আমের মণ্ড সংরক্ষণ

আম পাকলে তার শাঁস হয় নরম, রসাল ও হলুদ। আম বিভিন্ন ধরনের ক্যারোটিনয়েডের একটি উত্তম উত্স। আমে থাকা কিছু ক্যারোটিনয়েড হলো বিটা ক্যারোটিন, বিটা ক্রিপ্টোক্সথ্যানিন, জিয়াজ্যানিন, লিউটওজ্যানথিন, ভায়োলাজ্যানথিন ও লিউটোজ্যানথিন। এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো বিটা ক্যারোটিন, জাতভেদে যা মোট ক্যারোটিনের ৪৮ থেকে ৮৪ শতাংশ। আমের শাঁসের হলুদ রং সৃষ্টির জন্য দায়ী এই ক্যারোটিনগুলো। বিশেষ করে বিটা ক্যারোটিন। কাঁচা আমে বিটা ক্যারোটিন থাকে খুব সামান্য, পাকার সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। সম্পূর্ণ পাকা আমের শাঁস থেকে তৈরি করা হয় আমের মণ্ড বা পাল্প, আমরা যাকে আমের গোলা বা পিউরি বলি। পাকা আমের মৌসুম যখন ফুরিয়ে যায়, তখন এই মণ্ড আমের স্বাদ মেটায়। শত শত বছর ধরে আমের মণ্ড থেকে তৈরি আমসত্ত্ব এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। আমের গোলা রোদে শুকিয়ে পাতলা পাতের মতো আমসত্ত্ব তৈরি করা হয়, যা ঘরের স্বাভাবিক পরিবেশেও অনেক দিন রেখে খাওয়া যায়। আমসত্ত্ব না বানিয়ে মণ্ডকে প্রক্রিয়াজাত করে রেফ্রিজারেটরে রেখে অনেক দিন পর্যন্ত তা ব্যবহার করা যায়। মণ্ড থেকে তৈরি করা যায় আমের শরবত বা জুস, আইসক্রিম, পিঠা ইত্যাদি। বর্তমানে আমের বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী ও পানীয়, বিশেষ করে ম্যাঙ্গো জুস ও ম্যাঙ্গো বার তৈরি জন্য আমভিত্তিক শিল্পে মণ্ড সংরক্ষণ করে তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কাঁচা আমের টুকরা সেদ্ধ করে নরম করলে তা মণ্ডে পরিণত হয়। তখন সেই মণ্ড ফ্রিজে রেখে পরে তা দিয়ে চাটনি ও আচার তৈরি করা যায়।]

মণ্ড তৈরি

মণ্ড তৈরির জন্য নিতে হয় আঁশবিহীন শাঁসযুক্ত, সুমিষ্ট স্বাদ ও রোগ-পোকা-পচনমুক্ত আম। ভালোভাবে পাকা আম পানিতে ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। শাঁস কেটে টুকরা টুকরা করতে হবে ও আঁটি ফেলে দিতে হয়। কাটা টুকরাগুলো ব্লেন্ডারে দিয়ে গোলা বা মণ্ড তৈরি করে নেওয়া যায়। বেশি পরিমাণে মণ্ড তৈরির জন্য মণ্ড তৈরির যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।

মণ্ড ও শাঁস সংরক্ষণের পদ্ধতি

ঘরোয়া ব্যবহারের জন্য জিপলক ব্যাগে বা পাত্রে মণ্ড পুরে তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়। কৌটায় আমের টুকরা বা শাঁস সংরক্ষণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে কাটা টুকরাগুলোর সঙ্গে চিনি, পানি ও লেবুর রস মিশিয়ে বয়ামে বা কৌটায় সংরক্ষণ করা যায়। এর একটি সহজ কৌশল ও রেসিপি হলো ১৮টি পাকা আম খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা (প্রায় ২.৫ সেন্টিমিটার বা ১ ইঞ্চি) করতে হবে। এর সঙ্গে মেশাতে হবে ১০০ গ্রাম চিনি ও ৪৭০ মিলিলিটার পানি ও ১৮০ মিলিলিটার লেবুর রস। লেবুর রস মানেই সাইট্রিক অ্যাসিড। বয়াম বা কৌটায় টুকরাগুলো এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে টুকরাগুলোর ওপরে ২.৫ থেকে ৫ সেন্টিমিটার তরল দ্রবণ থাকে। সংরক্ষণের জন্য কাচের বয়াম ভালো, ধাতব পাত্র ব্যবহার করা যাবে না।

রাসায়নিক ব্যবহার করে মণ্ড সংরক্ষণ

আমের মণ্ড দ্রুত পচনশীল ও বেশি দিন তা বিশেষ কৌশল ছাড়া সংরক্ষণ করা যায় না। আমের মণ্ড দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন রকমের খাদ্য সংরক্ষক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এসব দ্রব্য মণ্ডের পচনকারী জীবাণু তৈরি হতে বাধা দেয় এবং আমের ভিটামিনগুলোর জারণ বন্ধ করে, স্বাদ, ঘ্রাণ ও রং ঠিক রাখে। বেঞ্জোইক, অ্যাসিটিক, সরবিক ও প্রোপিওনিক অ্যাসিড হলো অন্যতম দুর্বল কিছু খাদ্য সংরক্ষক রাসায়নিক। অন্যদিকে খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয় পটাশিয়াম মেটাবাইসালফেটের মতো কিছু সবল রাসায়নিক। গবেষকেরা দেখেছেন, এই দুর্বল ও সবল রাসায়নিকের সম্মিলন ঘটিয়ে যদি তা দ্বারা আমের মণ্ড সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে প্রায় এক বছর পর্যন্ত সেই মণ্ডের স্বাদ, ঘ্রাণ ও রং ভালো থাকে। ল্যাবরেটরিতে একদল গবেষক পরীক্ষা করে দেখেছেন, পটাশিয়াম সরবেট, সোডিয়াম বেঞ্জোয়েট, পটাশিয়াম মেটাবাইসালফেট পৃথকভাবে অথবা এগুলোর কোনো একটি যদি সোডিয়াম বেঞ্জোয়েট ও সাইট্রিক অ্যাসিডের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়, তাহলে তার কার্যকারিতা বাড়ে। গবেষকেরা চৌষা জাতের আমের মণ্ড শুধু পটাশিয়াম মেটাবাইসালফেট ও পটাশিয়াম সালফেট ব্যবহার না, তার সঙ্গে সাইট্রিক অ্যাসিড মিশিয়ে সংরক্ষণ করে দেখেছেন যে এর ফলে ৪৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত আমের রং, স্বাদ ও ঘ্রাণ অটুট থাকে।

মৃত্যুঞ্জয় রায়