হলুদ বরণ হলদে বউ

হলুদ শর্ষেখেতের অল্প ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে হলুদ দুটি পাখি। দুটিরই ঠোঁটে চেপে ধরা শর্ষেগাছের টসটসে রসাল শুঁয়োপোকা। ওরা আসছে পূর্ব দিকে—ভোরের সূর্যের সোনালি হলুদ আলো পাখি দুটির শরীরে যেন জ্বলছে। প্রকৃতির এ এক নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টির খেলা। উড়ছেও ছন্দে ছন্দে, দুলে দুলে। ওড়ার ভঙ্গিটাও খুব সুন্দর। এই পাখিরা যখন খাবারের সন্ধানে সোনালু ফুলের ঝাড়বাতিতে লম্ফঝম্প করে, তখনো অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য তৈরি হয়। শিমুল-মাদার বা পলাশ ফুলেও যখন ঘোরে মধু পানের জন্য, তখনো রঙের আশ্চর্য সমন্বয় দেখলে মুগ্ধ হতে হয়।

মাঠ পাড়ি দিয়ে বাগানের কিনারায় এসে বসে ওরা। একটি ছাতিমগাছের ঝুলন্ত-দুলন্ত ডালে। পাশাপাশি সরু তিনখানা ডাল দিয়ে জোড়া বাসায় ওদের সোনালি-হলুদ-কালো রঙে রাঙানো মিহি পালকের কী সুন্দর তিনটি ছানা! মা-বাবা বাসার পাশে বসতেই ছানা তিনটি একেবারে ‘চিঁহি চিঁহি’ কান্না জুড়ে দেয়, খাবারের জন্য বায়না ধরে। নড়েচড়ে খাড়া হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে ‘আগে খাব, আগে খাব’ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। মা-বাবা কোনটার পেটে খিদে বেশি, দেখেশুনে ও বুঝে ছানাদের মুখে খাবার তুলে দেয় সোহাগে। তারপর আবারও চলে শর্ষের মাঠের দিকে। ছানা তিনটি আবার বাসার তলায় বসে যায় চুপটি করে।

এই যে তিনখানা সরু ডালকে ভিত্তি করে গড়া বাসাটা, সেটা অনেকটাই গোলাকার মুখওয়ালা দোলনার মতো, এই দোলনার গভীরতা অবশ্য বেশি নয়। ডিমে তা দিতে দিতে এই বাসা-দোলনায় সুখদোলা ভালোই খাওয়া যায়। মাকড়সার জাল-ঝুল-সুপারিপাতা, কলাগাছের বাকল ও বাঁশপাতার সরু আঁশ, অতি সরু লতা ও গাছের শিকড় ইত্যাদি দিয়ে এই খাসা ও শক্তপোক্ত বাসাটি দুজনে মিলে গড়েছিল চার–পাঁচ দিনে। তার আগে অবশ্য দুজনে মিলে বাসা বাঁধার পছন্দসই জায়গা বাছাই করতে ব্যয় করেছিল দুই–তিন দিন। এদের বাসাটিকে গোলাকার বাটির সঙ্গেও তুলনা করা যায়। বাসার মুখের বেড় ২০ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার গড়পড়তা। নিচের দিকের বেড় গড়পড়তা ১২ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার। গভীরতা চার-ছয় সেমি। বাসা বাঁধার মৌসুম এদের বসন্ত-বর্ষা পর্যন্ত।

বাসা বাঁধা শেষ হওয়ার দু–এক দিনের ভেতরই ডিম পাড়ে। গড়ে তিনটি। ক্বচিৎ চারটি। দুজনেই পালা করে তা দেয় ডিমে। একজন বসে তা দেয়, অন্যটি তখন সীমানা পাহারায় রাখে। বিড়াল-বেজি-কুকুর বা মানবশিশু সীমানার ভেতর এলে গালাগাল ঝেড়ে ডাইভ মারে। তবে ভিতু ও নিরীহ স্বভাবের পাখি এরা। চুরি করে এদের বাসায়ও কোকিলের জাতভাই পাপিয়া-চোখ গেল ও বউ কথা কও পাখিরা ডিম পাড়ে। এরাও কাকের মতো ছানা ফুটিয়ে সেই ছানাদের খাইয়ে-খাইয়ে বড় করে।

মূল খাদ্য এদের নানা রকম পোকামাকড়, শুঁয়োপোকা—বিশেষ করে বড় বড় গাছের কাণ্ড ও বাকলের তলায় লুকিয়ে থাকা কয়েক রকম রসাল টসটসে ‘গাছপোকা’। নানা রকম পাকা ফল, পেঁপে ফল ইত্যাদিও খায়। তবে দুই–তিন ঠোকরের বেশি খায় না, পছন্দ করে বেশ কয়েক জাতের ফুলের মধুরেণু বা নির্যাস, নানা জাতের শূককীট। তাল-খেজুরের রস পান করে। কখনো কখনো পান করে শিশির। ক্বচিৎ ইচ্ছে করে শিশিরস্নানও করে। সুযোগ মিললে এই পাখিরা উইপোকা ও উইপোকার ডিম-বাচ্চাসহ পাখা গজানো বা উড়ন্ত উইপোকা খায়। তবে খুব যে পছন্দ করে এসব খাবার, তা মনে হয় না। শুঁয়োপোকা-কাঠপোকা নিয়ে এদের অনেক সময় কাড়াকাড়ি-মারামারি লাগে। কাঠঠোকরা-কাঠবিড়ালিও পোকা খায় পাখিদের সঙ্গে। তবে হেরে যায় এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অনেক সময় কাঠপোকা-শুঁয়োপোকা বড় হলে নড়েচড়ে পালাতে চায়। সে ক্ষেত্রে ঠোঁটে ধরে গাছের ডালে আছড়ায়।

খুবই আমুদে-খেলুড়ে, ফূর্তিবাজ এই পাখি। হলুদ রঙের এই পাখিদের নাম হলদে বউ। জোড়ায় জোড়ায় চলে সব সময়। এদেরও আছে বাসা বাঁধা, বাসায় ডিম পাড়া ও ছানা ফোটার ভিন্ন ভিন্ন স্বরের আনন্দসংগীত। ডিম-ছানা খোয়া গেলে কান্নার করুণ গানও এদের আছে।

সারা দেশে থাকা হলদে বউদের পুরুষটি বেশি হলুদ। চকচকে হলুদ। বুক-পিঠ-পেট ও লেজের তলা হলুদ, গলা-মাথা-চিবুক-ঘাড় কুচকুচে কালো। লেজের প্রান্তদেশের উপরিভাগসহ ওড়ার পালকের প্রান্তদেশ কালো। প্রজননে পুরুষের রং যেন জ্বলে। শরীরে যৌবনের রং লাগে। স্ত্রী পাখির রং কিছুটা নিষ্প্রভ। সদ্য উড়তে শেখা ছানাদের গলা ও ডানায় কালো ছিটা থাকে। চোখের ওপর দিয়ে থাকে হলুদাভ টান। গোলাপি ঠোঁট, কালো পা।

হলদে বউরা ঢাকা শহরের স্থানীয় বাসিন্দা সেই যুগ যুগ ধরে। শহর বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহন-মানুষ ও কোলাহল-হট্টগোল। হলদে বউরা এই আদিভূমি ত্যাগ করেনি, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে দিব্যি। ঢাকা শহরের পরিবেশ আজও ওদের অনুকূলে আছে। নিয়মিত বাসা করে ডিম-ছানা তোলে এই রাজধানী শহরের পার্ক-বাগান-উদ্যান ও অন্যান্য জায়গার গাছপালায়।

এদের অন্যান্য নাম হলো হলদে পাখি, হলুদিয়া, হলদে কুটুম ইত্যাদি। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক–হুডেড ওরিয়ল। বৈজ্ঞানিক নাম oriolus xanthornus। দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০ গ্রাম।

লেখক: পাখিবিশারদ