সি-টি স্ক্যানিং-এর উদ্ভাবক গডফ্রে হাউন্সফিল্ড

বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের যে উদ্ভাবনগুলি রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সি-টি (Computed Tomography) তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ইন্সটিটিউট অব রেডিওলজির বার্ষিক সম্মেলনে ব্রিটিশ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার গডফ্রে হাউন্সফিল্ড সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে ত্রিমাত্রিক এক্স-রে ইমেজ তৈরি করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম দিয়েছিলেন ‘কম্পিউটারাইজড অ্যাক্সিয়েল ট্রান্সভার্স স্ক্যানিং’ বা ক্যাট (CAT) স্ক্যানিং। সিটি স্ক্যানিং আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন গডফ্রে হাউন্সফিল্ড। আফ্রিকান আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান কোরম্যাকও এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন হাউন্সফিল্ডের সঙ্গে।

ইংল্যান্ডের নটিংহামশায়ারের নিউ আর্কে ১৯১৯ সালের ২৮ আগস্ট গডফ্রে হাউন্সফিল্ডের জন্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বাবা একটি ফার্ম কেনেন যেখানে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট গডফ্রের শৈশব কাটে প্রাকৃতিক পরিবেশে। সবার ছোট হওয়াতে অনেকটাই স্বাধীনতা পেয়েছিলেন নিজের খেয়ালে যা খুশি করার।

শৈশব থেকেই যন্ত্রপাতির প্রতি ভীষণ আগ্রহ জন্মে গডফ্রের। ফার্মে চাষবাসের জন্য অনেক রকমের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ছিল। একেবারে গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে শহুরে বিনোদনের ছিঁটেফোঁটাও সেখানে ছিল না। ফলে হাতে সময় ছিল প্রচুর। সেই সময়টা গডফ্রে কাজে লাগাতেন নানারকমের যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এজন্য একটা ল্যাবও তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা তাঁর। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে নিউআর্ক ম্যাগনাস গ্রামার স্কুলে পড়ার সময় তিনি বৈদ্যুতিক রেকর্ড প্লেয়ার তৈরি করেন ফার্মে তার নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে।

স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে লন্ডনের গিল্ডস কলেজে ভর্তি হলেন রেডিও কমিউনিকেশান নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গডফ্রে রয়েল এয়ারফোর্সে যোগ দেন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত তিনি এয়ারফোর্সে কাজ করতে করতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন। ক্রেনওয়েল রাডার স্কুলে রাডার মেকানিক্স শেখেন তিনি। এরপর সেই স্কুলেই পড়ান কিছুদিন। ১৯৪৫ সালে তাঁকে রয়েল এয়ারফোর্সের সার্টিফিকেট অব মেরিট দেয়া হয়। ১৯৪৬ সালে যুদ্ধশেষে তিনি এয়ারফোর্স ছেড়ে দেন।

এরপর তিনি ভর্তি হন লন্ডনের ফ্যারাডে হাউজ ইলেকট্রক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ১৯৫১ সালে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

পাস করার সঙ্গে সঙ্গে হাউন্সফেল্ড ইংল্যান্ডের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মিউজিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (ই-এম-আই গ্রুপ) গ্রুপে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই এক কোম্পানিতেই তিনি তাঁর কর্মজীবন শেষ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি কোম্পানির মেডিক্যাল সিস্টেম ডিভিশানের হেড হন, ১৯৭৬ সালে চিফ স্টাফ সায়েন্টিস্ট, ১৯৭৭ সালে কোম্পানির সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির সিনিয়র স্টাফ সায়েন্টিস্ট নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ থেকে ২০০৪-এ মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি কোম্পানির পরামর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

সিটি স্ক্যান মেশিন

ইএমআই ল্যাবে হাউন্সফিল্ড প্রথমে কাজ করেন রাডার সিস্টেম নিয়ে। এরপর কাজ শুরু করেন কম্পিউটার ডিজাইন নিয়ে। সেই ১৯৫০ এর দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তি মাত্র শুরু হচ্ছিল। হাউন্সফিল্ডের নেতৃত্বে সেই ১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম ট্রানজিস্টর কম্পিউটার EMIDEC 1100 তৈরি হয়। কম্পিউটার ডাটা স্টোরেজ সিস্টেমের উপর প্রচুর গবেষণা করেন হাউন্সফিল্ড।

১৯৬৭ সালে কম্পিউটারের অটোম্যাটিক প্যাটার্ন রিকগনিশান সংক্রান্ত গবেষণা করার সময় সর্বপ্রথম কম্পিউটেড টমোগ্রাফির প্রথম ধারণা আসে তাঁর মনে। কম্পিউটার আঁকা ছবির বিভিন্ন দিক যদি শনাক্ত করতে পারে, তাহলে এক্স-রের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের গতিপথও শনাক্ত করতে পারবে। সেই ধারণা থেকেই কাজ শুরু করেন তিনি।

তাঁর আগেও অনেকে এরকম কিছু কাজ করেছিলেন। হাউন্সফিল্ডের উদ্ভাবনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ১৯১৭ সালে অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ ইয়োহান র‍্যাডন (Johann Radon) প্রমাণ করেন যে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক কোন বস্তুর অসীম সংখ্যক প্রজেকশান (বা ফালি) থেকে গাণিতিকভাবে বস্তুটিকে পুনর্নির্মাণ (reconstruction) করা যায়।

পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে এই পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী রোনাল্ড ব্রেসওয়েল বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ১৯৫৬ সালে একটি সৌরম্যাপ তৈরি করেছিলেন। আমেরিকান নিউরোলজিস্ট উইলিয়াম হেনরি ওলডেনডর্ফ ১৯৬১ সালে নরম টিস্যুর ত্রিমাত্রিক ইমেজিং-এর মডেল তৈরি করেছিলেন।

১৯৬৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভুত আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান কোরম্যাক টমোগ্রাফির তত্ত্ব এবং ইমেজিইং-এর জন্য দরকারি গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। কোরম্যাকের এই তত্ত্ব এবং গাণিতিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে গডফ্রে হাউন্সফিল্ড উদ্ভাবন করেন কম্পিউটেড টমোগ্রাফি।

এক্স-রের মাধ্যমে মানুষের শরীরের ভেতরের যেসব ছবি তোলা হয়, সেগুলি সব দ্বিমাত্রিক। তাতে শরীরের ত্রিমাত্রিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা সামগ্রিক দ্বিমাত্রিক চিত্র পাওয়া যায়, তবে তা সম্পূর্ণ চিত্র নয়। যেমন একজন রোগীর ফুসফুসের এক্স-রে দেখে ডাক্তার বুঝতে পারেন সেখানে কোন অস্বাভাবিকতা রয়েছে কি না। কিন্তু ফুসফুসের ঠিক কোন্‌ গভীরতায় অস্বাভাবিকতা আছে, তা একটিমাত্র চিত্র থেকে বোঝা যায় না। যেমন একটা বইয়ের শুধুমাত্র প্রচ্ছদের ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই বইটি কত মোটা।

হাউন্সফিল্ড যে পদ্ধতিতে এক্স-রে চিত্র তৈরি করলেন তা প্রচলিত এক্স-রে চিত্রের চেয়ে ভিন্ন। প্রচলিত পদ্ধতিতে রোগীর একটি এক্স-রে তৈরির জন্য একদিক থেকে এক্স-রে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সি-টিতে রোগীর চারদিক থেকে এক্স-রে প্রয়োগ করে অনেকগুলি ছবি একসাথে তুলে, সেই ছবিগুলি থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে এই প্রযুক্তি সরাসরি যুক্ত। তাই এই প্রযুক্তির নাম কম্পিউটেড টমোগ্রাফি।

গ্রিক শব্দ ‘টমোস’ অর্থ স্লাইস বা ফালি। টমোগ্রাফি শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে সেই অর্থে—যেখানে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এক্স-রের মাধ্যমে ফালি ফালি করে দেখা হয়। তারপর সবগুলি ফালির ছবি এক সাথে জোড়া দিয়ে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটিতে খুবই উচ্চমাত্রার জটিল গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটারের সফটওয়ার খুব সহজেই এই জটিল গণিতের সমাধান করতে পারে। কম্পিউটারের মাধ্যমে সবকিছু করা হয় বলে এই পদ্ধতির বেশ কয়েকটি নাম আছে। যেমন কম্পিউটারাইজড অ্যাক্সিয়েল টমোগ্রাফি বা ক্যাট, কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি, কিংবা কম্পিউটেড টমোগ্রাফি। বর্তমানে সার্বিকভাবে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সি-টি নামটাই ব্যবহৃত হয়।

১৯৭২ সাল থেকে হাউন্সফিল্ডের নেতৃত্বে ই-এম-আই কোম্পানি সিটি মেশিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। সেই বছরই হাউন্সফিল্ডকে যুক্তরাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সর্বোচ্চ পুরষ্কার ম্যাকরবার্ট পুরষ্কার দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন। ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর ১৯৮১ সালে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার নাইটহুড প্রদান করে।

স্যার গডফ্রে কোনদিন বিয়ে করেননি। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।

সূত্র

১। বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্টিস্টস, চতুর্থ খন্ড, ওয়ার্লড বুক, শিকাগো, ২০০৩।

২। প্রদীপ দেব, চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা প্রকাশন (প্রকাশিতব্য)।