গোপন বার্তার শুরুর গল্প

নীতু আর তপু দুই বন্ধু। দুজন একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ে। নীতু কোনো একটা শহরে বেড়াতে গিয়েছে। সে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ইয়া বড় একটা চিঠিতে লিখে তপুর কাছে পাঠিয়ে দিল।

সমস্যা হচ্ছে নীতু যে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলেছে, সেখান থেকে যে পোস্টম্যান চিঠিটি সংগ্রহ করে, সে বড়ই কৌতূহলী। তার নাম রুস্তম। তার অভ্যাসই হলো সব চিঠি আগে খুলে সে পড়ে দেখে, এরপর প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেয়। নীতু রুস্তমের কথা জানে এবং কোনোভাবেই চায় না রুস্তম তার চিঠি পড়ুক। কী করা যেতে পারে?

নীতু সিদ্ধান্ত নিল পুরো চিঠিটা সে কোডের সাহায্যে লিখবে। কোডের ব্যাপারটা অনেকটা এমন, সে একটা বাক্সের ভেতর চিঠিটা রেখে সেটা একটা কম্বিনেশন লক দিয়ে বন্দী করে দেয়, যার কম্বিনেশনটা শুধু নীতু আর তপু জানে। তারা দুজন ছাড়া ওই বাক্সটা আর কেউ খুলতে পারবে না, কারণ আর কারও কাছে ওই কম্বিনেশন নেই। কম্বিনেশন লক কী জিনিস বুঝতে না পারলে লাগেজ বা ব্রিফকেসের গায়ের তালা দেখা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার জন্য লাগেজ বা ব্রিফকেসের তালা খোলা যায়, আর বাকি সময় এটি বন্ধ থাকে। এটিই কম্বিনেশন লক।

এই যে নীতু বাক্সে চিঠিটিকে একটা নির্দিষ্ট কম্বিনেশন দিয়ে বন্দী করে রাখল, এটাকে বলা হয় এনক্রিপশন (Encryption)। আর তপু, সে আগে থেকেই কম্বিনেশনটা জানত, সে যখন বাক্সটা কম্বিনেশন ব্যবহার করে খুলে ফেলল, সেটাকে বলা হয় ডিক্রিপশন (Decryption)। এবার কিন্তু নীতুর চিঠি শুধু তার বন্ধু ছাড়া কেউই পড়তে পারবে না। তার উদ্দেশ্য সফল।

আমরা এখন যদি এই বাস্তব তালাকে ফেলে দিয়ে এর পরিবর্তে সাইফার (Cipher) ব্যবহার করি, সেটাকেই বলা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি (Cryptography)| সাইফার হচ্ছে অনেকটা ভার্চ্যুয়াল তালার মতো, যেটার বাহ্যত কোনো আকার বা অস্তিত্ব নেই। কিন্তু প্রয়োগ নীতি আছে। সাইফার মূলত চিঠির লেখাগুলোকে উল্টেপাল্টে পরিবর্তন করে এমন একটা কিছু বানিয়ে ফেলে, যেটা দেখে আপাতত অর্থহীন আর বেখাপ্পা মনে হয়। কাজেই এখন রুস্তম যদি নীতুর চিঠি মাঝখানে পড়েও ফেলে, তার কাছে ওই চিঠি হিজিবিজি ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। সে পড়তেও পারবে না।

ক্রিপ্টোগ্রাফি মোটামুটি পৃথিবীতে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। সমগ্র পৃথিবীতে যোগাযোগের জন্য, তথ্য প্রেরণ-ধারণ, যুদ্ধ সবকিছুতেই ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহৃত হয়। আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় যে পাসওয়ার্ড দিই, সেটাও কিন্তু ক্রিপ্টোগ্রাফি। ক্রিপ্টোগ্রাফি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে চাইলে গণিতের দুটি প্রাচীন বিষয় সম্পর্কে জানার প্রয়োজন পড়বে। সংখ্যাতত্ত্ব বা নাম্বার থিওরি এবং সম্ভাবনা তত্ত্ব (Probability Theory)।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে প্রথম যে সাইফার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়, সেটি হলো সিজার সাইফার। সিজার সাইফার মূলত একধরনের বর্ণ প্রতিস্থাপন (Letter substitution) ভিত্তিক সাইফার, যার শুরুটা হয়েছিল সম্রাট জুলিয়াস সিজারের হাত ধরে। খ্রিষ্টপূর্ব আটান্ন সালের দিকে। এ পদ্ধতিতে কোনো একটি চিঠির প্রতিটি বর্ণকে অন্য আরেকটি বর্ণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হতো। এতে পুরো চিঠিটার চেহারাটাই পাল্টে যেত। এমনিতে যে কারও হাতে সেই চিঠি পড়লে তার কাছে বিষয়টা পুরোটাই দুর্বোধ্য বা অর্থহীন, যেকোনো কিছুই মনে হতে পারে। মূল চিঠির বক্তব্য আর উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। সম্রাট এই কাজটি করতেন মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ যদি শত্রুপক্ষের হাতে পড়ে, তাঁরা যাতে কিছুতেই সম্রাটের সে নির্দেশ বা যুদ্ধের কলাকৌশল কী হবে, তা বুঝতে না পারে।

ধরা যাক, নীতু ও তপু নিজেদের মধ্যে সিজার সাইফার ব্যবহার করে চিঠি চালাচালি করতে চায়। তাদের প্রথম কাজ হবে আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে ১ থেকে ২৬-এর মধ্যে যেকোনো একটা সংখ্যা নির্দিষ্ট করে নেওয়া এবং এই সংখ্যাটা তারা দুজন ছাড়া আর কেউ জানবে না। সংখ্যাটা ২৬ কেন হতে হবে? উত্তরটা সোজা, ইংরেজি বর্ণমালায় অক্ষর আছে ২৬টি, একটু চিন্তা করলেই বাকিটা বোঝা যাবে।

আপাতত আমরা বোঝার জন্য একটা সংখ্যা ধরে নিই, ধরি সংখ্যাটি তিন। কাজেই নীতু যদি এখন তপুকে চিঠি পাঠায়, তাকে মূল চিঠির প্রতিটি অক্ষরের পরিবর্তে ইংরেজি বর্ণমালার তিন ঘর পরের অক্ষরটি ব্যবহার করতে হবে। তার মানে, চিঠির প্রতিটি A অক্ষরের পরিবর্তে D, B এর পরিবর্তে E, C এর পরিবর্তে F ব্যবহার করবে। এভাবে যখন W আসবে তার পরিবর্তে Z, X এর পরিবর্তে A, Y এর পরিবর্তে B এবং Z এর পরিবর্তে C ব্যবহার করবে। এভাবে পুরো চিঠি লেখা হলে সেটা নীতু তার বন্ধুকে পাঠিয়ে দেবে। নীতু যে কোড করে চিঠিটা পাঠাল, এটিই হচ্ছে এনক্রিপশন।

ধরা যাক, চিঠিতে লেখা আছে This place is amazing সিজার সাইফারের খপ্পরে পড়ে শিফটিংয়ের পর এই লাইনটি হয়ে যাবে wklv sodfh lv dpdclqj। চিঠিটা যদি মাঝখানে খুলে পড়ার চেষ্টা করে, এই লেখা বুঝবে এমন সাধ্য কি আমাদের পোস্টম্যান রুস্তমের আছে?

তপুর কাছে চিঠি পৌঁছালে ওর কাজ হবে নীতুর উল্টো কাজটা করা। অর্থাৎ ওর শিফটিং হবে উল্টো, তিন ঘর সামনে না গিয়ে ও তিন ঘর পেছনে গিয়ে শিফট করলেই মূল চিঠির অর্থ খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে। আর এই এনক্রিপ্টেড চিঠি থেকে মূল অর্থ বের করার জন্য ও যে কাজটা করল, এটাই হচ্ছে ডিক্রিপশন।

সিজার সাইফারের এই এনক্রিপশন পদ্ধতি আবিষ্কারের পরও বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু গণিতের শাখাগুলো উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের পদ্ধতিগুলোরও দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে এবং আরও নিরাপদ ও নতুন পদ্ধতি আসতে শুরু করে।

দেখা যাক, সিজার সাইফারের দুর্বলতাটি কোন জায়গায়। সিজার সাইফার আবিষ্কারের প্রায় আট শ বছর পর, একজন আরব গণিতবিদ এর দুর্বলতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই গণিতবিদের পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি। তিনি আল-কিন্দি (Al-Kindi) নামেই বেশি পরিচিত। প্রখ্যাত এই আরব পণ্ডিত একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ, রসায়নবিদ, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও আবহাওয়া বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। তিনি সিজার সাইফারের দুর্বলতা খুঁজে বের করেন মূলত বিভিন্ন বইপত্র এবং অন্যান্য রচনায় ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। বৈশিষ্ট্যটা হলো বর্ণমালায় সবগুলো অক্ষরের ব্যবহারের আনুপাতিক পরিমাণ ও তুলনা।

যেকোনো বই, পত্রপত্রিকা ইত্যাদি থেকে এর সবগুলো ব্যবহৃত বর্ণের ব্যবহার সংখ্যা (Frequency of letters) গোনা যায়, তাহলে দেখা যাবে এই সংখ্যাগুলো সমান নয়। যেমন ইংরেজি বর্ণমালায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় e অক্ষরটি, তারপর t, তারপর a। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ব্যবহূত হয় z, q, x, j ইত্যাদি। এই বৈশিষ্ট্যটিকে বলা হয় যেকোনো বর্ণমালার ফিঙ্গারপ্রিন্ট। প্রতিটি ভাষার, বর্ণমালার এ রকম একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকবেই, কারণ সব অক্ষরের ব্যবহার অবশ্যই সুষম নয়।

আপনার কাছে যদি একটা বড়সড় ইংরেজিতে লেখা বই থাকে এবং পুরোটাই সিজার শিফটিং করা, আপনার কাজ হবে এই বইয়ে সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত অক্ষরটি খুঁজে বের করা। ধরা যাক, এনক্রিপ্টেড একটা চিঠির পুরোটা পড়ে গুনে দেখলে এখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অক্ষর হচ্ছে H, সে ক্ষেত্রে আপনি মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারেন H অক্ষরটি হচ্ছে মূল বইয়ের E। আর একটি অক্ষর জেনে গেলেই বাকি কাজটা খুবই সহজ। ফিঙ্গারপ্রিন্ট কয় ঘর শিফট করা হয়েছে E অক্ষরটির জন্য সেটি হিসাব করে ফেললেই চলবে। তাহলে বাকি অক্ষরগুলোর ক্ষেত্রেও একই পরিবর্তন করলেই পুরো বইটিই ডিক্রিপ্ট করে মূল চেহারায় নিয়ে আসা সম্ভব।

ওপরের গ্রাফে ইংরেজি বর্ণমালায় প্রতিটি বর্ণের তুলনামূলক ব্যবহার দেখানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্রিকোয়েন্সি অ্যানালাইসিস এবং এর ধারণা এসে সিজার সাইফারের দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ফলে সিজার সাইফারের ব্যবহার তারপর থেকেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে এর ব্যবহার মোটামুটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

লেখক: একাডেমিক কাউন্সিলর, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত