দাবার রাজ্যে ধাঁধা

Abdul Gaffar

আগের কয়েক সংখ্যায় আমরা আলোচনা করেছি ট্যাকটিকস বা কৌশল নিয়ে। কৌশল নিয়ে আরও কথা ভবিষ্যতে বলা হবে। এ সংখ্যায় আমরা আলোচনা করতে চাই দাবার ধাঁধা নিয়ে। দক্ষ দাবাড়ু হতে প্রায় সবাই কিছু ধাঁধার সমাধান করেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের কাছে খুবই পরিচিত এবং জনপ্রিয় দাবার ধাঁধা-দুই চালে মাত। প্রতি মাসে বিপুল সংখ্যক পাঠক এই পর্বের সমাধান পাঠান।

দুই চালে মাত তুলনামূলক সহজ ধাঁধা। কারণ, খুব বেশি দূর চিন্তা করে সমাধান করতে হয় না। তবে বেশি বেশি দুই চালে মাত সমাধান করলে খেলার শেষাংশের দক্ষতা বাড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, হঠাৎ করে খেলার মধ্যে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে প্রতিপক্ষকে দুই চালে হারিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। এমনও হতে পারে যে প্রতিপক্ষ তখন আপনার চাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে মোক্ষম চালটা খুঁজে পেয়ে আপনি প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতে পারেন।

দাবা খেলায় দুই চালে মাতের পরিস্থিতি উদ্ভব হওয়া দুর্লভ কোনো ঘটনা নয়। বিখ্যাত অনেক খেলায়ও এমন হয়। যেমন ২০১৬ সালে ম্যাগনাস কার্লসেন এবং কারিয়াকিনের মধ্যে হওয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লড়াইয়ের ফলাফল নির্ধারণী খেলায় এমন হয়েছিল (ছবি ১)। এ অবস্থায় ম্যাগনাস কারিয়াকিনকে হারিয়েছিলেন দুই চালে মাতের মতো করে। তাই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট রয়ে যায় ম্যাগনাসের মাথাতেই। আপনি চেষ্টা করে দেখুন, বিশ্বচ্যাম্পিয়নের সেই চালটা খুঁজে পান কিনা। ম্যাগনাসের ছিল সাদার ঘুঁটি। মাত্র দুই চালে কীভাবে হারানো যাবে কারিয়াকিনকে?

শুধু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লড়াইয়েই নয়, আপনার খেলাতেও উদ্ভূত হতে পারে এমন অবস্থা। খেয়াল রেখে খেলুন। সুযোগ পেলে যাতে জিতে যেতে পারেন। তবে সময়মতো তা কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই আপনাকে অনেক অনেক চর্চা করতে হবে। ব্যাপারটা আপনার অভ্যাসে পরিণত করা চাই। প্রতি মাসে বিজ্ঞানচিন্তায় মাত্র দুইটা দুই চালে মাত ছাপা হয়। ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে গেলে আপনি অনেক দুই চালে মাত পাবেন সমাধান করার জন্য। সেগুলো চেষ্টা করুন।

দুই চালে মাতের মতো তিন চালে, চার চালে বা পাঁচ চালে মাতও আছে। সেগুলো একটু কঠিন। আমরা যে ছোট কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছি, সেগুলো মূলত পরবর্তী এক চাল, বড় জোর দুই চালের জন্য বেশি কাজে দেয়। বেশ কয়েক চাল পর্যন্ত মাথায় রেখে যেসব কৌশল ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে বলে স্ট্র্যাটেজি। পরে আমরা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনা করব।

তিন চালে, চার চালে বা পাঁচ চালে মাত সমাধান করার মধ্যে খানিকটা স্ট্র্যাটেজির প্র্যাকটিস আছে। দুই চালে মাতের সম্ভাব্য চালের সংখ্যা সীমিত। কিন্তু তিন, চার বা পাঁচের জন্য এই সংখ্যা একটু বেশি। তাই সমাধান করতে দক্ষতা লাগে একটু বেশি। ভালো দাবাড়ু হতে হলে অবশ্যই এই ধাঁধাগুলোও সমাধান করতে হবে। এই লেখায় কয়েকটি তিন, চার ও পাঁচ চালে মাত দেওয়া হলো। প্রথম দফায় একটু কঠিন মনে হতে পারে। তবে চেষ্টা করতে হবে। এই ধাঁধাগুলো মূলত খেলার শেষার্ধের জন্য বেশি দরকারি। আমরা যখন ওই অংশের আলোচনা করব, তখন বিস্তারিত লেখা হবে।

এবার দাবার এক বিখ্যাত ধাঁধা নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই ধাঁধা সমাধান করার জন্য যতটা না দাবার দক্ষতা দরকার, তার চাইতে বেশি দরকার গাণিতিক যুক্তির দক্ষতা। গাণিতিক সমস্যা সমাধান, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রস্তুতিতে অনেকে এই ধাঁধার সমাধান করেন। সব দাবাড়ুই কোনো না কোনো সময় এই সমস্যা নিয়ে ভাবেন। আপনিও চিন্তা করুন।

ধাঁধাটা হলো, একটা দাবা বোর্ডে সর্বোচ্চ কয়টা মন্ত্রী এমনভাবে বসানো যাবে, যাতে একটা আরেকটাকে আক্রমণ না করে। মন্ত্রী অত্যন্ত শক্তিশালী। দাবার তুলনামূলক শক্তির মাত্রায় ৯ পয়েন্ট। চলতে পারে সোজা এবং কোনাকুনি, যত ঘর ইচ্ছা তত। তাই অনেক মন্ত্রী একসঙ্গে বসানো কঠিন বটে। সর্বোচ্চ কয়টা বসানো যাবে?

দাবা বোর্ডে কলাম এবং সারি আছে আটটা করে। দাবার ভাষায় যাকে বলে ফাইল এবং র‍্যাংক। এক কলামে বা সারিতে আমাদের শর্ত অনুযায়ী একাধিক মন্ত্রী বসতে পারবে না, কারণ তাতে একটা মন্ত্রী আরেকটা মন্ত্রীকে আক্রান্ত করবে। অর্থাৎ আটটার বেশি মন্ত্রী একে অপরকে আক্রান্ত করে বসানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো আটটা মন্ত্রী কি বসানো সম্ভব?

দাবার বোর্ডে মোট ঘর আছে ৬৪টা। বিন্যাস-সমাবেশের গাণিতিক সূত্র হিসাব করলে দেখানো যায়, ৬৪!/(৫৬!৮!) বা ৪,৪২৬,১৬৫,৩৬৮ ভাবে ৮টা মন্ত্রীকে এই ৬৪ ঘরে বসানো যায়। প্রায় সাড়ে চার শ কোটিভাবে বসানো যাবে আট মন্ত্রীকে! এই সাড়ে চার শ কোটির অনেকটিই একটা মন্ত্রী আরেকটাকে আক্রমণ করবে, বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে কতগুলোতে আক্রমণ ছাড়াই বসানো যাবে? আদৌ কি বসানো যাবে?

খুঁজে পেতে দেখা গেল এই চার শ কোটির মাত্র ৯২টাতে কোনো মন্ত্রী অন্য মন্ত্রীকে আক্রমণ করে না। এই ৯২টাও আবার ইউনিক নয়। দাবাবোর্ড তো প্রতিসাম্য। যেকোনো দিক দিয়ে দেখলেই একই রকম দেখায়। তাই অনেক সমাধান আসলে একই সমাধানের ঘোরানো রূপ। কিছু সমাধান অন্য সমাধানের প্রতিবিম্ব। সেই হিসেবে ইউনিক সমাধান পাওয়া গেল ১২টা। আমরা একটা সমাধান দিয়ে দিলাম এই লেখায় (ছবি ৭)। আরও ১১ সমাধানের কয়টি আপনি বের করতে পারেন, চেষ্টা করে দেখুন। অন্য সমাধানগুলো খুঁজে পেলে পাঠিয়ে দিন বিজ্ঞানচিন্তার ঠিকানায়। পাঠাতে পারেন বাকি ধাঁধাগুলোর সমাধানও।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত