেফ্রিজারেশনের জন্য বেশি শক্তি খরচ করতে হয় না। এখানের তাপমাত্রা এমনিতেই ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোনো সমস্যা হলেও এসভালবার্দের বীজ সংরক্ষণাগারটির আসল পরিচয় আমাদের কৃষিব্যবস্থার ব্যাকআপ। সারা পৃথিবীর সব বীজ সংরক্ষণাগার তাদের নমুনা এখানে সংরক্ষিত করে রাখে। যেন কোনো কারণে ওই সংরক্ষণাগারের ক্ষতি হলেও বীজগুলো টিকে থাকে।

সাম্প্রতিক সিরিয়া যুদ্ধে আলেপ্পো শহরের ধ্বংসের সঙ্গে ওখানে থাকা ওঈঅজউঅ-এর বীজ সংরক্ষণাগারও নষ্ট হয়ে গেছে। ওঈঅজউঅ মরুজ পরিবেশে জন্মানো বিভিন্ন ফসল ও গাছ জোগাড় করে সংরক্ষণ করে। তাদের সংরক্ষিত এই বীজগুলো ক্রমান্বয়ে উষ্ণ হতে থাকা পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য খুবই দরকারি! তবে সৌভাগ্যের বিষয় ওঈঅজউঅ তাদের বীজগুলোর নমুনা এসভালবার্দ বীজ সংরক্ষণাগারে রেখেছিল। এভাবেই মরু পরিবেশে জন্মানো অনেক ফসল বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেল।

এই স্থাপনাটি নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের পরের তেজস্ক্রিয়তাতেও ঠিকমতো কাজ করবে। এখানে কোনো পানি ঢুকতে পারবে না। বীজগুলোকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা হয়। কোনো কারণে মানুষ এই সংরক্ষণাগার চালাতে না পারলেও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সব বীজ টিকে থাকবে অনায়াসে। বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা যখন রাজনৈতিক কারণে বেড়ে চলেছে, তখন এই সংরক্ষণাগারের প্রয়োজনীয়তা আরও অনুভূত হচ্ছে। এখানে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের বীজই এক তাকে রাখা। ট্রাম্প বা কিম জং উন মিলে নিজেদের দেশকে ধ্বংস করে ফেললেও দেশগুলোয় জন্মানো ফসলগুলো দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হবে না। তবে বীজ টিকে থাকবে জানার পরও চিন্তাটা তত সুখপ্রদ নয়!

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়