মাস্ক দুষণে অশণি সংকেত

সারা বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম, বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২০০ টন চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, যার অধিকাংশই ডিসপোজাল মাস্ক। এসব কোনো না কোনো প্লাস্টিক মাইক্রোফাইবার থেকে তৈরি করা হয়।

সম্প্রতি হংকংয়ের সমুদ্র সৈকতের ১০০ মিটারের মতো জায়াগায় অন্তত ৭০টা মাস্ক সংগ্রহ করা হয়েছে। পরের এক সপ্তাহের মধ্যে পাওয়া গেছে আরও প্রায় ৩০টি মাস্ক। হংকংভিত্তিক সমুদ্র সংরক্ষণ সংস্থা 'ওশানস এশিয়া' সম্প্রতি একটা জরিপ করেছে। জরিপের ফল বলছে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১৫৬ কোটি মাস্ক বিভিন্ন সাগর-মহাসাগরের তলদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, যা প্রায় ৪৬৮০-৬২৪০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্যের সমতূল্য।

সাউদার্ন ডেনমার্ক ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল টক্সিকোলজিস্ট এলভিস জেনকো জু এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ঝিয়ং জেসন রেন সম্প্রতি এক গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ফ্রন্টিয়ার্স অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। তারা বলছেন, ডিসপোজাল মাস্কের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা উচিৎ, তাহলে হয়তো প্লাস্টিক বর্জ্যের মতো আরেকটা গুরুতর সমস্যা থেকে পরিবেশকে বাঁচানো যাবে।

তাঁরা জানাচ্ছেন, ডিসপোজাল মাস্ক প্লাস্টিক পণ্য, যা সহজে পঁচে মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। এগুলো ভেঙে দ্রুত ছোট-ছোট প্লাস্টিক কণায় বিভক্ত হতে পারে। সুতরাং মাস্ক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে দিচ্ছে, এর ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

বর্তমানে বিশ্বে প্লাস্টিক বোতলের প্রায় সমপরিমাণ মাস্ক উৎপাদিত হচ্ছে। মাস্ক প্লাস্টিক বোতল থেকে আলাদা (প্রায় ২৫% পুনর্ব্যবহারযোগ্য)। তারপরও পুনর্ব্যবহারের ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বা হচ্ছে না। ফলে মাস্ক দুষণের বিষয়টি বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।

অনেক সময় সমুদ্রের বিভিন্ন প্রাণীরা মাস্ককে খাবার বা শিকার ভেবে ভুল করছে এবং সেগুলো গিলে ফেলছে। ফলাফল, হজমে বিপাক এবং মৃত্যু। তাছাড়া অনেক ছোট ছোট প্রাণীও এসব মাস্কে জড়িয়ে পড়ে মারা পড়ছে।

মাস্ক যদি পুনর্ব্যবহারযোগ্য না করা যায়, অন্যান্য প্লাস্টিকের মতোই পুনর্ব্যবহার অযোগ্য থেকে যায়, তাহলে এগুলো স্থলভাগ, মিঠাপানি এবং সমুদ্রে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়বে। সেগুলো ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিক (৫ মিলিমিটার থেকে ছোট) এবং ন্যানো প্লাস্টিক (১ মাইক্রোমিটার থেকে ছোট) কণায় রূপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে বাতাসে। বায়ুদূষণ পৌঁছাবে চরম মাত্রায়।

মাস্ক দূষণ সমাধানে ডিসপোজেবল মাস্কের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।

বড় একটা উদ্বেগের বিষয় হলো, এখন এসব মাস্ক সরাসরি মাইক্রোসাইজড (১-১০ মাইক্রোমিটার পুরু) প্লাস্টিকের ফাইবার দিয়ে তৈরি। ফলে এটি যখন পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন দ্রুত ও সহজেই আরও ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়। এগুলো প্লাস্টিক ব্যাগের কণার চেয়েও অনেক দ্রুত ছড়ায়। ভবিষ্যতে এই ব্যাপারটি আরও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ সময়ের সঙ্গে হয়তো আরও ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা দিয়ে মাস্ক তৈরি করা হবে।

যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. সার্প বলেন, মাস্ক নিয়ে আমাদের আরও বেশি গবেষণা করতে হবে। কারণ মাস্কের যে বিশাল উপকারিতা, এজন্য ভবিষ্যতেও আমাদের হয়তো মাস্ক পরিধান করতে হবে। তবে মাস্ক ব্যবহারের নিয়ম এবং মাস্কের মানোন্নয়ন এবং মাস্কে ব্যবহৃত উপাদানের গুণগতমানের দিকে নজর দেওয়া উচিত।

ড. সার্প আরও বলেন, জনসাধারণকে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ও নিশ্চিত করতে হবে যে এগুলো ব্যক্তি এবং পরিবেশের জন্য নিরাপদ।

তাহলে এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? বেশ কিছু উপায় আছে, সেগুলো মেনে চললে মাস্ক দুষণের হাত থেকে হয়তো মুক্তি পাওয়া যাবে। যেমন, বায়োডিগ্রেডেবল মাস্ক নিয়ে আরও বেশি গবেষণা করা জরুরি। ডিসপোজেবল মাস্কের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, কটন ফাইবারের তৈরি মাস্ক অর্থাৎ কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। তবে শুধু বিকল্প মাস্কই নয়, মাস্ক থেকে তৈরি বর্জ্যের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নির্দেশিকা এবং প্রয়োগ কঠোরভাবে নিশ্চিত করা জরুরি। যদি ডিসপোজেবল মাস্ক ব্যবহার জরুরিই হয়, তাহলে ব্যবহার শেষে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। যেখানে-সেখানে ফেলা মোটেও উচিৎ হবে না। কখনো ডিসপোজেবল মাস্ক রিসাইক্লিং করার উচিৎ হবে না, কারণ বিভিন্ন ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণা মেশিনের সঙ্গে থেকে যেতে পারে। ফলে পরিবেশ এবং কর্মীদের শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত রসায়ন এবং কেমিকৌশল বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

সুত্র: ডেইলি সাইন্স ও দি কনভারসেশন ডটকম