অম্লমধুর ফলের কথা

সাইট্রিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডের নাম শোনেনি, এ রকম মানুষ পাওয়া কঠিন। কারণটা হচ্ছে লেবু। লেবুর যে টক স্বাদ এবং এর অ্যাসিডিটি বা অম্লত্বের কারণ হচ্ছে এই সাইট্রিক অ্যাসিড। ফলে এই লেবুতেও যে শুধু সাইট্রিক অ্যাসিডই থাকে, ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। বিভিন্ন ফলে বিভিন্ন অ্যাসিড থাকে এবং এগুলোর মাত্রাও বিভিন্ন।

সাইট্রিক অ্যাসিড লেবু এবং লেবুজাতীয় ফলে সর্বোচ্চ পরিমাণে থাকে। বেরিজাতীয় ফলেও মূল অ্যাসিড হিসেবে সাইট্রিক অ্যাসিডই থাকে। এর মধ্যে স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি এবং গুজবেরিও আছে।

সাইট্রিক অ্যাসিডের অম্লত্ব বেশ তীব্র এবং এই অ্যাসিড আলাদাভাবে খাবার ও বিভিন্ন পানীয়তে স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো এই সাইট্রিক অ্যাসিড কাপড়ের দাগ তোলার জন্য সাবানে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ ও কসমেটিক সামগ্রীতেও ব্যবহার করা হয় এই সাইট্রিক অ্যাসিড। আরও মোটা দাগে বলা চলে, বেশির ভাগ জীবিত প্রাণীর শরীরেই সাইট্রিক অ্যাসিড আছে। আছে আমার–আপনার শরীরেও। সাইট্রিক অ্যাসিডের লবণ আমাদের শরীরের কোষীয় বিপাকের সাইট্রিক অ্যাসিড সাইকেল বা ক্রেবস সাইকেলের মতো বিপাক ক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেয়।

সাইট্রিক অ্যাসিডের পরেই আছে ম্যালিক অ্যাসিড। আপেলে ম্যালিক অ্যাসিড খুব বেশি পাওয়া যায়। ম্যালিক অ্যাসিডের নামটাও এসেছে আপেলের গ্রিক নাম ম্যালাম থেকে। তরমুজের অম্লত্ব বা অ্যাসিডিটি তুলনামূলকভাবে বেশ কম, এখানেও আছে সেই ম্যালিক অ্যাসিড। এ ছাড়া রুবার্ব বা রেউচিনির তীক্ষ্ণ স্বাদের কারণও এই ম্যালিক অ্যাসিড।

আপনি যদি একই সঙ্গে টক-মিষ্টি স্বাদের ফ্যান হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি আসলে ম্যালিক অ্যাসিডের ফ্যান। অতিরিক্ত টক স্বাদের সঙ্গে মিষ্টি স্বাদ আনতে ম্যালিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে লবণে ভিনেগারের স্বাদ আনতে ব্যবহৃত হয় ম্যালিক অ্যাসিড। ওয়াইনেও এই বস্তু বেশ ভালো পরিমাণেই থাকে। সাইট্রিক অ্যাসিডের মতো ম্যালিক অ্যাসিডের লবণও বেশির ভাগ জীবের কোষে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কোষীয় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই লবণের ভূমিকা আছে।

ফলে পাওয়া জৈব অ্যাসিডগুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে টারটারিক অ্যাসিড। যদিও সাইট্রিক বা ম্যালিক অ্যাসিডের তুলনায় এই অ্যাসিড খুব কম ফলে পাওয়া যায়। যেমন আঙুর ফলে ম্যালিক অ্যাসিডের পাশাপাশি টারটারিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। এ ছাড়া অ্যাভোকেডো এবং তেঁতুলে মূল অ্যাসিড হিসেবে টারটারিক অ্যাসিড পাওয়া যায়।

ম্যালিক অ্যাসিডের মতো টারটারিক অ্যাসিডও খাবারে টক-মিষ্টি স্বাদ আনতে ব্যবহার করা হয়। ওয়াইনের কষালো স্বাদের জন্য ম্যালিক অ্যাসিডের পাশাপাশি টারটারিক অ্যাসিডও দায়ী। পুরোনো ওয়াইনের বোতলের নিচে যে স্ফটিক বা ওয়াইন ডায়মন্ড তৈরি হয়, তা হচ্ছে টারটারিক অ্যাসিডের একটি লবণ আর পটাশিয়াম বাইটারট্রেট।

পটাশিয়াম বাইটারট্রেট রসায়নের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি যৌগিক পদার্থ। ১৮১৫ সালে ফ্রেঞ্চ জাঁ-ব্যাপটিস্ট বায়োট দেখান, পটাশিয়াম বাইটারট্রেটের স্ফটিকে প্লেইন–পোলারাইজড আলো ঘুরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা আছে। এরপর জাঁ-ব্যাপটিস্টের কাজ এগিয়ে নেন বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ লুই পাস্তুর। তিনি লক্ষ করেন, এই লবণ স্ফটিকের সম্ভাব্য রাসায়নিক গঠন দুই রকম হতে পারে। রাসায়নিক গঠন দুটি একটি আরেকটির মিরর ইমেজ, রসায়নবিদেরা যাকে বলছেন ইনানটিওমার বা অপটিক্যাল আইসোমার।

টারটারিক অ্যাসিডের আবিষ্কার রসায়নের দুনিয়ায় বলতে গেলে খুব দুর্দান্ত একটা আবিষ্কার ছিল। রসায়নবিদেরা রেসেমিক মিকশ্চার নামে একটি শব্দ ব্যবহার করেন। এটা এমন এক মিশ্রণ, যাতে একটি পদার্থের দুটি মিরর ইমেজ কেমিক্যাল স্ট্রাকচারই ব্যবহার করে বানানো হয়। এই মিশ্রণের প্লেইন-পোলারাইজড লাইটের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। টারটারিক অ্যাসিডের আরেকটি নাম হচ্ছে রেসেমিক অ্যাসিড। লাতিন শব্দ রেসেমাস থেকে শব্দটি এসেছে। রেসেমাস শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘একথোকা আঙুর’। পৃথিবীতে প্রথম রেসেমিক মিশ্রণটি তৈরি করা হয়েছিল টারটারিক অ্যাসিডের দুই আইসোমার দিয়ে।

এতক্ষণ যে অ্যাসিডগুলোর কথা বলা হলো, এই তিনটি অ্যাসিডই ফলের মূল অ্যাসিড। এ ছাড়া নানা রকম অ্যাসিড ফলে পাওয়া যায়, তবে পরিমাণে সামান্য। এর মধ্যে আছে আইসোসাইট্রিক অ্যাসিড, পাওয়া যায় ব্ল্যাকবেরিতে, অক্সালিক অ্যাসিড, পাওয়া যায় বেরিজাতীয় ফলে। খেজুর ও অন্যান্য পামজাতীয় ফলে পাওয়া যায় কুইনিক অ্যাসিড।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া