অসমাপ্ত রহস্যের খোঁজে

ব্ল্যাকহোল, লেখক: শিশিরকুমার ভট্টাচার্য, প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃষ্ঠা: ১০০, প্রচ্ছদ মূল্য: ১৭৫ টাকা

১৯১৬ সাল। বিশ্বজুড়ে জ্বলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন। সেই রণক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে বন্দুক-বারুদ ফেলে একজন যোদ্ধা খাতায় অঙ্ক কষছেন, সমাধান করছেন সদ্য আবিষ্কৃত এক তত্ত্বের। তত্ত্বটা বছরখানেক আগেই ঝড় তুলেছে। বদলে দিয়েছে পদার্থবিদ্যার চিরাচেনা জগৎকে। সেটা একেবারে পরিপূর্ণ কোনো তত্ত্ব নয়। বহু সমাধানের ইঙ্গিত বহন করছে তত্ত্বটি। বছর দশেকের মধ্যেই অনেকগুলো সমাধান দেবে সেটা, আর মহাকাশের কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা একের পর এক রহস্যময় সব বস্তু, মহাবিশ্বের প্রকৃতি ইত্যাদি স্পষ্ট হবে। তত্ত্বটা হলো ১৯১৫ সালে প্রকাশিত আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি।

বিজ্ঞানী কাম সৈনিকটি সেই তত্ত্বের সমাধান করে এক অদ্ভুত জিনিসের সন্ধান পেলেন। আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের সঙ্গে তাঁর ভরশক্তির সমীকরণ, নিউক্লিয়ার ফিউশন ইত্যাদি ব্যবহার করে বড় নক্ষত্রদের জন্ম ও মৃত্যুরহস্যের সমাধান করা যায় বেশ ভালোভাবেই। আর সেই হিসাব কষতে গিয়েই ২০০ বছর আগে পিয়েরে সামন ল্যাপলাস আর জন মিশেলের ভবিষ্যদ্বাণী করা অদ্ভুত এক নক্ষত্রের সন্ধান পেলেন তিনি। মিশেল আর ল্যাপলাস বলেছিলেন, মহাকাশে এমন কিছু নক্ষত্র থাকা উচিত, যেগুলো এত ভারী হবে, তার আকর্ষণ থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না। তাই দেখা যাবে না সেই আলো। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, আলোর ওপর মহাকর্ষ বলের কোনো প্রভাব নেই। এই ‘কিন্তু’র আড়ালেও আরেক ‘কিন্তু’ ছিল। স্যার আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বলে, কোনো বস্তুকে পৃথিবীর আকর্ষণ থেকে যদি মুক্ত হতে হয়, তাহলে সেই বস্তুকে অর্জন করতে হবে পৃথিবীর মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বেগ। পৃথিবীর মুক্তিবেগ হলো ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার।

সব গ্রহ-নক্ষত্রেরই মুক্তিবেগ আছে। মুক্তিবেগের মান নির্ভর করবে বস্তুর ভরের ওপর। ভর যত বেশি, মুক্তিবেগ তত বেশি। আর মুক্তিবেগ যার যত বেশি, তার বুক থেকে মহাকাশে হারিয়ে যেতে কোনো বস্তুর তত বেশি গতি প্রয়োজন হবে। মহাকাশে যদি এমন কোনো নক্ষত্র থাকে, যার ভর এতটাই বেশি যে মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়েও বেশি, তখন সেই নক্ষত্র থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না। আলোর ওপর নিউটনীয় মহাকর্ষ বলের প্রভাব নেই ঠিকই। কিন্তু আইনস্টাইন বলেছিলেন মহাকর্ষ আসলে কোনো আকর্ষণ বল নয়, বৃহৎ বস্তু তার চারপাশের স্থান-কালকে বেঁকে দেয়। সেই বক্রতার মধ্যে আরেকটা বস্তু যখন এসে পড়ে, তখন মনে হয় বড় বস্তুটি ছোটটিকে আকর্ষণ করছে।

সেই জার্মান সৈনিক দেখালেন, মহাকাশে এমন ভারী নক্ষত্র আছে, যার চারপাশের স্থানকাল অসীমভাবে বেঁকে যায়। ফলে মুক্তিবেগ হয়ে যায় আলোর চেয়েও বেশি। তাই আলোও অসীম বক্র আর অতি মুক্তিবেগের দুষ্টচক্রে পড়ে সেই বস্তুর মহাকর্ষক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। আর যার ভেতর থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না, তা দেখা যাবে কীভাবে?

প্রথম দিকে সেই সৈনিক বিজ্ঞানী—কার্ল শোয়ার্জশিল্ড যার নাম—তাঁর সমাধানকে কেউ পাত্তাই দিতে চাননি। পরে রবার্ট ওপেনহাইমার, হার্টল্যান্ড স্নাইডার, জন হুইলারের হাত ধরে সেই ভীষণ কালো অর্থাৎ ব্ল্যাকহোল নামের বস্তুটি আবার বিজ্ঞানীদের গবেষণার বস্তুতে পরিণত হয়। পরে রজার পেনরোজ, কিপ থর্ন ও স্টিফেন হকিংয়ের মতো রথী-মহারথীরা গবেষণা করেছেন এটা নিয়ে। আজ ব্ল্যাকহোল রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত। তবু এর অবগুণ্ঠন পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়নি। মহাবিশ্বের সেই মহারহস্য নিয়ে বিজ্ঞানী, গবেষক ও বিজ্ঞান লেখক শিশিরকুমার ভট্টাচার্য ২০১৬ সালে লিখেছিলেন সাবলীল ভাষায় এক বই—ব্ল্যাকহোল। বইটি দেশের সব অভিজাত বুকশপে পাওয়া যাচ্ছে।