জৈব-অনুঘটন আবিষ্কার পেল রসায়নের নোবেল

২০২১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কোল রিসার্চের পরিচালক বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান। অপ্রতিসম অর্গানোক্যাটালাইসিস বা জৈব-অনুঘটন আবিষ্কারের জন্য তাঁরা এ পুরস্কার পান। এ প্রক্রিয়ায় অপ্রতিসম জৈব অণু তৈরি করা যায়।

প্রথমে একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক, ক্যাটালাইসিস বা অনুঘটন কী? কোনো বিক্রিয়ার হার (মানে, একক সময়ে বিক্রিয়ার গতি) বাড়ানোর পদ্ধতির নাম অনুঘটন।

একটি বিক্রিয়ার শুরুতে শুধু বিক্রিয়ক থাকে। বিক্রিয়া সম্পন্ন হলে তৈরি হয় উৎপাদ। কিন্তু একটা বিক্রিয়া এমনি এমনি হতে পারে না। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনকে একটা পাত্রে পাশাপাশি রেখে দিলে নিজে নিজে বিক্রিয়া করে পানি হয়ে যাবে না। এর পেছনে আছে প্রকৃতির হাত। একটা নির্দিষ্ট শক্তির বাধা পাড়ি দিতে হয় বিক্রিয়কদের। তারপরেই কেবল তারা বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। এ বাধার নাম সক্রিয়ন শক্তি। বাধা পাড়ি দেওয়ার জন্য কিছু একটা করতে হয়। যেমন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে একটা পাত্রে রেখে তার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করতে হবে। বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের ছোঁয়া পেলেই তৈরি হবে পানি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

অনুঘটন প্রক্রিয়ার কাজ হলো বিক্রিয়ার গতি বাড়ানো। মানে, সহজে বিক্রিয়ক বা বিক্রিয়কদের এ বাধাটা পাড়ি দিতে সাহায্য করা। বিক্রিয়া যদি অনেক ধীরে হয়, তাহলে সমস্যা। যে উৎপাদ প্রয়োজন, সেটার এক গ্রাম উৎপন্ন হতে হতে যদি পেরিয়ে যায় বছর, তাহলে তো আর লাভ নেই। সেজন্য তাদের একটি বিকল্প পথে নিয়ে যায় ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবক। মানে, এমন কিছু, বিক্রিয়ায় যে নিজে বদলে যায় না। শুরুতে যা থাকে, শেষেও তা-ই। শুধু বিক্রিয়ার হারটা বাড়িয়ে দেয়। যেমন, দুই অণু হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভেঙ্গে দুই অণু পানি ও এক অণু অক্সিজেন গ্যাস তৈরি হয়। এ বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট যোগ করলে বেড়ে যায় বিক্রিয়ার গতি।

বিজ্ঞানী লিস্ট ও ম্যাকমিলানের গবেষণার আগে আবিষ্কৃত সব প্রভাবককে দুভাগে ভাগ করা যেত। এক, ধাতু এবং দুই, এনজাইম।

ধাতুরা প্রভাবক হিসেবে দারুণ। কারণ, প্রয়োজনে বিক্রিয়ার সময় অস্থায়ীভাবে ইলেকট্রন গ্রহণ করে, তাদেরকে নিজের কক্ষপথে জায়গা দিতে পারে ধাতু। কিন্তু এমনিতে ধাতুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো, ধাতু ইলেকট্রন ছেড়ে দিতে পারে। ফলে কোনো অণুর মধ্যকার বন্ধন হালকা হয়ে যায়। এ কারণে যে বন্ধন সহজে ভাঙ্গত না, তা সহজে ভেঙ্গে যায় ও বিক্রিয়ার গতি বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন

এনজাইম হলো জৈব বিক্রিয়ার প্রভাবক। এরা প্রোটন দিয়ে তৈরি। জীবদেহে হাজারো এনজাইম আছে। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রণ করে এসব এনজাইম।

বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট ও ডেভিড ম্যাকমিলান আলাদাভাবে তৃতীয় এক ধরনের অনুঘটন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তাঁরা একে অন্যের কাজের কথা জানতেন না। এই প্রক্রিয়ার নাম, অ্যাসিমেট্রিক অর্গানোক্যাটালাইসিস বা অপ্রতিসম জৈব-অনুঘটন। এক্ষেত্রে অতিক্ষুদ্র জৈব অণু প্রভাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এসব জৈব প্রভাবকের ভেতরে কার্বন পরমাণুর একটি স্থিতিশীল অবকাঠামো থাকে। অন্যান্য সক্রিয় রাসায়নিক গ্রুপ বা মূলক কিংবা আয়ন এর সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারে। যেমন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার ইত্যাদি। তার মানে, এসব প্রভাবক উৎপাদনের খরচ যেমন কম, তেমনি এরা পরিবেশবান্ধব।

বর্তমানে জৈব প্রভাবকের ব্যবহার এত বাড়ার কারণ, অপ্রতিসম জৈব-অনুঘটনে এসব প্রভাবকের কার্যকারিতা। জৈব অণু উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, দুটি ভিন্ন ধরনের অণু তৈরি হয়েছে। যারা দেখতে একে অন্যের মিরর ইমেজ বা দর্পন প্রতিবিম্বের মতো। রসায়নবিদরা বেশিরভাগ সময় এই দুটির কেবল একটি উৎপাদন করতে চান। বিশেষ করে ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে। এই যে দুটো প্রতিসম অণু তৈরির বদলে কেবল একটি উৎপাদন, এজন্যই এর নাম অপ্রতিসম জৈব-অনুঘটন। এই প্রক্রিয়ায় নতুন ধরনের অণু বেশ কার্যকর ও দ্রুত উৎপাদন করা যায়। যেমন, এ প্রক্রিয়ায় জটিল জৈব অণু স্ট্রিকনিন এখন ৭ হাজার গুণ দ্রুত তৈরি করা যায়!

২০২১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জার্মানির বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান।
মিজান স্বপন

২০০০ সাল থেকে জৈব-অনুঘটনের উন্নতি ঘটেছে অতিদ্রুত। কিন্তু বিজ্ঞানী লিস্ট ও ম্যাকমিলান এখনও তাঁদের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন বাকি সবার চেয়ে। তাঁদের কাজের ওপর নির্ভর করে ওষুধ থেকে শুরু করে সোলার সেল বা সৌরকোষে আলো ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অণু—সবই বানানো যাচ্ছে দ্রুত ও কার্যকরভাবে। সেজন্যই তাঁদের কাজ এত গুরুত্বপূর্ণ।

এ গুরুত্বের স্বীকৃতি হিসেবে বুধবার (৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে তাঁদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রসায়ন নোবেল কমিটি। বিজ্ঞানী দুজন এ পুরস্কারের অর্থমূল্য অর্ধেক করে ভাগ করে নেবেন।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ