ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তি দিয়েছে যে অণু

প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে তখন। সৈন্যরা মরছে বুলেট ও বোমার আঘাতে। উত্তর ভিয়েতনাম চীনের সমর্থনপুষ্ট। আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম পাচ্ছে আমেরিকার সমর্থন। রাজনৈতিক পেশিশক্তির এই লড়াইয়ে হানা দেয় আরও এক আঘাত। সে মরণ ঘাতকের নাম ম্যালেরিয়া। প্রচলিত ওষুধে সে ম্যালেরিয়া দমন করা যাচ্ছিল না ঠিকভাবে। আমেরিকা দ্রুত উদ্ভাবন করেছে এক ওষুধ। ম্যাফলোকুইন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও ম্যাফলোকুইন দিয়ে বাঁচানো যাচ্ছে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যদের কী হবে? যুদ্ধে তো কোনো মিত্রতা নেই। তাই ম্যাফলোকুইন যাচ্ছে না চীন-সমর্থিত উত্তর ভিয়েতনামে।

ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন ও চীনের প্রধান মাও সে তুং একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যদের বাঁচাতে তাঁরা একত্র হলেন। ম্যালেরিয়ামুক্তির জন্য প্রয়োজন নতুন ওষুধ উদ্ভাবন। মাও সে তুং তাঁর দেশের বিজ্ঞানীদের নির্দেশ দিলেন সমাধান খুঁজে বের করার। সমগ্র চীনে প্রায় পাঁচ শ বিজ্ঞানী নিয়ে গঠিত হলো এক প্রকল্প। যুদ্ধকালে সব প্রকল্প হতে হয় গোপনীয়। সেটিও ব্যতিক্রম ছিল না। সে প্রকল্পের নাম দেওয়া হলো ‘প্রজেক্ট ৫২৩’। কারণ, কাজটা শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের মে মাসের ২৩ তারিখ।

রসায়নবিদেরা হাজারো রাসায়নিক যৌগ পরীক্ষা করছেন। খেটে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। তবে আশানুরূপ ফল মিলছে না। ঠিক সে সময় ৩৯ বছর বয়সের এক নারী ভাবলেন অন্য ভাবনা। প্রচলিত ভেষজ ওষুধ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ভেষজ ওষুধ বিক্রেতাদের কাছে গেলেন তিনি। তথ্য সংগ্রহ করলেন। সংগ্রহ করলেন নমুনা। গ্রন্থাগারে খুঁজতে খুঁজতে পেলেন প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো এক বই। সে অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জ্বর নিরাময়ের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি গাছের নির্যাস প্রচলিত আছে। সে গাছের আঞ্চলিক নাম চিংহাও (Qinghao)। কিন্তু সে নির্যাস সেবনে রোগ নিরাময়ের হার খুবই কম। কারণ, কেউ কখনো জানার চেষ্টা করেনি, সে গাছের নির্যাসে কী কী উপাদান আছে। অজানা এই উপাদান উদ্ঘাটন করতে তিনি গবেষণা শুরু করলেন। সেই দৃঢ় প্রত্যয়ী নারীর নাম টু ইউইউ।

কোনো রোগ নিরাময়ের জন্য আমরা যে উদ্ভিদের নির্যাস সেবন করি, সেখানে শুধু একটি রাসায়নিক যৌগ থাকে না, অনেক রাসায়নিক যৌগের মিশ্রণ থাকে। কিন্তু সে রাসায়নিক যৌগগুলোর মধ্যে একটি যৌগই সাধারণত রোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। রসায়নে সেটাকে বলা হয় কার্যকরী উপাদান বা কার্যকরী যৌগ (Active ingredient)। অনেক যৌগের মিশ্রণ থেকে সেই কার্যকরী যৌগটি পৃথক করে শনাক্ত করা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। ইউইউ নিবিড়ভাবে ডুবে রইলেন সে কাজে। তৈরি করলেন কয়েক শ নমুনা। একটির পর একটি নমুনা পরীক্ষা করতে লাগলেন। সব পরীক্ষার সঠিক পর্যবেক্ষণ করা এবং তথ্য সংগ্রহ করা খুবই শ্রমসাধ্য ও ধৈর্যের কাজ। ইউইউ থামলেন না। তিনি থামতে জানেন না। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে কাজ করছেন তিনি। এখানে হাত গুটিয়ে থাকা যায় না, তাহলে অর্জনের সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যায়। অর্জনের পথটাই যে কণ্টকাকীর্ণ, সেটা তো ইউইউ জানতেন।

অক্লান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে একসময় কাঙ্ক্ষিত যৌগ আলাদা (Isolation) করলেন। নিজের ভাষায় সে যৌগের নাম দিলেন চিংহাওসু (Qinghaosu), অর্থাৎ চিংহাও গাছ থেকে পাওয়া। ইংরেজিতে সে যৌগের প্রচলিত নাম হয়ে গেল আরটিমিসিনিন (Artemisinin) ।

তাঁর গবেষণা ফলাফল প্রথম উপস্থাপন করলেন ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ, নানজিং শহরে। ইঁদুর ও বানরের ওপর সফলভাবে সে যৌগের প্রয়োগ হলো। এবার মানুষের ওপর পরীক্ষার পালা। কিন্তু কে হবে স্বেচ্ছাসেবী? ইউইউ কারও অপেক্ষা করলেন না। নিজেই প্রথম সে ওষুধ খেলেন। বুঝিয়ে দিলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে মানুষের অসীম সাহস লাগে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সৈন্যদের বাঁচাতে যে পরশ পাথরের খোঁজে শত শত বিজ্ঞানী কাজ শুরু করেছিলেন, সে পাথর পাওয়া গিয়েছিল যুদ্ধের শেষের দিকে এসে। কিন্তু তাতে কী! পৃথিবীতে যে আরও অসংখ্য ম্যালেরিয়া রোগী রয়ে গেছে। ম্যালেরিয়ার জীবাণু জাতীয়তাবাদ বোঝে না। চীনা কী জাপানি, ভারতীয় কী ফরাসি চেনে না। যোদ্ধা বা পথহারা-আলাদা করে জানে না। আরটিমিসিনিন আশীর্বাদ হয়ে রইল সমগ্র পৃথিবীর জন্য। সে আবিষ্কার খুলে দিল আরও নতুন নতুন ওষুধ তৈরির পথ।

একটি মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় আর কী পুরস্কার লাগে? ইউইউ নন্দিত হলেন পৃথিবীজুড়ে। অর্জন করলেন বহু সম্মাননা। ২০১৫ সালে পেলেন চিকিত্সাবিজ্ঞানে নোবেল। চীনের প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী তাঁর নাম লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

* অণু ও যৌগ সমার্থক শব্দে ব্যবহৃত হয়েছে।

লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র