জিনিয়াস রামানুজন

১৮৯৭ সাল। টাউন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণস্বামী ঢুকলেন বাচ্চাদের ক্লাসে। স্যারের মুখে হাসি নেই। সবাই যমের মতো ভয় পায় তাঁকে। কৃষ্ণস্বামী সবাইকে একবার দেখে নিলেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা কি জানো, কোনো সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়েই ভাগ করলে ভাগফল সব সময় ১ হয়?’ বাচ্চাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণস্বামী বুঝলেন, ওরা ভালো করে বুঝতে পারেনি বিষয়টি। শিক্ষক আবার বললেন, ‘ধরো, তোমার কাছে ৫টি আম আছে। পাঁচজন বন্ধুকে সমান ভাগে ভাগ করে দিলে সবাই একটা করে পাবে। অর্থাৎ ৫–কে ওই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে উত্তর হবে ১।’ আবার বাচ্চাদের দিকে তাকালেন কৃষ্ণস্বামী। এবার আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। কৃষ্ণস্বামী একটু গৌরবের হাসি দিলেন।

হঠাৎ একটি ছেলে পেছন থেকে হাত তুলল। সে প্রশ্ন করতে চায়। শিক্ষক অবাক। তাঁকে কখনো কেউ প্রশ্ন করে না। হাতের লাঠি ঠুকে বললেন, ‘কী জানতে চাও?’ ছেলেটি আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার, শূন্যকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলেও কি ভাগফল ১ হবে?’

প্রশ্ন শুনে কৃষ্ণস্বামীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কী উদ্ভট প্রশ্ন! তিনি দেখলেন, ছাত্ররা মুখ টিপে হাসছে। রাগে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন বেয়াদব ছেলেটিকে। কিন্তু মুখটিকে চিনে রাখলেন। বেশ কয়েক দিন এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবলেন কৃষ্ণস্বামী। তাঁর কাছে কোনো উত্তর নেই। একটা ছোট বাচ্চার কাছে ধরাশায়ী হলেন। কোনোভাবেই মানতে পারছেন না শিক্ষক। নাম–পরিচয় খুঁজে বের করলেন ছেলেটির। বাবা সামান্য ২০ টাকা মাইনের চাকরি করেন। মেধা দিয়ে সে–ই জয় করে নেয় কৃষ্ণস্বামীর মন। এই ছেলের নাম শ্রীনিবাস রামানুজন।

২২ ডিসেম্বর ১৮৮৭ সাল। ব্রিটিশ ভারতের তামিলনাড়ু অঙ্গরাজ্যের ইরোডেতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রামানুজন। তাঁর বাবা শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার একটি কাপড়ের দোকানের হিসাবরক্ষক ছিলেন। মা কমলাতাম্মল, একটি স্থানীয় মন্দিরে গান গেয়ে সামান্য টাকা উপার্জন করতেন। পাঁচ বছর বয়সে রামানুজনকে কুম্ভকোনামের স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ১০ বছর বয়সে ভর্তি হন টাউন হাইস্কুলে। এ সময় স্কুলের লাইব্রেরিতে পেয়ে যান এস এল লোনির ত্রিকোণমিতি। একা একাই শিখতে শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে শিখে ফেলেন ‘ত্রিকোণমিতির’ সব সূত্র। বইটি ভালো লেগে যায় রামানুজনের। খেলাধুলা পছন্দ করতেন না তিনি। সারা দিন ওই গণিত বই নিয়েই পড়ে থাকতেন। সমাধান করতেন বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা।

রামানুজনের তখন বয়স ১৭। হাতে পেয়েছেন জি এস কারের লেখা ‘আ সিনোপসিস অব এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস’। রামানুজনের সামনে খুলে যায় নতুন দুনিয়া। কত উপপাদ্য, গাণিতিক তথ্য, নতুন নতুন সূত্র। প্রতিটি সংখ্যার মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন রহস্য। উপপাদ্যগুলো নিজের মতো করে সমাধান করেন। তাঁকে দেখানোর মতো যে কেউ নেই। রামানুজন ম্যাজিক স্কয়ার গঠনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন ওই বয়সে।

ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে রামানুজন ভর্তি হন সরকারি কুম্ভকোনাম কলেজে। ওই কলেজ থেকে প্রতি মাসে বৃত্তির টাকা পেতেন। তাতেই পড়ালেখার খরচ চলে যেত। কিন্তু এফএ শ্রেণির প্রথম পরীক্ষায় গণিত ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ফেল করেন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বৃত্তি। গণিত ছাড়া অন্য কোনো বিষয় ভালো লাগত না তাঁর। তাই কখনো অন্য বই পড়তেন না। বৃত্তি বন্ধ হওয়ায় পড়ালেখার পাঠ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মা–বাবার কাছ থেকে খরচ পাওয়ার কোনো আশা নেই তখন। তাই কলেজ ছেড়ে পালিয়ে যান নিজ গ্রামে। সেখানেই চলে গণিতচর্চা। সে সময় তিনি অধিজ্যামিতিক সিরিজ নিয়ে কাজ করছিলেন। পাশাপাশি ইন্টিগ্রাল এবং সিরিজের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টাও করতে থাকেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আসলে উপবৃত্তাকার ফাংশন নিয়ে কাজ করছিলেন।

১৯০৬ সালে মাদ্রাজের একটি কলেজে আবার ভর্তি হন। কলেজ পাস করতে না পারলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে না। এবারও ভাগ্য সহায় হলো না রামানুজনের। পরীক্ষার আগে তিন মাস অসুস্থ ছিলেন তিনি। ফলে আবারও গণিত ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ফেল করেন। এবার পুরোপুরি ছেড়ে দেন পড়ালেখা। ১৯০৯ সালের ১৪ জুলাই ১০ বছরের জানকীকে বিয়ে করেন মায়ের ইচ্ছায়।

সংসারের কাজকর্ম করেন আর ফাঁকে ফাঁকে চলে গণিতচর্চা। জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেন আর সেগুলো পাঠিয়ে দেন ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির জার্নালে। এ সময় মা চাকরির জন্য চাপ দেন। তখন রামানুজন যোগাযোগ করেন কালেক্টর রামচন্দ্র রাওয়ের সঙ্গে। রামচন্দ্র রামানুজনের গণিতপ্রতিভা দেখে বিস্মিত হন। তিনি রামানুজনকে মাদ্রাজে গিয়ে গণিত নিয়ে গবেষণা করতে বলেন। আর মাসিক ২০ টাকা বৃত্তির একটি ব্যবস্থা করে দেন। ১৯১২ সালে রামানুজন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি পান। রামানুজনকে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা চিনতেন। গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে খানিকটা পরিচিতিও পেয়েছেন। তাই চাকরি পেতে খুব কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তখন রামানুজনের সহকর্মী এস এন আইয়ার। তিনিও গণিতে দক্ষ ছিলেন। ১৯১৩ সালে আইয়ার রামানুজনের কাজের ওপর ভিত্তি করে ‘অন দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অব প্রাইমস’ নামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। লেখাটি পাঠিয়ে দেন এইচ জি হার্ডিসহ আরও কয়েকজন গণিতবিদের কাছে। হার্ডি আগ্রহ দেখালেন। রামানুজন ও হার্ডির মধ্যে বেশ কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হলো। রামানুজনকে ইংল্যান্ডে ডেকে পাঠালেন হার্ডি। রামানুজন ব্রাহ্মণের ছেলে। চাইলেই কালাপানি পেরিয়ে যেতে পারবেন না ইংল্যান্ডে। তা ছাড়া তাঁর মা ছেলেকে ছাড়বেন না। হার্ডি রামানুজনের গণিতের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হলেন। কিছুটা ধন্ধও ছিল তাঁর মনে। কারণ, রামানুজন যেভাবে সমাধান করেছেন সমস্যাগুলোর, এর আগে কেউ সেভাবে করেনি। সুতরাং রামানুজনের গণিত যদি ঠিক হয়, তাহলে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। তাই হার্ডি রামানুজনকে বোঝালেন এবং পত্রিকায় প্রকাশে সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন। রাজি হলেন রামানুজন। অবশেষে মায়ের সম্মতিও পাওয়া গেল। ১৯১৪ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন রামানুজন।

সেখানে গিয়ে নতুন ঝামেলা পোহাতে হলো তাঁকে। খাবারদাবারে সমস্যা। আবার অন্যের হাতের রান্নাও খােবন না। তা ছাড়া শীতের সমস্যা তো আছেই। হার্ডিকেও কম ঝামেলা পোহাতে হলো না। রামানুজনের আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকায় ঝামেলা আরও বাড়ল। হার্ডি এবং তাঁর ছাত্র লিটলউড অনেক চেষ্টা করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করালেন। নিয়মিত গণিত নিয়ে আলোচনা করেন হার্ডি ও রামানুজন। গণিতের এই প্রতিভাকে যতই দেখেন, ততই মুগ্ধ হন হার্ডি। তবে রামানুজন যেসব সমস্যার সমাধান দেন, সেগুলোর সব ঠিক ছিল না। লিটলউডকে দায়িত্ব দেওয়া হয় রামানুজনের ভুল শোধরানোর। রামানুজনের সমাধানে আরও একটি সমস্যা ছিল। তিনি গণিতের সূত্র আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু সেগুলোর সমাধান ছিল না তাঁর কাছে। কিন্তু ইংল্যান্ডে এই নিয়ম চলে না। প্রশ্ন থাকলে তাঁর উত্তরও থাকতে হবে। নতুন করে সেগুলোর সমাধানের দিকে নজর দিলেন রামানুজন।

এ সময়ে তাঁর আরও সাতটি পেপার প্রকাশিত হয়। তিনি কাজ করেছেন গাণিতিক বিশ্লেষণ, সংখ্যাতত্ত্ব, অসীম ধারা, আবৃত্ত ভগ্নাংশ, গামা ফাংশন, মডুলারসহ আরও অনেক ধারা ও সিরিজ নিয়ে। ১৯১৭ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন রামানুজন। দিনের পর দিন খাবারের সমস্যার কারণে অসুস্থতা মারাত্মক রূপ নেয়। ১৯১৮ সালে হার্ডির সাহায্যে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছরে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সদস্য হিসেবেও নিয়োজিত হন।

১৯১৯ সালে ভারতে চলে আসেন রামানুজন। ভারতে এসে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর আর সুস্থ হননি। ২৬ এপ্রিল ১৯২০ সালে মারা যান গণিতের এই জাদুকর।

রামানুজনকে অয়েলার ও গাউসের সমপর্যায়ের গণিতবিদ মনে করতেন হার্ডি। রামানুজন তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছেন গণিতের জন্য। তাঁর স্মৃতিতে প্রতিবছর ২২ ডিসেম্বর আইটি দিবস হিসেবে পালন করা হয় ভারতে। ২০১৫ সালে রামানুজনকে নিয়ে মুক্তি পায় চলচ্চিত্র দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি।

রামানুজনের মৃত্যদিবসে বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ম্যাথ হিস্ট্রি ডট ওআরজি ও ফেমাস সায়েন্টিস্ট ডট ওআরজি

*লেখাটি ২০২০ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত।