হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কতটা ভয়ংকর

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ঘটে যাওয়া ভয়ংকরতম অগ্নিকাণ্ডে স্তম্ভিত পুরো দেশ। মারাত্মক এই বিস্ফোরণের জন্য হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। কী এই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড? কেনই বা এটা বিপদজনক?

সাধারণ পানির অণু তৈরি হয় দুটি হাইড্রোজেন এবং একটা অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডও এই দুইটি মৌলের সমন্বয়ে গঠিত। পার্থক্য হচ্ছে, এক্ষেত্রে একটা অক্সিজেন পরমাণু বেশি থাকে। এর রাসায়নিক সংকেত H2O2

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ও বিশুদ্ধ অবস্থায় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড দেখতে একদম স্বচ্ছ, বর্ণহীন। তবে এর তীব্র গন্ধ আছে। আমাদের চারপাশের বাতাসে অল্প পরিমাণে বায়বীয় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়।

বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ঘনত্ব পানির চেয়ে বেশি। এবং পানিতে সম্পূর্ণভাবে দ্রবীভূত হয়। স্বাভাবিক চাপে এটা জমাট বাঁধে মাইনাস ০.৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আর ১৫০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে শুরু করে।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মূলত অক্সিডাইজিং এজেন্ট। অস্ট্রেলিয়ান ডেঞ্জারাস গুডস কোড অনুসারে, অক্সিডাইজিং এজেন্ট হচ্ছে এমন পদার্থ, যা নিজে সরাসরি দাহ্য না হলেও অক্সিজেন নিঃসরণ করে। ফলে এটা দহনে মারাত্মকভাবে সাহায্য করে। এছাড়াও এটা একটা ক্ষয়কারী যৌগ।

দুই

১৮১৮ সালে লুই জ্যাক থেনার্ড হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আবিষ্কার করেন। শক্তিশালী অক্সিডাইজিং বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এটা পরিষ্কারক এবং জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া প্রসাধনী, ওষুধ তৈরি, টেক্সাটাইলের ব্লিচিং এজেন্ট, রকেটের জ্বালানী হিসেবে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ব্যবহৃত হয়। শিল্পক্ষেত্রে অন্যান্য পার-অক্সাইড যৌগ তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড যেহেতু একটি ক্ষয়কারী পদার্থ, তাই এটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নানাভাবে বিপজ্জনক। বিপদের মাত্রা কেমন হবে সেটা নির্ভর করে এর ঘনত্ব এবং পরিমাপের ওপর।

অন্যদিকে অক্সিডাইজিং এজেন্ট হওয়ায় নির্দিষ্ট জৈব যৌগের সংস্পর্শে এলে সেখানে বিস্ফোরক বাষ্প তৈরি হতে পারে। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড পরিমাণে অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করে। এরকম অবস্থায় সেটা আগুনের সংস্পর্শে এলে ঘটে বিস্ফোরণ।

তিন

গৃহস্থালীর কাজে বিভিন্ন পরিষ্কারক উপদানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ব্যবহৃত হয়। খুব অল্প মাত্রায় থাকে বলে, সেগুলো ত্বকের খুব ক্ষতি করে না। তবে, মাত্রা অনেক বেশি হলে, ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। চোখে বা পেটে গেলেও তা ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কোন দ্রবণে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ২৮ শতাংশের বেশি থাকলে সেটা অনেক বেশি বিপদজনক। সাধারণত শিল্প ক্ষেত্রে এ ধরনের মাত্রা ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের দ্রবণকে অল্প তাপমাত্রা এবং বিশেষ নিরাপত্তার সঙ্গে সংরক্ষণ করা উচিত। তাপমাত্রা বেশি হলে অক্সিজেন অণু মুক্ত হয়ে পানি ও অক্সিজেন গ্যাস তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে খুব সহজেই অক্সিজেন গ্যাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সামান্য স্ফুলিঙ্গের কারণেও তখন আশেপাশের দাহ্য পদার্থে আগুন ধরে যেতে পারে।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের এই ভেঙ্গে যাওয়া ও অক্সিজেন তৈরি হওয়া থেকে সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৫২ শতাংশের বেশি ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের দ্রবণকে অক্সিডাইজার ক্লাস-৩ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গবেষণাগার ছাড়া এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। খুব সাবধানে সংরক্ষণ করতে হয় একে। রকেটের জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। সেক্ষেত্রে ঘনত্ব হয় ৯১ শতাংশের ওপরে।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড তাই একদমই নিরীহ কোনো যৌগ নয়। বরং পৃথিবীর সব দেশই একে বিপদজনক রাসায়নিক হিসেবে মনে করে।

১৯৫৫ তে ব্রিটিশ নেভির সাবমেরিন এইচএমএস সিডন নিজের একটা টর্পেডো বিস্ফোরণে ডুবে যায়। কারণ সেই টর্পেডোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড জ্বালানি ছিল। এরপর থেকে ব্রিটিশ নেভি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড জ্বালানী ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০০ সালে রাশান সাবমেরিন কুরস্ক ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরণে ডুবে যায়। কাজেই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড খুব আগ্রাসী একটা রাসায়নিক হতে পারে। ৪০% এর বেশি ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড তাই বিপদজনক।

সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপো থেকে উদ্ধার করা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডে কন্টেইনারে ৬০% ঘনত্ব লেখা দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ এই ঘনত্বের হাইড্রোজেন পারক্সাইড অতি সাবধানে রাখা উচিত। একটা কন্টেইনারে ফাটা দেখা গেছে। তবে সেখানে বিস্ফোরণ কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে।

সূত্র:

ফায়ারফাইটার ইনসাইডার

মেডিকেল নিউজ টুডে

জাভেদ ইকবালের ফেসবুক প্রোফাইল, গবেষক, বোস্টন, যুক্তরাষ্ট্র