হরেক রকম পদার্থের খোঁজে

‘পৃথিবীটা পুড়ছে আরও পুড়বে/ সভ্যতার অভিশাপ কে রুখবে?’ গানে গানে সভ্যতার রূঢ় বাস্তবতা বলে গিয়েছেন ক্ষণজন্মা শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী দুই দশক আগে। আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীটা পুড়েছে গত কয়েক বছর। করোনার সাপিনীরা চারদিকে বিষাক্ত নিশ্বাস ফেলার আগে বাস্তবিকই পুড়েছে পৃথিবীটা। দাবানলে ছাই হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কয়েক কোটি প্রাণী, তারও আগে হাজার হাজার একরজুড়ে ছাই হয়েছে আমাজনের বৃষ্টি–অরণ্য। চারদিকে এই যে পুড়ছে পৃথিবী, জ্বলছে আগুন কারখানায়, রান্নার চুলোয়—একই রকম দহন চলছে মানবশরীরের ভেতরে, পাকস্থলী থেকে কোষের অভ্যন্তরে—এই দহন-জ্বলনের সাহায্যেই উৎপাদিত হচ্ছে শক্তি, চলছে দেহঘড়ির কলকবজা। দাবানল থেকে কোষের শক্তি তৈরি—প্রতিটা ক্ষেত্রেই একটি পদার্থ দহন ঘটিয়ে শক্তির জোগান দিয়ে যাচ্ছে মানুষকে, পৃথিবীকে, কখনো কখনো ভস্মীভূত করে চলেছে সমাজ ও সভ্যতাকে। নিজে জ্বলে না, কিন্তু অন্যকে জ্বালানো বিচিত্র বিস্ময়কর পদার্থটির নাম অক্সিজেন। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করলেও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে আড়াই শ বছর আগে প্রথম আবিষ্কার করেন মৌলিক পদার্থটিকে। মহামূল্যবান কিন্তু সহজপ্রাপ্য এই পদার্থ নিয়ে লেখক আব্দুল হক খন্দকার বিশাল এক গল্প ফেঁদেছেন তাঁর বিচিত্র যত পদার্থ বইয়ে। ইতিহাসের চারকোনা হাতড়ে তুলে এনেছেন অনেক অজানা-অচেনা গল্প।

হাইড্রোজেনের সঙ্গে অক্সিজেনের সম্পর্ক রাজযোটকের মতো নাকি সাপে–নেউলে? সেটা নির্ভর করে কখন কোন পরিবেশে তাদের একত্রে রাখা হচ্ছে, তার ওপর। হাইড্রোজেন অনেক কাজের কাজী, এটা দিয়ে বোমা বানিয়ে যেমন ধ্বংস করে ফেলা যায় দেশকে, শহরকে; তেমনি জ্বালানি বানিয়ে বিমান-রকেট চালানো যায় খুব সুন্দরভাবে। আবার আমরা যে বলি সূর্যই পৃথিবীর সব শক্তির উৎস, এর জোগানদাতাও কিন্তু হাইড্রোজেন নামের পদার্থটিই। সূর্যের ভেতরে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসদের সংঘর্ষ হয়, সেই সংঘর্ষে তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ তাপশক্তি। সেই তাপশক্তিতেই দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। তারপরও কিছু তাপ রয়ে যায়। সেই তাপ থেকেই জন্ম সূর্যের আলোর। সেই আলোর সঙ্গে কিছু তাপ পৃথিবীতে পৌঁছায় বলে এখানে এত প্রাণচাঞ্চল্য। হাইড্রোজেন আবিষ্কারের কাহিনি, এর বিচিত্র ব্যবহার, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়েও লেখক দারুণ সব গল্প বলেছেন এই বইয়ে। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের মিলনে যে যৌগিক পদার্থটি তৈরি হয়, মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রাণের উৎস বলতে যে বস্তুটিকে এক নামে জানে সবাই, সেই পানির গল্পও বাদ যায়নি লেখকের গল্পের ঝুলি থেকে।

ভূপৃষ্ঠের তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল, সেই তিন ভাগ জলের কীর্তিকাহিনি আর তার তিন রকম রূপ, অর্থাৎ বরফ, পানি আর বাষ্পের বিচিত্র আচরণ, বিচিত্র চেহারার বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানেরও চেষ্টা করেছেন লেখক। লিখেছেন নাইট্রোজেন নিয়েও। বৈজ্ঞানিক ইতিহাস তো আছেই, সঙ্গে মানুষের জীবনে নাইট্রোজেনের গুরুত্ব, নাইট্রোজেন চক্রের বিশদ বিবরণ বাড়তি পাওনা।

বাতাসের বিচিত্র কথনও পাবেন এই বইয়ে। এ ছাড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড, লবণ কয়লা, ধূলিকণা, এমনকি ঘাসের বিচিত্র কাহিনিও বলেছেন লেখক।

বইটি ১৯৭২ সালে প্রথম প্রকাশ করেন অমর একুশে বইমেলার রূপকার চিত্তরঞ্জন সাহা তাঁর মুক্তধারা থেকে। দীর্ঘকাল পর বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পাওয়া যাবে দেশের অভিজাত বুকস্টল ও অনলাইন বুকশপগুলোতে।