আয়রনের রসায়ন

সকালে উঠে গোসল করে, নাশতা সেরে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দেখলেন শার্ট বা শাড়িটা ইস্ত্রি করা নেই। তখন গরম ইস্ত্রির মতোই মেজাজটা গরম হয়ে যাওয়ার কথা। কুঁচকানো কাপড় পরে তো আর বাইরে বের হওয়া যায় না। আঁটসাঁট, পরিপাটি পোশাক পরে, একটা ভদ্র লুক এনে তবেই বের হওয়া চাই। কিন্তু কাপড়চোপড়গুলো ভীষণ অভদ্র, একবার পরলে বা একবার ধুলেই কেমন যেন কুঁকড়ে যায় এরা। সেই কোঁকড়ানো কাপড় ঠিক করতে আবার এলাহি কাণ্ড শুরু করে দিতে হয়। কাপড়ে মাড় দেওয়া, টান টান করে ইস্ত্রি করা, ইস্ত্রি করা কাপড়কে ভাঁজে ভাঁজে আলমারিতে তুলে রাখা, আরও কত কী! আর অফিসে যাওয়ার ঠিক আগে যদি কাপড় ইস্ত্রি করার ঝামেলা আসে, তাহলে অফিসে যেতে নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে আপনার। গরমে আরামের কথা ভেবে সিনথেটিক কাপড় পরাও বাদ দিয়েছেন। এমন সময় মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, সুতি কাপড়চোপড়ের জন্য এত মহাযজ্ঞ না করলেই কি চলে না? এমন কি কিছু নেই, যা দিলে কাপড় আর কুঁকড়ে যাবে না। সব সময় টান টান থাকবে। ইস্ত্রি করার ঝামেলা নেই। তাহলে বিদ্যুতও বেঁচে যেত বেশ কিছুটা।

এমন অনন্য চিন্তাধারা কেন এত দিনে বিজ্ঞানীদের মাথায় এল না? মাথামোটা বিজ্ঞানীরা কেন এমন পোশাক বানানোর চিন্তা করলেন না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক বাজারে থাকা পোশাকগুলোর কুঁকড়ে যাওয়ার পেছনে আসলে কী বিজ্ঞান কাজ করছে। পুরোটাই রসায়নের জাদু। গাছ থেকে পাওয়া ফেব্রিক যেমন সুতি কাপড় বা নাইলনের কাপড় বেশি কুঁকড়ে যায়। এরা তৈরি হয় সেলুলোজ দিয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সেলুলোজের পলিমার দিয়ে। এদের পলিমার বলা হয়, কারণ হাজার হাজার গ্লুকোজ অণু একটার পর একটা সজ্জিত হয়ে লম্বা শিকলের মতো তৈরি করে। প্রতিটি গ্লুকোজ অণু বেশ চটচটে বা আঠালো। একটা আরেকটাকে হাইড্রোজেন বন্ধনে শক্ত করে আটকে রাখে। এককভাবে এই হাইড্রোজেন বন্ধন বেশ দুর্বল। কিন্তু এমন হাজার হাজার হাইড্রোজেন বন্ধন বেশ শক্তিশালী। এদের জন্যই কাপড় ছিঁড়ে যেতে পারে না।

এই হাইড্রোজেন বন্ধন আবার বেশ নড়বড়ে। এই বন্ধন সহজে ভেঙে যেতে পারে আবার সহজে জোড়াও লেগে যায়। সুতি পোশাক পরলে হাইড্রোজেন বন্ধন ভাঙা-গড়ার মাধ্যমে শরীরের গড়ন অনুযায়ী পোশাকের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়। এই সেলুলোজ পলিমারে পানি ঢুকে গেলে মহাবিপদ। পানির অণুগুলো সেলুলোজ অণুর মধ্যে ঢুকে যায় এবং লুব্রিকেন্ট হিসেবে কাজ করে। সেলুলোজ অণুগুলো পিচ্ছিল হয়ে যায়। অণুগুলো একটা আরেকটার ওপর গড়িয়ে পড়ে। এমন অবাধ্য অণুদের বশ করতে তখন একটাই হাতিয়ার কাজ করে। আর তা হলো ধোঁয়া ওঠা গরম ইস্ত্রি। তাপ ও আর্দ্রতা এলোমেলো হাইড্রোজেন বন্ধনগুলোকে ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা সেলুলোজ অণুদের সারিবদ্ধ করে একটার পর একটা দাঁড় করিয়ে দেয়। এতেই কাপড় টান টান হয়ে যায়।

টানটান কাপড়ের রসায়ন

ইস্ত্রির বাইরে আরেকটা সনাতনী পদ্ধতির কথা মাথায় আসতে পারে আপনার। সেটা হলো ভাতের মাড় ব্যবহার করা। ভাতের মাড় আসলে ঘন স্টার্চের দ্রবণ। স্টার্চও একটা পলিমার, তবে এই পলিমার শাখান্বিত, সেলুলোজের মতো লম্বা সরলরৈখিক শিকল নয়। স্টার্চ অনেকটা জোর করে সেলুলোজ অণুদের সাজিয়ে দেয়। এই সাজানোটা খুব একটা সুন্দর হয় না। কাপড়টাও অতিরিক্ত শক্ত হয়ে যায়। তাই ভাতের মাড় ব্যবহার করলেও আবার ইস্ত্রি করতে হয় কাপড়কে। এ ছাড়া পানি দিয়ে ধুলেই স্টার্চের জোরজবরদস্তি সব শেষ। অর্থাৎ ভাতের মাড় কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। স্থায়ী সমাধানের জন্য ব্যবহার করতে পারেন ফরম্যালডিহাইড বা ফ্রেন্ডলিয়ার (ডাইমিথাইলঅল ডাইহাইড্রোক্সিইথিলিন ইউরিয়া)। এতে আপনার পোশাক স্থায়ীভাবে কোঁচকানো প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। তবে সেই পোশাক গায়ে চাপালে মনে হতে পারে কোনো প্লাস্টিকের ব্যাগ গায়ে জড়িয়ে আছেন! আবার ফরম্যালডিহাইড থেকে সামান্য ত্বক জ্বালাপোড়াও করতে পারে! এরপরও সুতি কাপড় ইস্ত্রি করার ঝামেলা থেকে বাঁচতে ফরম্যালডিহাইড ব্যবহার করবেন কি না, তা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত।

আপাতত যেহেতু কোনো উপায় নেই, আজকের জন্য নয়তো একটু কষ্ট করে শার্ট বা শাড়িটা ইস্ত্রি করে নিন। কালকে মনে করে সব কোঁচকানো কাপড়চোপড় কোনো একটা লন্ড্রির দোকানে দিয়ে আসুন। বাড়িতে ইস্ত্রি করার ঝামেলা লন্ড্রির ঘাড়েই চাপিয়ে দিন।