দেশের সব প্রান্তেই তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে

সাক্ষাৎকার : মোস্তাফা জব্বার, মাননীয় মন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়
নব্বইয়ের দশকের শেষ সময় থেকে এ দেশের নিজস্ব একটি স্যাটেলাইটের সম্ভাবনা ডালপালা মেলতে শুরু করে। সেই সম্ভাবনাই অবশেষে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। দু-তিনবার তারিখ পেছানোর পর এবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা শহরের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে নিজের কক্ষপথে পাড়ি জমায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের বানানো স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপনে সাহায্য করবে স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস করপোরেশন (স্পেসএক্স)। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট যুগে পা রাখছে বাংলাদেশ। অসাধারণ সম্ভাবনার আদ্যোপান্ত নিয়ে বলেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন পল্লব মোহাইমেন

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বিশেষত্ব কী? এটার কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে কি?

মোস্তাফা জব্বার: সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আসলে অন্যান্য সাধারণ যোগাযোগ স্যাটেলাইটের মতোই। তো কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের এই বিষয়টা বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। এই প্রথম নিজের মতো করে স্যাটেলাইট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। একটু পেছনে ফিরে তাকাতে পারি। ১৯৯৭ সালে সরকার কীভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সফটওয়্যার রপ্তানি করা যায়, সে বিষয়ে একটা কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির প্রধান ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি হিসেবে আমি ওই কমিটিতে থাকার সুযোগ পাই। তখনকার অনেক আলোচনায় নিজেদের একটা স্যাটেলাইট থাকা উচিত বলে একমত হন কমিটির সদস্যরা। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে বিষয়টা আর বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, দেশে আরও বিস্তৃত পরিসরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারকে উপগ্রহের বিষয়টা জানানো হবে। সে সময় বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতিতে সেক্রেটারি ছিলেন মুনিম হোসেন রানা। তিনি তখন দেশে বসে অ্যামেচার রেডিও নিয়ে কাজ করছিলেন। এ অবস্থায় তত্কালীন বিটিটিবিকে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্লট, মানে স্যাটেলাইটের জন্য কক্ষপথ ভাড়া নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রায় ৫০০ ডলার ফি দিলেই তখন আমাদের নিজেদের স্লট পাওয়া যেত। তবে বিটিটিবি একরকম অবহেলা করেই ফি জমা দেয়নি। তাই বর্তমানে আমাদের নিজের স্লট হারিয়ে এখন রাশিয়ার কাছ থেকে স্লটে জায়গা কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

সার্বিকভাবে জাতীয়ভাবে প্রাপ্তির স্থান থেকে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। অন্যদিকে আমাদের দেশের সম্প্রচারমাধ্যমগুলো কিন্তু সম্পূর্ণভাবে অন্য দেশের স্যাটেলাইটগুলোর ওপর নির্ভরশীল। যে যার মতো বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়ে তাদের কাজ চালাচ্ছে। নিজেদের সংস্কৃতি থাকার পরও এভাবে অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকা কিন্তু কোনো দেশের জন্যই কাম্য নয়।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: নিজস্ব স্যাটেলাইটের যে খরচ, তা ১৫ বছর মানে এটির স্থায়িত্বকালের জন্য কি বেশি হয়ে গেল?

মোস্তাফা জব্বার: আমার জানামতে, বছরে দেশের স্যাটেলাইটের ভাড়া হিসেবে অন্য দেশকে প্রায় বছরে ১১০ কোটি টাকা দিই। আমাদের নিজেদের স্যাটেলাইট হলে বাইরের দেশের উপগ্রহগুলোর ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমে আসবে অচিরেই। আমাদের উপগ্রহে মোট ট্রান্সপন্ডার থাকছে ৪০টি, যার ২০টি ব্যবহার করা হবে আমাদের দেশের নিজস্ব কাজে। বাকি ২০টি বাইরের অন্য দেশকে ভাড়া দিতে পারব। একটু ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বলা যায়, একটি স্যাটেলাইট কিন্তু আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদের একটি বিকল্প স্যাটেলাইটের কথাও চিন্তা করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে অন্য একটা দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়েছে, যেন আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোনো কারণে সাময়িক অকেজো হয়ে গেলে আমরা সে দেশের স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে পারি। বুঝতেই পারছেন, মাত্র একটি উপগ্রহ ব্যবহার করে বিরতিহীনভাবে সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং আমাদের দরকার এক জোড়া স্যাটেলাইট। মানে আমাদের অচিরেই বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা যে স্যাটেলাইট স্লট পেয়েছি, তা দিয়ে আমরা প্রায় তুর্কমেনিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক কাভারেজ দিতে পারব। ফলে গোটা বিশ্বের একটা বড় অংশেই আমরা সম্প্রচারমাধ্যম হিসেবে এই স্যাটেলাইট ব্যবহারের সুযোগ পাব। এ ছাড়া গত তিন-চার মাসে আমরা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। আমাদের দেশের অনেক এলাকাতেই আমরা এখনো টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের কেবল নেটওয়ার্ক পৌঁছাতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদেও তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে পারব। এ ছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক যদি কাজ না-ও করে, তবু আমাদের কাছে কিন্তু স্যাটেলাইটের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকবে। সুতরাং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভবিষ্যতে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হবে, সেটার চাহিদা কী রকম?

মোস্তাফা জব্বার: না। এ বিষয়ে আসলে এখন কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। এই মাসে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলেও প্রায় এ বছরের আগস্ট মাস নাগাদ এটি অরবিটে সক্রিয় হবে। এই তিন-চার মাসে আমাদের মার্কেটিং দল পুরো ব্যাপারটি গুছিয়ে নেবে। আগস্ট মাস থেকে স্যাটেলাইট কাজ করা শুরু করলে তখন এ বিষয়ে বিস্তারিত বোঝা যাবে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: তথ্য সম্প্রচার ও যোগাযোগ ছাড়া আর কী ধরনের সেবা পাওয়া যাবে এই স্যাটেলাইট থেকে?

মোস্তাফা জব্বার: স্বাভাবিকভাবেই স্যাটেলাইট থেকে যেসব সেবা পাওয়া যায়, তার সবকিছুই থাকছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো, অর্থাৎ আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্পারসো, বিটিসিএল—সবাই এই স্যাটেলাইটের রিয়াল টাইম তথ্য ব্যবহার করে আরও আধুনিকভাবে সেবা দিতে পারবে। এ ছাড়া ইন্টারনেট তো আছেই। সব মিলিয়ে বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে এই স্যাটেলাইট। থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আমরা যদি বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করতে চাই, তখন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বা শ্রমের প্রয়োজন পড়বে না। এই উপগ্রহের জন্য দুটি আর্থ স্টেশন বানানো হয়েছে বাংলাদেশের গাজীপুর ও রাঙামাটিতে। এগুলো দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে। তখন শুধু নতুন অ্যানটেনা স্থাপন করতে হবে। সার্বিকভাবে দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের জন্য সব রকম সুবিধা বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আর্থ স্টেশনগুলো পরিচালনার জন্য আমরা ইতিমধ্যে ১৮ জন কর্মী নিয়েছি। তাঁদের ফ্রান্সে আরও বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে হাতে-কলমে।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: ভাড়া করা স্যাটেলাইটের থেকেও বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ছে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মোস্তাফা জব্বার: আসলে ভাড়ার যে তুলনা দেখানো হচ্ছে, সেটা কিন্তু ১৫ বছরে তুলে আনা সম্ভব। কিন্তু নিজেদের নিয়ন্ত্রিত একটি যোগাযোগব্যবস্থা গোটা দেশকে আগামী তথ্যপ্রযুক্তির নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে। এ ছাড়া নিজেদের নিরাপত্তা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, তথ্য সংগ্রহ করা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিজেদের দখলে চলে আসবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ৩০টির ওপরে স্যাটেলাইট আছে। সে অনুপাতে টাকার পরিমাণ থেকে আমাদের স্বকীয় অবস্থানটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: বাংলাদেশ এই যে স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করছে, এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

মোস্তাফা জব্বার: ১৯৯৭ সাল থেকেই আসলে আমাদের দেশের প্রযুক্তিবিদেরা স্বপ্ন দেখতেন, আমাদের দেশের নিজস্ব একটি স্যাটেলাইট হবে। আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের এক বিশাল অর্জন। তবে এই গোটা বিষয়টা কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফল। তিনি ১৯৭৩ সালে দেশে প্রথম ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করেন। সেখান থেকেই কিন্তু আমরা আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছেছি। তাঁর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন আমাদের আজকের বাংলাদেশে হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে দেশের সব প্রান্তেই তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। দেশের যেসব এলাকায় মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের লাইন যাচ্ছে, আমরা কিন্তু সেখানেই সাবমেরিন কেবলের একটা অতিরিক্ত অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ দিচ্ছি। তাই দেশের কোনো প্রান্তই আসলে একসময় ইন্টারনেট কাভারেজের বাইরে থাকবে না। আমার জানামতে, ২২৬টি ইউনিয়নে কেবল সংযোগ পৌঁছানো সম্ভব নয়। এসব এলাকায় আমরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সর্বোচ্চ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে?

মোস্তাফা জব্বার: স্যাটেলাইটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে ডিটিএইচ সংযোগগুলো। গ্রাহকেরা তাঁদের বাড়িতে ছোট একটি অ্যানটেনা বসিয়ে স্যাটেলাইট-জগতে প্রবেশ করতে পারবেন। তবে আনন্দের বিষয় হলো, আমরা কিন্তু স্যাটেলাইট-জগতের সদস্য হিসেবে আরও একটা স্যাটেলাইটের কিছু ট্রান্সপন্ডার বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারব। ভারত সাউথ এশিয়ান স্যাটেলাইট নামে কয়েক বছর আগে এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করে। এটি মূলত স্যাটেলাইট-জগতের দেশগুলোর ভেতরে সম্প্রীতি বৃদ্ধির জন্য উপহারস্বরূপ। দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমরা এই স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডারগুলো ব্যবহার করলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ওপরেও চাপ কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

*লেখাটি ২০১৮ বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত