বিজ্ঞানচিন্তা: আগামী দিনের প্রযুক্তিপণ্যগুলোতে বায়োসেন্সরের ব্যবহারের সম্ভাবনা কতটুকু? ভবিষ্যতে বায়োসেন্সরের অবদান কেমন হবে?
কামরুল হাসান: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়োসেন্সরযুক্ত বিভিন্ন যন্ত্র। ছোট্ট গ্লুকোজমিটার থেকে শুরু করে গোটা ডায়াগনস্টিক সেবাই কিন্তু ধীরে ধীরে এ রকম সব বায়োসেন্সরযুক্ত যন্ত্রে ঢুকে যাচ্ছে। সেগুলো থেকে আমাদের শরীরের পুষ্টির চাহিদা, রক্তে ভিটামিন, লবণ, গ্লুকোজ, ডায়াবেটিসসহ যেকোনো জীবাণুর অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব। এখন আমাদের জন্য বড় কাজ হলো জটিল রোগের জন্যও এমন বায়োসেন্সর তৈরি করা, যেন মানুষ সহজেই ঘরে বসে তার দেহের যাবতীয় রোগ সম্পর্কে জানতে পারে এবং তার জন্য চিকিৎসা নিতে পারে।
মানুষ ছাড়াও আসলে অন্যান্য প্রাণীর পরিচর্যার ক্ষেত্রেও কিন্তু বায়োসেন্সর ব্যবহার করা যায়। ধরুন, আমাদের দেশে কৃষি খাতে ব্যবহারের উপযুক্ত বিভিন্ন বায়োসেন্সর বানানো যেতে পারে। এমন হতে পারে যে বায়োসেন্সরের মাধ্যমে গবাদিপশুর রোগবালাই সম্পর্কে জানা যাবে। তখন সেগুলোর ঠিকমতো যত্ন নেওয়া সহজ হবে।
প্রতিদিন যেসব খাবার আমরা নিয়মিত খাই, সেটার পুষ্টিমান নিয়ে কিন্তু সব সময় প্রশ্ন থেকেই যায়। খাবারে ভেজাল আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। মানুষ সেসব খাবার নিয়মিত খাচ্ছে আর শরীরে বাসা বাঁধছে নানাবিধ জটিল রোগ। এমন বায়োসেন্সর বানানো যেতে পারে, যেটা হয়তো খাবারে স্পর্শ করালেই জানা যাবে সেটার পুষ্টিমান কিংবা খাবারে ভেজাল কিছু মেশানো হয়েছে কি না। মাছে, সবজিতে মেশানো ফরমালিন শনাক্ত করা যাবে ওই সেন্সর দিয়ে। একজন স্বাস্থ্যসচেতন ক্রেতা স্বভাবতই এ ধরনের সেন্সর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।
এ ছাড়া বায়োসেন্সরের অ্যাডভান্স লেভেল নিয়েও কাজ হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন মানুষের দেহের ভেতরেই যদি মাইক্রোচিপ স্থাপন করা যায়, তা দেহের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে, এসব সেন্সর মানুষের রক্তের উপাদানগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের জন্য শক্তি উৎপাদন করতে পারে। ফলে আপনাকে আলাদাভাবে বায়োসেন্সর বহন করা বা এগুলোর জন্য ব্যাটারি ব্যবহার করার প্রয়োজন হচ্ছে না।
এখন এই ধরনের বায়োসেন্সর নিয়ে খুবই অ্যাডভান্স পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। গুগল লাইফ সায়েন্স, সম্প্রতি চোখের রেটিনায় এক বিশেষ বায়োসেন্সর স্থাপন করেছে সফলভাবে। আমাদের চোখের অশ্রু থেকে এটি দেহের নানা রকম তথ্য স্মার্টফোনে সরবরাহ করতে পারে। আগামী দিনগুলোতে হয়তো আমাদের দেহের আরও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতেও এভাবে বায়োসেন্সর ব্যবহার করার সুযোগ হবে।
আমার এক সহকর্মী কাজ করছেন গাছ থেকে শক্তি উৎপাদনের। গাছ সারা দিন যে পরিমাণ শক্তি সূর্যের আলো থেকে গ্রহণ করে, তার পুরোটা কিন্তু সে ব্যবহার করে না। সেটার একটা বড় অংশ গাছ তাপীয় মাধ্যমে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করছেন সেই শক্তি সংগ্রহ করে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। এটা করতে গিয়ে তিনি খেয়াল করেছেন, বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল বা গাছ আসলে আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তি গ্রহণ করে। এমন কোনো হাইব্রিড গাছ তৈরি করা যায় কি না, যেটা একটা বিশাল পরিসরে সূর্যের আলো থেকে শক্তি তৈরি করতে পারবে, সেটা নিয়েও ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে সূর্যের আলো আমরা বেশি করে কাজে লাগাতে সক্ষম হব। ব্যাকটেরিয়ার কোষ থেকে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বড় ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে পুরো বিশ্বকেই আসলে প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে টেকসই শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য। জৈব উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলোতে আমরা পৃথিবীর মোট শক্তি উৎপাদনের একটা বড় অংশ উৎপাদন করতে পারব বলে আশা করি।
বিজ্ঞানচিন্তা: গবেষণার কাজে আপনার উদ্ভাবিত উপকরণগুলো সম্পর্কে বলুন। আগামী দিনের গবেষণায় সেগুলোর ব্যবহার ও বাংলাদেশে তার প্রয়োজনীয়তা কী?
কামরুল হাসান: শক্তির উৎপাদন বরাবরই আমাদের দেশের জন্য খুব বড় সমস্যা ছিল। আগামী দিনগুলোতে দেশে যদি এ ধরনের বায়োলজিক্যাল পাওয়ার স্টেশন গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই প্রকৃতি থেকে শক্তি উৎপাদন করতে পারব। আমাদের নিজেদের শক্তির চাহিদা পূরণের জন্য তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না।
কয়েক বছর হলো আমরা সমুদ্র বিজয় করেছি। সমুদ্রের এই বিশাল এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা যদি কোনো বায়োসেন্সর স্থাপন করতে চাই, যা ওই নির্ধারিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করবে। এ ধরনের বায়োসেন্সর স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শক্তির নিয়মিত সরবরাহ। সিলিকনের সৌরকোষ দিয়ে এসব বায়োসেন্সরে শক্তির সরবরাহ করা হলে নির্ধারিত সময় পরপর তা হালনাগাদ করতে হয়, এটা বেশ ব্যয়বহুল। কিন্তু যদি এ কাজে ব্যাকটেরিয়াল ফুয়েল কোষ ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেই সমস্যা থাকবে না। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে থাকা বিশেষ ব্যাকটেরিয়াগুলো সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে অনায়াসে নিরবচ্ছিন্নভাবে শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। এ ধরনের শক্তি সরবরাহ কিন্তু নদীকেন্দ্রিক যেকোনো পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় ব্যবহার করা সম্ভব।
এ ছাড়া আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে শস্য উৎপাদন করা হয়। এসব শস্যের চাষের ক্ষেত্রে ফসলের স্বাস্থ্য, সেগুলোর গুণগত মান এবং তা উৎপাদনে প্রকৃতির প্রভাব কতটা, তা বের করার জন্য নানা রকম বায়োসেন্সর তৈরি করা সম্ভব।
এ ধরনের প্রযুক্তিগুলো আমাদের দেশে আসার জন্য দুই ধরনের পন্থা রয়েছে। প্রথমত, হতে পারে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাই এ ধরনের উদ্ভাবনী গবেষণাকাজে অংশ নেবেন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যই আমরা ব্যবহার করতে পারব; নয়তো অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই বাইরের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত পণ্য আমরা কিনে এনে ব্যবহার করব। আমার মনে হয়, এখন আসলে সময় এসেছে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় অংশ নেওয়া। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা কিন্তু সারা বিশ্বের বিভিন্ন বড় গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার দিকে দিয়ে আমরাও সেরাদের দলে।
আমাদের দেশের প্রচলিত ধারণামতে, বিজ্ঞান গবেষণার জন্য কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। বিষয়টা কিন্তু মোটেও সে রকম কিছু নয়। ইচ্ছা আছে আমি একসময় দেশে ফিরে একটা বায়োলজিক্যাল সেন্সর এক্সিলেন্স সেন্টার তৈরি করব। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ ধরনের গবেষণা আসলে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারবে।
বিজ্ঞানচিন্তা: গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য ছাড়া আর কী কী বিষয়ে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আছে বলে আপনার মনে হয়?
কামরুল হাসান: আমি মনে করি, বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সমস্যাটাও আসলে বড় কোনো বিষয় নয়। আমাদের এখানে আসলে গবেষণার চর্চাটাই গড়ে ওঠেনি। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের গবেষণা না হলেও প্রাথমিক ধাপের কাজ কিন্তু আমাদের দেশে করাই যায়। পানির পিএইচ মাত্রা কত, সেটা জানার জন্য কিন্তু অনেক বড় কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। আমি যখন প্রথম দেশের বাইরে যাই, তখন পিএইচ মিটার ধরলে আমার হাত কাঁপত। কারণ, আমাদের দেশের হাতে–কলমে বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ অনেক কম।
আমাদের দেশে যতটুকু গবেষণার সুযোগ আছে, সেটা পুরোপুরি ব্যবহার করা হয় না। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তখন দেখতাম, সারা বছর গবেষণাগারে তালা দেওয়া থাকত। ধুলা জমে যেত সব যন্ত্রে। পরীক্ষার সময় পিয়ন গিয়ে দরজা খুলে দিত। আবার পরীক্ষা শেষে তালা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হতো। আমাদের এই ছোট গবেষণাগারগুলোর তালা খুলে দিতে হবে। সেগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন হাতে-কলমে মৌলিক বিজ্ঞানের পরীক্ষাগুলো শিখতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে আমাদের মধ্যে যে শঙ্কা, তা অচিরেই দূর করা সম্ভব। সরকারি পর্যায় থেকে আমাদের বিনা মূল্যে যখন বই, খাতা, কলম—গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই দেওয়া হয়, তখন আসলে গবেষণার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা যেন বিজ্ঞান গবেষণায় নিজে থেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেই ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। বিজ্ঞানচিন্তাকে আমি সাধুবাদ জানাই এই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য। আমাদের দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে, তাহলে চাঁদে আর কোনো ব্যক্তির ছবি দেখার সুযোগ থাকবে না। বিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ছাড়া মুক্তি মিলবে না। আমরা আর কত বিজ্ঞান গবেষণার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব? এখনই সময় গুরুত্বসহকারে বিজ্ঞানচর্চা শুরু করার।
আমি বিদেশে বিভিন্ন পাবলিকেশনের সঙ্গে কাজ করি। গত ১১ বছরে আমি বিশ্বের নানা দেশের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীর গবেষণা তত্ত্বাবধানের কাজ করেছি। এখন পর্যন্ত বিশের অধিক প্রবন্ধ বিশ্বের নামীদামি বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশ করেছি, সেসব প্রবন্ধের তথ্য চার শতাধিক বার অন্যান্য প্রবন্ধে উদ্ধৃত করা হয়েছে। কিন্তু এটা ভাবতে খুবই খারাপ লাগে যে, আমি কখনো আমার দেশের কোনো গবেষকের প্রবন্ধ (in Electrochemistry) পাইনি। আমরা যাঁরা বাইরে থাকি, তাঁরা কিন্তু সব সময় দেশের মানুষের কথা ভাবি। দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের যেকোনোভাবে সাহায্য করার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা আগ্রহী থাকেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের যত বাধাই থাকুক না কেন, সেটা টপকে আমাদের সফল হতেই হবে।
বিজ্ঞানচিন্তা: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
কামরুল হাসান: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
*সাক্ষাৎকারটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত ।