দ্য ম্যান হু কাউন্টেড ৫

চার চারের কারিশমা

আমাদের প্রথমবার বাজারের যাওয়ার গল্প। বেরেমিজ ও নীল পাগড়ির কাহিনি। চারটি চারের ঘটনা। পঞ্চাশ দিনারের সমস্যা। সমস্যার সমধান করে বেরেমিজের সুন্দর উপহার পাওয়ার গল্প।

কয়েক দিন পরের ঘটনা। উজিরের অফিসের কাজ শেষ করে বাজার ও বাগদাদের বাগানে ঘুরতে বের হলাম। সেদিন বিকেলে কোলাহলটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর কারণ কয়েক ঘণ্টা আগেই দামেস্ক শহর থেকে কিছু ধনী কাফেলা এসে পৌঁছেছে। কাফেলার আগমন ঘটলে সবসময় সবাই প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠত। অন্য দেশে কী জিনিস তৈরি হচ্ছে তা জানার এটাই একমাত্র উপায়। ভিনদেশী ব্যবসায়ীদের সাথেও মেশার সুযোগ আসে এর মাধ্যমে।

জুতার বাজারে তো প্রবেশ করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কি খালি জায়গা, কি দোকান—সর্বত্র নতুন নতুন পণ্যের বস্তা ও বাক্সের ছড়াছড়ি। দামেস্কের লোকেরা বড় বড় রংবেরংয়ের পাগড়ি ও কোমরে অনুশীলনের অস্ত্র নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উদাসীনভাবে দেখছে এ দোকান, সে দোকান। ধূপ, জর্দা ও মসলার তীব্র গন্ধ চারদিকে। সবজিবিক্রেতারা মারাত্মক রকম ঝগড়া করছে। অপমান করছে একে অন্যকে। মসুলের একজন তরুণ গিটারবাদক বস্তার উপর বসে বিমর্ষ ও একঘেয়ে সুরে গান গাইছে:

মানুষের জীবনের গুরুত্বই বা কী?

যদি মানুষ বেঁচে থাকে সম্ভাব্য সবচেয়ে সরলভাবে

সে ভাল বা খারাপ যাই হোক

আমার কথা এ পর্যন্তই

দোকানদাররা দোকানের সামনেও পণ্য সাজিয়ে রেখেছে। আরবদের উর্বর চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে নিজের অধিকার বেশি করে আদায় করছে।

‘এই দেখুন, এই জামাটা একজন আমিরের গায়েই মানায়!’

‘বন্ধুগণ, দারুণ এই সুগন্ধি আপনাকে স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দেবে।’

একটি রুচিশীল নীল পাগড়ি বেরেমিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কুঁজো এক সিরীয় লোক চার দিনারে সেটা বিক্রি করছিল। এই দোকানীর ঘরটাও ছিল একটু ব্যতিক্রমী। এখানের সবকিছু—পাগড়ি, বাক্স, খঞ্জর, চুড়ি ইত্যাদি—সবকিছুর দাম চার দিনার করে। উজ্জ্বল বর্ণে একটি ব্যানার লেখা।

আরও পড়ুন

এটা দেখে বেরেমিজ পাগড়িটা কিনতে আগ্রহী হলেন। বললাম, ‘এমন অপব্যয় পাগলামি ছাড়া কিছু না। আমাদের কাছে অল্প টাকা আছে। এখনও আমরা সরাইখানার ভাড়াও দিইনি।’

‘আমার আকর্ষণ পাগড়ির দিকে নয়,’ বেরেমিজ বললেন, ‘তুমি কি খেয়াল করেছো এই দোকানের নাম ‘চারখানা চার?’ এই কাকতালীয় ঘটনার গুরুত্ব অস্বাভাবিক রকমের।’

‘কাকতালীয় ঘটনা কেন?’

‘এই দোকানের ক্যালকুলাসের একটি অসাধারণ বিষয়কে মনে করিয়ে দেয়। চারটি চার ব্যবহার করে আমরা যেকোনো সংখ্যায় পৌঁছতে পারি।’

বেরেমিজকে এর রহস্য জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা নরম বালুতে লিখে বোঝাতে শুরু করলেন।

‘তুমি কি শূন্য চাও? এর চেয়ে সহজ কিছু হয় না। শুধু লিখো:

৪৪ – ৪৪ = ০

‘এখানে চারটি চার আছে, যার মান শূন্য।’

‘তুমি কি এক পেতে চাও? সবচেয়ে সহজ উপায় হলো:

৪৪` ৪৪ = ১

’৪৪-কে ৪৪ দিয়ে ভাগ দিলেই কেল্লা ফতে!’

‘দুই বানাতে চাইলেও চারটি চার দিয়ে সহজেই লেখা যায়:

৪/৪+৪/৪ = ২

‘দেখতেই পাচ্ছো, ভগ্নাংশ দুটির যোগফল ২।

‘তিন তো আরও সোজা। শুধু এভাবে লিখতে হবে:

(৪+৪+৪)/৪ = ৩

এখানে লবের যোগফল ১২, যাকে ৪ দিয়ে ভাগ দিলেই ৩ পাওয়া যায়।

‘কিন্তু ৪ বানাবে কীভাবে?’ আমার প্রশ্ন

‘এর চেয়ে সহজ আর কিছু হয় নাকি?’ বেরেমিজের উত্তর। ‘৪ তো অনেকভাবেই পাওয়া যায়। একটা দেখাচ্ছি:

৪+(৪-৪)/৪ = ৪

দেখতেই পাচ্ছো, দ্বিতীয় পদের মান শূন্য। তারমানে রাশিটির মান ৪ + ০ = ৪।’

দেখলাম, সিরীয় ব্যবসায়ী মনোযোগ দিয়ে বেরেমিজের কথা শুনছে। চার চারের সমাবেশ তাকে বেশ মুগ্ধ করেছে।

বেরেমিন বললেন, ‘পাঁচ বানাতে চাইলেও সমস্যা নেই।

(৪×৪+৪)/৪ = ৫

‘ছয় লিখব এভাবে:

(৪+৪)/৪+৪ = ৬

‘একটু ঘুরিয়ে লিখলেই পাব ৭:

৪৪/৪-৪ = ৭

‘৮ বানানোও কোনো কঠিন কাজ নয়:

৪+৪-৪+৪ =৮

‘৯ তো আরেক মজার সংখ্যা:

৪+৪+৪/৪ = ৯

‘এবার দেখাব দারুণ আরেক সংখ্যা:

(৪৪-৪)/৪ = ১০

‘আমরা পেয়ে গেলাম ১০।’

কুঁজো দোকানী এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে শুনছিল। এবার কথা বলে উঠল, ‘বুঝলাম, আপনি অনেক ভালো একজন গণিতবিদ। দুই বছর আগে আমি একটি গাণিতিক সমস্যায় পড়েছিলাম। সেটা সমাধান করে দিতে পারলে আপনি যে নীল পাগড়িটা কিনতে চাচ্ছেন তা আপনাকে উপহার দেব।’

এরপর দোকানদার সমস্যাটা বললেন।

‘একবার মদিনার এক শেখ ও মিশরের কায়রোর এক লোককে ৫০ দিনার করে ধার দিয়েছিলাম। মদিনার শেখ চার কিস্তিতে সেটা পরিশোধ করেন: ২০, ১৫, ১০, ৫। মানে এভাবে:

পরিশোধিত অর্থ বাকি থাকল

২০ ৩০

১৫ ১৫

১০ ৪

৫ ০

মোট ৫০ মোট ৫০

‘দেখুন পরিশোধিত অর্থ ও বাকি ঋণের যোগফল ৫০। আবার কায়রোর লোকটাও ৫০ দিনারই পরিশোধ করেছে। তবে কিস্তির পরিমাণ ছিল ভিন্ন:

পরিশোধিত অর্থ বাকি থাকল

২০ ৩০

১৮ ১২

৩ ৯

৯ ০

মোট ৫০ মোট ৫১

‘দেখুন প্রথম যোগলফটা ৫০। ঠিক আছে। কিন্তু অন্য যোগফলটি ৫১। এমন তো হওয়ার কথা নয়। এই কিস্তিগুলোর দ্বিতীয় অংশের যোগফলে বাড়তি ১ কোত্থেকে এল আমি বুঝতে পারছি না। জানি আমাকে ঠকানো হয়নি। আমি তো আমার পুরো ৫০ দিনারই পেয়েছি। কিন্তু ১ টাকার গড়বড় কীভাবে যে হলো?’

‘বন্ধু,’ বেরেমিজ শুরু করলেন, ‘অল্প শব্দেই এটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। বাকি থাকা অর্থের সাথে মোট ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই। ধরো ঋণ শোধ করা হয়েছে তিন কিস্তিতে: ১০, ৫ ও পরে ৩৫। তাহলে অবস্থাটা হবে এমন:

পরিশোধিত অর্থ বাকি থাকল

১০ ৪০

৫ ৩৫

৩৫ ০

মোট ৫০ মোট ৭৫

এখানে দেখা যাচ্ছে প্রথম যোগফল ৫০। অন্য দিকে বাকি থাকা অর্থের যোগফল ৭৫। এটা আসলে যে কোনো সংখ্যাই হতে পারে। ৮০, ৯০, ১০০, ২৬০, বা ৮০০ ইত্যাদি যে কোনো সংখ্যা। ঘটনাক্রমেই শুধু কোনো একবার ৫০ হয়ে যেতে পারে।’

দোকানী সন্তুষ্ট। তিনি প্রতিশ্রুতিটা রাখলেন। বেরেমিজকে ৪ দিনারের পাগড়িটা উপহার দিয়ে দিলেন।

তথ্য নির্দেশ:

১। ইন্টারনেটে Four Fours লিখে সার্চ দিলেই পরবর্তী সংখ্যাগুলো তৈরির দারুণ সব পদ্ধতি পাওয়া যাবে।

২। বাকি থাকা অর্থের যোগফল আসলে অর্থহীন একটা কাজ। দেখতে হবে বাকি থাকা ঋণের পরিমাণ শূন্য (০) হলো কি না। শূন্য হয়ে গেলেই বুঝতে হবে আর কোনো ঋণ বাকি নেই। ১ টাকা করে পরিশোধ করতে থাকলে তো বাকি ঋণের পরিমাণ হবে ৪৯, ৪৮, ৪৭, … ইত্যাদি। এগুলোকে যোগ করা অর্থহীন।

লেখক পরিচিতি:

মালবা তাহান ব্রাজিলীয় গণিত লেখক হুলিও সিজার দা মেইয়ো এ সৌজার (১৮৯৫-১৯৭৪) ছদ্মনাম। গণিতের রহস্য ও আনন্দ মানুষের কাছে প্রকাশের জন্যে লেখক নামটি বেছে নিয়েছেন। মালবা তাহান ছদ্মনামে একশোর বেশি বই লিখেছেন। ছদ্মনাম সবাই জেনে ফেলার পরেও এই নামেই লিখেছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লেখালেখি করে গেছেন তিনি।

অসাধারণ বইগুলোর জন্য তিনি ব্রাজিলিয়ান লিটারেরি একাডেমির মর্যাদাজনক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৪ সালে তাঁর ছদ্মনাম দিয়ে তৈরি করা হয় দ্য মালবা তাহান ইনস্টিটিউট। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে রিও ডি জেনোরিও সংসদ ঠিক করে তাঁর মৃত্যুদিন ৬ মে দেশে গণিত দিবস হিসেবে পালিত হবে। দ্য ম্যান হু কাউন্টেড তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই। ২০০১ সালেই বইটির ৫৪তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।