রসায়নের দুই রূপকথকের গল্প

রসায়নে নোবেলজয়ী দুই বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট (বামে) ও ডেভিড ম্যাকমিলাননোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি

জৈব অণু আবিষ্কারের জন্য জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কোল রিসার্চের পরিচালক বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান এ বছর রসায়নে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁরা এমন একটি জৈব অণু আবিষ্কার করেন, যা জীববিজ্ঞানের অনেক জটিল এনজাইম বা অনুঘটকের মতো কার্যকরী অণু তৈরির গতি বাড়ায়।

তাঁদের নোবেল বিজয় সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চের রসায়নবিদ ডোনা ব্ল্যাকমন্ড বলেন, 'এটি ক্যাটালাইসিস এবং জৈব রসায়নের জন্য একটি ভাল দিন।'

এই স্ক্রিপস রিসার্চ ল্যাবেই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিস্ট নব্বইয়ের দশকে জৈব ক্যাটালাইসিস নিয়ে যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন।

লিস্ট এবং ম্যাকমিলানের গবেষণার আগে, বেশিরভাগ অনুঘটকই ছিল ধাতুভিত্তিক এবং বড় জৈবিক এনজাইম ধারণকারী অপেক্ষাকৃত ছোট অণু। অনুঘটকগুলোতে ইলেকট্রন ধরে রাখা এবং চলাচলের জন্য ধাতব পরমাণুগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটাই অণুগুলোর মধ্যে পারমাণবিক বন্ধনগুলো শিথিল এবং পুনর্বিন্যাসের অন্যতম চাবিকাঠি। অণুগুলোর ভেতরের পারমাণবিক বন্ধন শিথিল হওয়ার কারণে তা সহজে ভেঙে যায় ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বেড়ে যায় বহুগুণ। এজন্য ধাতু-ভিত্তিক অনুঘটক বেশ কার্যকর।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির রসায়নবিদ স্টিফেন বাখওয়াল্ড বলেন, 'ধাতুভিত্তিক অনুঘটক বিক্রিয়ার সঙ্গে অতিরিক্ত যৌগ নিয়ে আসে। সেই যৌগ বিষাক্ত হতে পারে এবং প্রায়ই দেখা যায় সংশোধনকরা যৌগগুলোর সাথে শক্তভাবে আবদ্ধ থাকে। ফলে কাঙ্ক্ষিত যৌগকে আলাদা করতে বেশ বেগ পেতে হয়। জৈব অণুগুলো কার্বন পরমাণু ধারণ করে বলে সাধারণত কম ক্ষতিকর, যদিও সচরাচর এরা নিম্নমানের অনুঘটক। তুলনা করে দেখা গেছে, অনুঘটক হিসেবে ধাতু উৎকৃষ্ট হলেও পরিবেশবান্ধব নয়, অপরদিকে জৈব অণুগুলো নিম্নমানের অনুঘটক হলেও পরিবেশবান্ধব। গবেষকেরা প্রতিটি ধাতব অনুঘটককে একটি জৈব অণু দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারেন, তবে এটি একটি ঐতিহাসিক কাজ হবে।'

প্রকৃতিতে এমন অনেক এনজাইমই আছে, যাদের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য প্রভাবক হিসেবে ধাতুর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এই এনজাইমগুলো সাধারণত জটিল আকারের বৃহৎ অণু। এগুলো সিন্থেটিক বিক্রিয়াগুলোকে গতিশীল করতে বাইরের কোষ ব্যবহার কঠিন করে তোলে। বিজ্ঞানী লিস্ট এই জৈবিক অণুগুলোর মধ্যেই তাঁর কাজের মূল অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। কার্লোস বার্বাসের অধীনে স্ক্রিপস ল্যাবে পোস্টডক্টরাল সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। সে সময় লিস্ট ক্যাটালাইটিক অ্যান্টিবডি নামে নতুন একটি এনজাইম তৈরি করছিলেন। সাধারণত ইমিউন সিস্টেম অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সেটা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেহে অনুপ্রবেশকারীদের অপসারণ করতে সাহায্য করে। এরই সূত্র ধরে লিস্ট এবং বার্বাস ক্যাটালাইটিক অ্যান্টিবডি সংশ্লেষণ করেন, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়াতে সক্ষম।

বিজ্ঞানী লিস্ট একটা জিনিস দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। তিনে দেখেন এই অ্যান্টিবডিগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ একক অ্যামিনো অ্যাসিড বিল্ডিং ব্লক আছে। সেটা পুরো এনজাইমের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করে। সত্তরের দশকে গবেষকরা দেখিয়েছিলেন, প্রোলিন নামে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসেবে আচরণ করে। সেটির কার্যকারিতা উল্লেখ করার মতন হলেও সেটার কথা বিজ্ঞানীরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন! লিস্ট, বার্বাস এবং অনুঘটক অ্যান্টিবডির অগ্রদূত রিচার্ড লার্নার দেখিয়েছেন, প্রোলিন সরাসরি দুটি অণুর কার্বন পরমাণুগুলোকে অপ্রতিসম বিক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে পারে। ফলে দুটি সম্ভাব্য মিরর ইমেজ যৌগের কেবল একটি তৈরি হয়। রসায়নবিদেরা বেশিরভাগ সময়, বিশেষ করে ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে এই দুটি মিরর ইমেজ যৌগের কেবল একটি উৎপাদন করতে চান। সেক্ষেত্রে তাঁদের এই কাজটি যুগান্তকারী ফলাফল বয়ে আনে। কার্লোস বার্বাস ২০১৪ সালে মারা যান, তাই এ বছর পুরস্কারের জন্য তার নাম আসেনি, সেটাই স্বাভাবিক।

অন্যদিকে, ম্যাকমিলান এক সময় ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি একটি ধাতব যৌগ তৈরি করছিলেন। যা অপ্রতিসম অর্গানোক্যাটালাইসিস বা জৈব-অনুঘটন করেছিল। কিন্তু অক্সিজেন বা পানির সংস্পর্শে এলে ধাতুগুলো প্রায়ই অকেজো হয়ে যেত। ফলে শিল্প-কারখানায় এগুলো ব্যবহার রোধ করে। সুতরাং তিনি ধাতুমুক্ত জৈব যৌগ ডিজাইন করার চেষ্টা করেছিলেন, যা একই ধরনের কাজ করতে সক্ষম। এটা অবিকল লিস্টের প্রোলিন পরীক্ষার মতো ছিল বলে, ম্যাকমিলান দ্রুত সাফল্যও পেয়েছিলেন। তিনি একটি নমুনায় পরিচিত অনুঘটকে তামার পরমাণু ব্যবহার করেন। এই পরমাণুগুলোকে তিনি একটি নাইট্রোজেন এবং একটি হাইড্রোকার্বন রিং দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তার তৈরি এ যৌগটি একটি রিং-গঠনের বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অণুর পছন্দসই মিরর ইমেজ সংস্করণ পাওয়া যায়। বর্তমানে এই ধরনের অপ্রতিসম বিক্রিয়া ওষুধ শিল্পের একটি প্রধান ভিত্তি। এখানে একটি মিরর ইমেজ যৌগ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে, আবার তার প্রতিফলক মিরর ইমেজ বিষাক্তও হতে পারে।

২০০০ সালে লিস্ট এবং ম্যাকমিলানের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়। দ্রুতই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র জৈব অণু রাসায়নিক বিক্রয়াগুলোর আরও বড় পরিসরে অনুঘটন/ক্যাটালাইসিস করতে পারে। নেদারল্যান্ডের র‍্যাডবাউড বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নবিদ ফ্লোরিস রুটজেস বলেছেন, ‌'তাঁদের নিবন্ধ থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে, অর্গানোক্যাটালাইসিস আরও সাধারণ হতে পারে। ফলে অনেক গবেষক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।' লিস্ট এবং ম্যাকমিলানের প্রকাশিত গবেষণালব্ধ ফলাফল অর্গানোক্যাটালাইসিস বা জৈব-অনুঘটন ফিল্ডে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করেছে।

সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে নোবেল কমিটি ধাতুভিত্তিক যৌগ এবং এনজাইমের সাথে জৈব অণুগুলোকে ক্যাটালাইসিসের তৃতীয় স্তম্ভ হিসাবে বর্ণনা করেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নবিদ এবং রসায়নের নোবেল কমিটির সদস্য পিটার সোমফাই বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্গানোক্যাটালাইসিসের জন্য অনেক কম পদক্ষেপের প্রয়োজন হয় এবং প্রচলিত অনুঘটকের ক্যাটালাইসিসের তুলনায় এটি পরিবেশবান্ধব।'

গবেষকেরা লিস্ট ও ম্যাকমিলানের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে অর্গানোক্যাটালিস্ট তৈরিতে কাজ করেছেন। সেগুলো উদ্বেগ ও বিষণ্নতা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্যারোক্সেটিন, ওসেল্টামিভিরসহ কয়েক ডজন ওষুধ উৎপাদনে সহায়তা করেছে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, অপ্রতিসম অর্গানোক্যাটালাইসিস বা জৈব-অনুঘটন একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।

নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে বিজ্ঞানী লিস্টকে জিজ্ঞস করা হয়েছিল, গবেষণার প্রায় বিশ বছর পর কেন এই সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন? জবাবে লিস্ট জানান, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গবেষণায় অর্গানোক্যাটালিস্টের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। অর্গানোক্যাটালিস্ট বা জৈব অণুর সাহায্যে আপনি এখন এমন কিছু করতে পারেন, যা এনজাইম কিংবা অত্যাধুনিক মেটাল কমপ্লেক্স দিয়েও করতে পারেন না। এটাই হলো আমাদের আবিষ্কারের গুরুত্বপূর্ণ দিক।'

লিস্ট ও ম্যাকমিলানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে শুরু করে সুগন্ধি বস্তু তৈরির ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সুতরং এ বছল রসায়নে নোবেল পুরস্কার যে যোগ্য হাতেই উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, ঢাকা