ট্র্যাজেডি অব কমনস

এক অজপাড়াগাঁয়ের গল্প। দিনের পর দিন তাদের মাটির তৈরি কাঁচা রাস্তা ব্যবহার করে চলাচল করতে হয়, শহরে যেতে হয়। বৃষ্টি হলেই কাদা জমে রাস্তার বারোটা বাজে, চলাচলে ভীষণ কষ্ট। একদিন কাঁচা রাস্তাটায় ইট বিছিয়ে আধা পাকা করা হলো। শান্তিতে চলাচল করতে পারছে এলাকার লোকজন। সন্তুষ্ট সবাই। তবে রাস্তা কিছুটা পাকা হলেও রাস্তার বাড়িঘরগুলো তো কাঁচা। বৃষ্টিতে কদম আলীর ঘরের চালা চুইয়ে পানি পড়ে। স্যাঁতসেঁতে হয় মেঝে। সে ভাবে, যদি এখানেও কিছু ইট বিছিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে দূর হবে এই ভোগান্তি। সরকারি সম্পত্তি রাস্তাই তো আছে। রাস্তায় জনগণের সম্পদ পড়ে থাকতে পয়সা খরচ করে কেনার কী দরকার? তাই রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসে কিছু ইট।

এ ঘটনা আবার দেখেছে এলাকার লোকজন। প্রথমে তাকে বাধা দেয়। কিন্তু কদম আলীর যুক্তির জবাব তাদের কাছে নেই। খুবই অকাট্য জবাব! আর বাধা দিতে পারে না লোকজন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সন্তুষ্টও হতে পারে না তারা। কদম আলীর মতো লোক দিনদুপুরে ইট তুলে নিয়ে যাবে, আর তারা থাকবে হাত গুটিয়ে? সরকারের এই সম্পত্তিতে তো অধিকার তাদেরও আছে।

তাই হুড়াহুড়ি পড়ে যায়। সবাই রাস্তা থেকে ইট তুলে আনে অল্প অল্প করে। একসময় দেখা যায় রাস্তায় আর কোনো ইটই নেই। ফল হয় মারাত্মক। রাস্তা এখন আগের চেয়েও জঘন্য। ফলে অল্প কিছু লাভ ঘরে তুলতে গিয়ে বরণ করতে হয় অপূরণীয় ক্ষতি। গণিত, অর্থনীতি কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাপারটিকে বলা হয় ‘ট্র্যাজেডি অব কমনস’ বা সর্বলোকের দুর্ভাগ্য। সবাই অল্প অল্প করে লাভ করতে চায় কিন্তু দিনশেষে দেখে তাদের প্রত্যেকেই হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত।

এক দাদা তার নাতির সঙ্গে গল্প করছিলেন গাঁয়ের একটা বিল নিয়ে। অনেক দিন আগের কথা, গ্রামে মানুষ ছিল কম। বিলভর্তি মাছ। একদিন রাতে কনুই জাল নিয়ে গেলেন মাছ ধরতে। জালে প্রচুর মাছ উঠেছে—এত বেশি, সেগুলো বয়ে আনা তাঁর পক্ষে কঠিন। তাই অল্প কিছু মাছ নিয়ে বাকিগুলো ছেড়ে এলেন। বিলেই থাকুক, পরে কোনো দিন আবার ধরা যাবে, বিল তো আর চুরি হচ্ছে না।

দৃশ্যটি একটা সময় পর্যন্ত অনেক গ্রামেই স্বাভাবিক ছিল। এখন আর খাল–বিলে সেই মাছ নেই। জালে অনেক মাছ উঠলে এখন আর কেউ অতিরিক্ত মাছ বিলে ছেড়ে আসে না। এমনকি ছোট্ট পোনাটিকেও ধরে আনে। আজ খাল–বিলে-নদীতে যিনি মাছ ধরেন, তিনি ভাবেন, যে মাছ জালে উঠেছে, তার কিছু ছেড়ে দিলে তাঁর কোনো লাভ নেই। অন্যরা ঠিকই ধরে নিয়ে যাবে। তাই যা উঠে জালে, চেঁছেপুঁছে ধরে আনেন।

একই চিন্তা অন্য জেলেরাও নিশ্চয়ই করেন। সবাই নিজের একটু বেশি লাভের আশায় সব মাছ ধরে আনছেন। ঘুরেফিরে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কেউই কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না, তার মানে নিজেও কারও কাছ থেকে ছাড় পাচ্ছেন না। অথচ সবাই যদি মেনে নেন, আজ পোনা মাছটিকে ছেড়ে দিলে সেটি আগামীকাল পূর্ণাঙ্গ মাছ হয়ে অন্যের জালে ধরা দেবে, আর অন্যের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া পোনা কোনো একদিন আমার জালে বড় মাছ হয়ে ধরা দেবে, তাহলে সব জেলেরই সুদিন থাকে। অথচ এখন দেখা যায়, জেলেরা সারা দিন জাল টেনেও পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছেন না।

সবাই একটু একটু করে বেশি নিতে চান। কিন্তু দিন শেষে দেখেন, কোনো এক আশ্চর্য কারণে তাঁরা প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এগুলোর সবই হচ্ছে সর্বলোকের দুর্ভাগ্যের নিয়মে।

প্রথম ট্র্যাজেডি অব কমনসের ধারণা দেন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ফর্স্টার লয়েড। ১৮৩৩ সালে। গ্রামের একটি চারণভূমিতে সবাই মিলে গরু চরালে ফলাফল কী হবে, তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই ধারণা আসে তাঁর মাথায়। এরপর দীর্ঘদিন ধারণাটি বইয়ের পাতাতেই চাপা পড়ে থাকে। প্রায় এক শতাব্দী পর পরিবেশ ও প্রাণিবিদ গ্যারেট হার্ডিন এই ধারণাটিকে আবার জীবিত করে তোলেন। বহু মানুষ যখন আলাদাভাবে একটিমাত্র উৎসে থাকা সীমিত কোনো সম্পদ ব্যবহার করে, তখন কী ঘটে, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই ধারণাটি আবার জনসমক্ষে আসে এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

গাঁয়ের সেই জেলে কিংবা অজপাড়াগাঁয়ের সেই কদম আলী আর তার পাড়াপড়শিরাই শুধু এ রকম বোকামি করছে বলে ভাবলে ভুল হবে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমরা সবাই এ রকম ভুল করে চলছি। এমনকি আপনি নিজেও। কীভাবে?

ভেবে দেখুন, কোনো অসুখে কখনো অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেছেন কি না। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের মাধ্যমে আপনি হয়তো স্বল্প সময়ে সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে জীবাণুগুলোকে করছেন শক্তিশালী। যদি কোনোভাবে জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তারা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। যদি সেগুলো পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে আর মানুষকে আক্রান্ত করে, তাহলে কোনো ব্যক্তির বেলাতেই সেই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। এ ব্যাপারগুলো অহরহ হচ্ছে। এমন সব জীবাণুর জন্ম হচ্ছে, যেগুলোকে প্রচলিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ধরনের জীবাণুকে বলা হয় সুপারবাগ। এরা যদি মহামারির জন্ম দেয় আর তার জন্য যদি কোনো প্রতিষেধক তৈরি করা না যায়, তাহলে পৃথিবীতে মানবসভ্যতার অবস্থা কী হবে?

প্রত্যেকেই ভাবছেন, অন্যরা তো ঠিকই অ্যান্টিবায়োটিক নিচ্ছে, আমি বাদ থাকলেই বা কী আসে যায়? স্বল্প মেয়াদে প্রত্যেকেই লাভবান হচ্ছে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই ব্যাপারগুলো প্রতিনিয়তই ঘটছে সমাজে, রাষ্ট্রে ও পরিবেশে। প্রতিটা দিক থেকেই অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সমাজের ব্যাপারে একটি শহরের কথা কল্পনা করুন। ঢাকা শহরের দিকেই দেখুন না। ভবন তৈরির বেলায় নিয়ম হচ্ছে চারদিকে কয়েক ফুট জায়গা খালি রাখতে হবে। তাহলে পরিবেশ থাকবে সুস্থ, আর সেই সুস্থতার ফল পাবে সবাই। এখন কেউ কেউ ভাবছে, অন্যরা ফাঁকা জায়গা রাখলে রাখুক, আমি রাখব না। এই জায়গাগুলো আমি একাই ভোগ করব। তা দেখে অন্যরাও ভাবছে, অমুক তো আমাদের ছাড় দিচ্ছে না, আমরা কেন দেব? এভাবে ভাবতে শুরু করে সবাই। রাস্তাগুলো ঘিঞ্জি গলিতে পরিণত হয়। বাতাস চলাচল করতে পারে না। দুর্গন্ধ আর জলাবদ্ধতা লেগে থাকে সব সময়। যানবাহনগুলো চলতে না পেরে লেগে থাকে জ্যাম।

পানি যদি আটকে থাকে, তার ফলাফল কি একজন ভোগ করবে? জ্যাম কি একজনের জন্য ভোগান্তি? মূলত প্রত্যেকের ভাগ্যেই রয়েছে এসবের ভোগান্তি। শুরু থেকে প্রত্যেকেই যদি ছাড় দেওয়ার কথা ভাবত, তাহলে তার সুবিধা ভোগ করত সবাই। স্বল্প মেয়াদে স্বতন্ত্রভাবে কেউ কেউ লাভবান হলেও, লাভ করলেও প্রত্যেকেই আসলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বলোকের দুর্ভাগ্যের ফল ভোগ করতে হচ্ছে সবাইকে।

রাষ্ট্রের কথা ভাবুন। প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই যুদ্ধের সরঞ্জাম আছে। অস্ত্র কেনা আর অস্ত্র বিক্রির চলছে প্রতিযোগিতা। যে অস্ত্র যত বেশি মানুষ মারতে পারবে, যত বেশি ধ্বংস করতে পারবে, তার মূল্য তত বেশি, তার চাহিদা তত বেশি। কিন্তু অন্যদিকে প্রত্যেকেই বলে তারা যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। সবাই যেখানে শান্তি চাইছে, সেখানে অস্ত্রের আর ধ্বংসের এত জয়জয়কার কেন? প্রত্যেকেই অস্ত্র রাখছে, কারণ তারা ভাবছে, পাশের কোনো দেশ তাকে আক্রমণ করতে পারে। আক্রমণের দাঁতভাঙা জবাব দিতে তাই বাড়াচ্ছে অস্ত্রের মজুত। অন্যদিকে পাশের দেশটিও শঙ্কায় ভুগছে। ফলে তারাও বাড়াচ্ছে অস্ত্রের মজুত। প্রত্যেকেই নিজেদের নিরাপদে রাখার জন্য কমবেশি অস্ত্র রাখছে, কিন্তু দিন শেষে প্রত্যেকেই অনিরাপত্তায় ভুগছে, প্রত্যেকেই যুদ্ধের ভয়াবহতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেসব দেশ শান্তি চায়, তারা সবাই যদি অস্ত্র বর্জন করে, তাহলে এই পৃথিবীতে থাকে না কোনো যুদ্ধের কলঙ্ক।

পরিবেশের দিকে তাকান। কার্বন নিঃসরণের কারণে পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বিপর্যয়। সব রাষ্ট্রের সব সচেতন নাগরিকই সেটা জানে। কিন্তু জানার পরও গাড়িঘোড়া কিংবা অন্যান্য উপায়ে তেল-গ্যাস পুড়িয়ে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে। কার্বন তাপ ধরে রাখতে পারে, ফলে উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। ঘটছে অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গলে যাচ্ছে মেরুর বরফ, তলিয়ে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে নিচু দেশগুলো। কিন্তু স্বয়ং নিচু দেশগুলোর লোকেরাই ভাবছে, আমি কেন তেল-গ্যাস পুড়িয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নেব না? আমি সুবিধা না নিলেও অন্যরা তো ঠিকই নিচ্ছে, আমি একজন সচেতন হলেও তো পরিবেশ হুমকিতেই আছে। তার চেয়ে বরং ভোগ করেই যাই। এমন ভাবনা সবারই। কিন্তু দিন শেষে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, সুনামি, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ইত্যাদির ভোগান্তিতে সবাই ভুগছে।

স্বার্থপরের মতো নিজে কিছু ভোগ করলে আসলে তার ফলাফল নিজেকেই ভোগ করতে হয়। পরিবেশের ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। ট্র্যাজেডি অব কমনস বা সর্বলোকের দুর্ভাগ্য থেকে একটি নীতিবাক্য বলা যায়, স্বল্প মেয়াদে কেউ লাভবান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে প্রত্যেককেই পস্তাতে হয়। আবার স্বল্প মেয়াদে কেউ ক্ষতি স্বীকার করে নিলেও দীর্ঘ মেয়াদে সবাই লাভবান হয়।

প্রকৃতির নিয়ম আর গণিতের নিয়ম অমোঘ। কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। গণিতকে অমান্য করে, প্রকৃতির নিয়মকে এড়িয়ে গিয়ে কিছু করলে একসময় না একসময় তার ফলাফল ভোগ করতেই হবে। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক হওয়া। অন্যকে শুদ্ধ হতে উৎসাহ দেওয়ার প্রথম ধাপই হলো নিজে শুদ্ধ হওয়া। যে বিষয়গুলো সবার স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, সেগুলোতে সবাই যদি সচেতন হই, তাহলেই তৈরি হবে একটি চমৎকার পৃথিবী।

সূত্র: টেড এড, সায়েন্স ম্যাগাজিন