CRISPR শস্যও কি GMO?

ছবি: সংগৃহীত

সারা দিনের ব্যস্ত সময় পার করে বাসায় ফিরে যদি দেখেন পছন্দের জিনিসটি রান্না করা হয়েছে, খুব আনন্দ হয় তাই না? কিন্তু কেমন লাগবে যখন খাওয়ার পরে শুনবেন, সেটি ছিল জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফুড? হয়তো আপনার বাসায় যে সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না করা হয়েছে সেটি সুদূর আমেরিকা থেকে আমদানি করা জেনেটিক্যালি মডিফাইড সয়াবিনগাছ থেকে সংগৃহীত। তেলে যেহেতু কোনো DNA থাকে না, তাই মডিফাইড সয়াবিন থেকে কোনো কিছু আমাদের শরীরে আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। জিএম সয়াবিন থেকে পাওয়া তেল আজ তাই ব্যবহূত হচ্ছে কোনো সংশয় বা নিয়ন্ত্রণ (regulation) ছাড়াই।

কিন্তু জেনেটিক মডিফিকেশন আসলে কী? কোনো জীবের কোষের নিউক্লিয়াসে থাকা ডিএনএতে (DNA) যখন কিছু পরিবর্তন আসে, তাকে বলা হয় জেনেটিক পরিবর্তন। প্রাকৃতিক নিয়মেই গাছের জেনেটিক গঠনেও আসে নানা পরিবর্তন। এসব পরিবর্তন আছে বলেই একই ফুলের বিভিন্ন রং আবার একই ফলের ভিন্ন জাতের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক এই পরিবর্তন অনেক সময়সাপেক্ষ। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন অল্প সময়ে কোষের ডিএনএতে নির্দিষ্ট জায়গায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা হয়, তাকেই বলা হয় জেনেটিক মডিফিকেশন। এর ফলে কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের হার কমানো বা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন আর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা জোগান অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁডিয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর করার মতো সময় ও সুযোগ আর নেই আমাদের হাতে। এই সমস্যা মোকাবিলায় ট্রান্সজেনিক রিসার্চ এখন অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। অধিক উত্পাদন, উন্নত পুষ্টিগুণ বা প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতা প্রদানকারী জিনগুলোকে এক প্রজাতি থেকে একই বা অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে ট্রান্সজেনিক রিসার্চের কল্যাণেই। এর ফলে একটি প্রজাতির নিজস্ব ডিএনএতে অন্য প্রজাতির ডিএনএর কিছুটা অংশ যুক্ত করে নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা যায়। আর এই জেনেটিক মডিফিকেশনের ফলে প্রাপ্ত খাদ্যশস্যকেই বলা হয় জিএম ফুড। যদিও সৃষ্টির সব জীবের ডিএনএ-এর মৌলিক গঠন অ্যাডিনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) ও থাইমিন (T)—চারটি নিউক্লিওটাইডের সমন্বয়ে গঠিত। তবু একটি প্রজাতিতে কোনো বৈশিষ্ট্য উন্নয়নে অন্য প্রজাতি থেকে ডিএনএ স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। এসব জিএম ফুড খেলে মানুষ বা অন্য প্রাণীতে এর কোনো খারাপ প্রভাব পড়তে পারে কি না, অথবা প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য জিএম ফুড হুমকিস্বরূপ কি না, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। তাই বাজারে আসার আগে প্রতিটি জিএম ফুডকে অনেক পরীক্ষা ও কঠোর নীতিমালা মেনে আসতে হয়।

এমন উভয় সংকট পরিস্থিতিতে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে এক নতুন প্রযুক্তি, যার নাম CRISPR-Cas সিস্টেম। ক্রিসপার-ক্যাস মূলত একটি আরএনএ (RNA)-প্রোটিন কমপ্লেক্স, যা ডিএনএকে এডিট করার ক্ষমতা রাখে। ব্যাকটেরিয়ার ইমিউন সিস্টেমের এই উপাদানকে একটি ম্যাপ দিয়ে দিলে তা ম্যাপ অনুযায়ী ডিএনএর নির্দিষ্ট জায়গায় কেটে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারে। আর কাজ শেষে CRISPR-Cas পদ্ধতিটিও কোষের ভেতর নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কোষের ভেতরে বাইরের কোনো অবশিষ্ট থাকে না, থেকে যায় শুধু সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, যা পরবর্তী প্রজন্মে অতিবাহিত হয়। এ যেন মীনা কার্টুনের সেই দৈত্যের মতোন ইচ্ছাপূরণ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

ট্রান্সজেনিক আর ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতির মূল পার্থক্যটা কি ধরতে পেরেছন? ট্রান্সজেনিক রিসার্চ হচ্ছে দুটো আলাদা চিনির কৌটা থেকে চিনি মিশিয়ে এক গ্লাস শরবত তৈরির মতো। চিনি যে কৌটা থেকেই নেওয়া হোক না কেন, শরবতের মিষ্টি হবে একই রকম। যে প্রজাতি থেকেই ডিএনএ স্থানান্তর করা হোক, সব ডিএনএর গঠন যেহেতু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অভিন্ন, তাই ট্রান্সজেনিক রিসার্চ বাস্তবসম্মত। ট্রান্সজেনিক সিস্টেমে বহিরাগত কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ডিএনএ রয়ে যায়, কিন্তু ক্রিসপার-ক্যাস ক্ষেত্রে ডিএনএর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন করার পর সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। তবু এ বিতর্কের অবসানে বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতিকে আরও ব্যবহার উপযোগী করতে।

ক্রিসপার-ক্যাস সিস্টেম তাকে দেওয়া RNA-ম্যাপ অনুযায়ী, ডিএনএর নির্দিষ্ট জায়গা খুঁজে বের করে সেই জায়গাটুকু কেটে দেয়। কেটে দেওয়া জায়গায় কোষের নিজস্ব নিউক্লিওটাইড যুক্ত হয় অথবা কাটা জায়গাটুকু ডিএনএ থেকে অপসারিত হয়ে যায়। এ সিস্টেম বাইরে থেকে কোষের ভেতর ঢুকে শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় কাটার কাজটুকু করে। এ ছাড়া ডিএনএ পরিবর্তনের বাকি সব কাজ কোষ তার নিজস্ব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সম্পন্ন করে। কাজ শেষে ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতিও কোষের ভেতর নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাইরে থেকে কোনো ডিএনএ কোষের ডিএনএর সঙ্গে যুক্ত হয় না। ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতিকে তাই বলা হয় জিনোম এডিটিং টুল। লিখতে লিখতে ভুল হয়ে গেলে যেমন রাবার দিয়ে মুছে সেটা ঠিক করে নেওয়া যায়, এ পদ্ধতিও অনেকটা সে রকমই।

ট্রান্সজেনিক পদ্ধতি ছাড়াও সংকরায়ণ/ হাইব্রিড ও রেডিয়েশন দিয়ে মিউটেশন সৃষ্টি করে কোনো জিনের বৈশিষ্ট্য-প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই জিনগত পরিবর্তন সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। শুধু বাহ্যিক পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে শনাক্ত করা হয়। কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ এ পদ্ধতির চেয়ে ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতি নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী প্রযুক্তি। এটি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য DNA পর্যায়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পরিবর্তন আনা সম্ভব।

ক্রিসপার পদ্ধতি দিয়ে পরিবর্তনকৃত খাদ্যশস্য তাই জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে না। এসব খাদ্যশস্যের নিজস্ব ডিএনএতে অন্য প্রজাতির ডিএনএ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং জিনগত বৈশিষ্ট্যও থাকে অক্ষুণ্ন। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিসপার-ক্যাস দিয়ে পরিবর্তিত মাশরুমকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কোনো জিএম পরীক্ষা ছাড়াই।

এ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে ক্রিসপার-ক্যাস পদ্ধতি অন্যতম। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উন্নয়ন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে অনেকাংশে সাহায্য করবে। আর মানুষও এসব খাদ্যকে জিএম ফুড হিসেবে দেখবে না, থাকবে না জিএম ফুডের জন্য আলাদা লেবেল। আশ্চর্য এই ক্রিসপার-ক্যাস যন্ত্রের ওপর ভর করে বর্তমান সমস্যা মোকাবিলায় বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট তত্পর। আর একটি নতুন প্রযুক্তির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত হয়তো CRISPR বর্তমানে ভবিষ্যেক সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান।

লেখক: গবেষক, প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ল্যাব, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: নেচার নিউজ

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত