মূক তুমি মুখরা

প্রবাদ আছে, লোকমান হেকিম নামে এক কবিরাজ গাছেদের সঙ্গে কথা বলতেন। কথা হতো মানুষের ভাষাতেই। গাছেরা নিজেদের গুণাগুণ নিজেরাই হেকিমকে বর্ণনা করত।

গাছে-মানুষে আদৌ কথা বলা সম্ভব কিনা এটা ভাষাবিজ্ঞানের একটা মজার তর্ক হতে পারে। তবে সন্দেহ নেই, চূড়ান্ত জবাব পেতে আমাদেরকে জীববিজ্ঞানেরই দ্বারস্থ হতে হবে। আর এখানেই একটা গোলমাল বেঁধেছে। জীববিজ্ঞানের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, গাছে-মানুষে কথোপকথন অবিশ্বাস্য শোনালেও গাছ একেবারে কথা বলতে পারে না এমন নয়। গাছেরা কথা বলে গাছেদের সঙ্গে। এই কথোপকথন চলে আসছে অনাদিকাল থেকে। সে হিসেবে গাছেরা মূক ও বধির তো নয়ই, বরং তাদেরকে বাচালই বলতে হবে। সারাদিন অনর্গল তারা কথা বলে যাচ্ছে।

আমেরিকার নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যার একটি নিবন্ধ জানাচ্ছে, গাছ কথা বলে বাতাসে গন্ধ ছড়িয়ে। আগে আমরা জানতাম, ফুলের গন্ধ শুকে মধুখোর পতঙ্গেরা ফুল চেনে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, পতঙ্গদের আমন্ত্রণ জানাতেই গাছ কেবল এই গন্ধ ব্যবহার করে না, গন্ধের মাধ্যমে এক গাছ আরেক গাছকে সংকেত পাঠায়। আর এ কাজে গাছেরা অনেক রকম গন্ধের জটিল মিশ্রণ ব্যবহার করে। তাতে একেকটি গন্ধ ‘শব্দ’ হিসেবে ভূমিকা রাখে। এভাবে শব্দে শব্দে মিলিয়ে জটিল বাক্য তৈরি করে গাছ।

ইস্টার্ন ফিনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইকোলজিস্ট জেমস ব্ল্যান্ড বলছেন, যে গাছ এসব গন্ধ ছড়াচ্ছে, আমরা বলতে পারি, সে আসলে ‘কথা বলছে’, আর যে গাছ এই গন্ধ গ্রহণ করছে, সেই গাছ ‘কথা শুনছে’।

কিন্তু এভাবে রাসায়নিক দ্রব্যাদি বিনিময় করে গাছেরা নিজেদের মধ্যে কী কথা বলে? গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গাছেরা বার্তা বিনিময় করে একে অপরকে সতর্ক করে দেয়। এক গাছে কোনো রোগবালাই বা কোনো ক্ষতিকর পতঙ্গের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে গাছ তখন গন্ধ ছড়িয়ে অন্য গাছেদের সাবধান করে দেয়, যাতে তারা সতর্ক ব্যবস্থা নেয়, প্রতিরোধ তৈরি করে।

পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, একটি টমেটো গাছে লেদাপোকার আক্রমণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিভিন্ন গন্ধের একটি জটিল ককটেল বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে। আশপাশের টমেটো গাছগুলি এই বার্তা যে শুনছে, তার প্রমাণ সেগুলো দ্রুত গ্লাইকোসাইড নামে এক ধরনের রাসায়নিক উপকরণ তৈরি করে ফেলছে নিজেদের মধ্যে। বিষাক্ত এই গ্লাইকোসাইডের কারণে লেদাপোকা তখন ওইসব গাছে চড়াও হতে পারছে না।

এ তো গেল শত্রুকে হঠানোর বার্তা। আবার একই পদ্ধতি ব্যবহার করে আক্রান্ত গাছ সাহায্যের জন্য মিত্র পতঙ্গদের কাছে তলব পাঠায়। সয়াবিন গাছে এঁটুলি জাতীয় এক ধরনের পোকার আক্রমণ ঘটলে এই গাছ বাতাসে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক যৌগ ছেড়ে দেয়। গ্রামে ডাকাত পড়লে যেভাবে স্কুলের পিয়ন পাগলা ঘণ্টা বাজায় এও অনেকটা সেরকম। এই গন্ধ শুকে তখন গুবরে পোকারা ছুটে আসে উদ্ধারের জন্য।

এভাবে বার্তা দেওয়া নেওয়া নিত্যই চলছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে বায়ু দূষণ নিয়ে। বায়ু দূষণের কারণে বাতাসে এমন সব উত্কট গন্ধের শোরগোল শুরু হয়ে গেছে, তাতে চাপা পড়ে যেতে শুরু করেছে গাছেদের নিজস্ব ফিসফাস। গাছেরা একে অপরের সঙ্গে আর ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না, পাঠাতে পারছে না সাবধানবাণী। তাতে গাছে গাছে মড়ক দেখা দিচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি কর্কশ আওয়াজ করছে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ওজোন ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের উপস্থিতি। যানবাহন এবং ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মূলত এই দুই রাসায়নিক উপকরণ নির্গত হয়। এই দুই উপকরণই গাছেদের নির্গত রাসায়নিক যৌগগুলোর সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটায়। এটাকে ভাষা দূষণ হিসেবেও দেখা যায়। কেউ যেন প্রেমালাপের মাঝখানে ক্রমাগত ভেংচি কাটছে। কিংবা বলা চলে, কবিতার আসরে এখন খিস্তিখেউর চলছে।

তবে শুধু বাতাসে গন্ধ ছড়িয়েই এভাবে বার্তা লেনদেন করে না গাছ। মাটির তলা দিয়েও করে। ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার অধ্যাপক সুজান সিমার্ড বলছেন, বনের মধ্যে শেকড়বাকড়ে লেপ্টে থাকা ছত্রাক এই বার্তা বয়ে নিয়ে যায়। পুরো বনের মধ্যে এভাবে চলে ছত্রাক লেনদেনের এক বিপুল কারবার। এ যেন মাটির তলায় ইন্টারনেটের সুপারহাইওয়ে।

সেখানেও মাটি দূষণ একটা উত্পাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার। গাছেদের কথা বলতে না দিলে ফসলের উত্পাদন কমে গিয়ে একদিন মানুষেরও কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কী করা যায়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিস্তর ভাবছেন।

কিন্তু আমি ভাবছি অন্য আরেকটা কথা। ভাষার কাজ যদি হয় বার্তা বহন, তাহলে তার দুটি প্রান্ত থাকবে। এক প্রান্তে বার্তা প্রেরক, আরেক প্রান্তে গ্রাহক। প্রেরক বার্তাকে ভাষার সংকেতের মধ্যে পুরে দেয়। আর গ্রাহক সংকেতের খোলস ভেঙ্গে বার্তাটি গ্রহণ করে। গাছের জগতে পুরো প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিকভাবে ঘটছে, বোঝাই যায়। কিন্তু আসলে কতোটা যান্ত্রিকভাবে ঘটে? যেখানে ভাষা আছে, সংকেত পদ্ধতি আছে, বার্তা লেনদেন আছে, সেখানে আরও দুটি জিনিসের উপস্থিতি থাকতেই হবে—একটি হলো অভিপ্রায় (বা বার্তা পাঠানোর পেছনের উদ্দেশ্য), আরেকটি হলো বুদ্ধি বা ইন্টালিজেন্স।

তাই যদি হয়, তাহলে গাছের জগতে বুদ্ধি বা ইন্টালিজেন্স বিরাজ করছে, এটা মানতে হবে। কথা হলো, সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা মগজের উপস্থিতিবিহীন সেই ইন্টালিজেন্সের স্বরূপটি কেমন? দেহের চৌহদ্দির বাইরে যখন বুদ্ধির উপস্থিতি মানতে হয়, সেই বুদ্ধির চূড়ান্ত চৌহদ্দি তখন কোথায় টেনে দেবো? যে বনের মধ্যে শেকড়ে-বাকড়ে-ফুলে-ফলে-পতঙ্গে কথা চলে, সেই বন তো অন্তহীন। কেননা সারা পৃথিবীর সব বনভূমি কোনো না কোনোভাবে পরসপরের সঙ্গে সংযুক্ত। তাহলে কি বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা, সর্বভূতেষু এক অতিকায় বুদ্ধি বা সুপার ইন্টালিজেন্সের কল্পনা আমাদের করতে হবে? যদি করতে হয়, তাহলে এও মানতে হবে, মানুষের ভাষা দিয়ে সেই বুদ্ধির স্বরূপ বোঝা যাবে না। সেটার জন্য একটা ‘অতিভাষা’ বা ‘মহাভাষা’ দরকার হবে।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ২০১৮ সালের মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত