স্টিকারে যায় চেনা!

বাজারে গেলে বা সুপারশপে ঢুকলেই নানা রকম ফল ও শাকসবজির দেখা মেলে। আম, কাঁঠাল, লিচু, আপেল, কলা, লেবু, পেয়ারা, কমলা, মালটা, টমেটো, শসা, গাজর, ফুলকপি আরও কত-কী! সেই প্রাচীনকাল থেকেই এসব জিনিস মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির অন্যতম উত্স। সময়ের পরিক্রমায় কৃষিবিপ্লবের বদৌলতে আজ প্রায় সব ফল ও শাকসবজি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতির একটা বিশাল অংশ এসব পণ্যের চাষ থেকে শুরু করে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ওপর নির্ভরশীল।

আমরা যেসব ফল বা শাকসবজি খাই, এর বেশির ভাগই কিনে খেতে হয়। আমাদের দেশে আপেল, কমলা এবং এ রকম আরও বেশ কিছু ফল কিনতে গেলে ফলের ওপরে ছোট ছোট বাহারি রঙের স্টিকার দেখা যায়। ফল পানি দিয়ে ধোয়ার পর অনেকে ভুল করে হয়তো খেয়েও ফেলেছি একটু-আধটু! এই স্টিকারগুলো আসলে সহজপাচ্য। খেলেও কোনো সমস্যা হবে না এমনভাবেই তৈরি করা। কিন্তু আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি, এই স্টিকারগুলো কী নির্দেশ করে? শুধু কি কোম্পানির নামই লেখা থাকে, নাকি সঙ্গে আরও কিছু থাকে!

ফল থেকে স্টিকার তুলে ফেলার আগে খেয়াল করলে দেখবেন, স্টিকারে একটা চার বা পাঁচ ডিজিটের নম্বর দেওয়া আছে। এই নম্বরগুলোকে প্রাইস লুক-আপ কোড বা PLU কোড বলা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর প্রডিউস স্ট্যান্ডার্ডসের (IFPS) নির্দেশনায় ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ইউনিক কোড পৃথিবীজুড়ে কৃষিক্ষেত্রে উত্পাদিত বিভিন্ন পণ্য যেমন শস্য, ফল, শাকসবজি ইত্যাদির গায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই কোড নম্বর নির্দেশ করে উত্পাদিত পণ্যটি কী উপায়ে চাষ করা হয়েছে, কী ধরনের সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে, পাশাপাশি এটি জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফুড কি না, সেটাও। আগেই বলেছি, প্লু কোড চার বা পাঁচ ডিজিটের হয়ে থাকে। চার ডিজিটের কোড দিয়ে বোঝায়, পণ্যটি চাষবাসের প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে উত্পাদন করা হয়েছে।

পাঁচ ডিজিটের কোড যদি আট দিয়ে শুরু হয়, তাহলে পণ্যটি জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফুড, আর নয় দিয়ে শুরু হলে বোঝায় সেটি প্রাকৃতিক সব পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষ করা হয়েছে।

তিন বা চার দিয়ে শুরু চার ডিজিটের কোড

তিন বা চার দিয়ে শুরু

চার ডিজিটের কোড

তিন অথবা চার দিয়ে শুরু হওয়া চার ডিজিটের স্টিকার বেশ চোখে পড়বে আপনার। এটা নির্দেশ করে এটি আধুনিক কৃষিবিপ্লবের সব সুবিধা ব্যবহার করে প্রচলিত (Conventional) পদ্ধতিতে উত্পাদিত। অর্থাত্ ফল বা সবজিটি উত্পাদনে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের সঙ্গে আগাছানাশক ও হরমোন ব্যবহার করা হয়েছে।

আধুনিক কৃষিব্যবস্থার এ এক বিষবলয়। কোনোভাবেই ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো সম্ভব হচ্ছে না উত্পাদনের দিকে নজর রাখতে গিয়ে। প্রসবকালীন সমস্যা, স্নায়ু-দুর্বলতা, হূদেরাগ, ক্যানসার ও দীর্ঘমেয়াদি সব রোগের কারণ এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ।

আট দিয়ে শুরু পাঁচ ডিজিটের কোড

আট দিয়ে শুরু

পাঁচ ডিজিটের কোড

পাঁচ ডিজিটের কোনো কোড যদি আট দিয়ে শুরু হয়, তবে একটু সাবধান হতেই হবে। এর মানে ফল বা সবজিটি জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) ফুড। জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যেকোনো ফসলের উত্পাদন কয়েক গুণ থেকে ১০ গুণ বাড়ানোও সম্ভব। অনেক কারণেই ফসলকে জেনেটিকভাবে মডিফাই করা হয়েছে, হচ্ছে। কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে বাঁচানো, ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা কিংবা শুধু উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য অনেক সময়ই কোনো ফসলে নতুন কোনো জিন প্রবেশ করানো হয়। এভাবে উত্পাদিত ফল বা সবজি যে সাধারণভাবে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কোনো ফলে থাকা বিশেষ কোনো উপাদান, উদাহরণস্বরূপ কোনো প্রোটিন হয়তো কারও দেহে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে, যদি তার আগে থেকেই এমন সমস্যা থেকে থাকে। এমন সমস্যা অনেক সময় স্বাভাবিক খাবার থেকেও হয়।

নয় দিয়ে শুরু

পাঁচ ডিজিটের কোড

কোনো ফলের স্টিকার যদি নয় দিয়ে শুরু হয় এবং তা পাঁচ ডিজিটের হয়, তবে তা নিশ্চিন্তে কিনতে পারেন। এটি নির্দেশ করে ফলটি মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত জৈব (Organic) উপায়ে উত্পাদন করা হয়েছে। অর্থাত্ কোনো রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি, তার পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি সার এবং কীট নিয়ন্ত্রণের জন্যে ফাঁদ ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও এ পণ্যগুলো ভালো।

নয় দিয়ে শুরু পাঁচ ডিজিটের কোড

প্লু কোডের ব্যবহার যে কারণে

প্লু কোডের ব্যাপারে একটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার। ফল বা শাকসবজিতে প্লু কোড ব্যবহার করা কিন্তু মোটেও বাধ্যতামূলক নয়। এই কোডগুলো মূলত উত্পাদনকারী, সরবরাহকারী এবং খুচরা বিক্রেতাদের পণ্যের হিসাব রাখা, দাম নির্ধারণ ও বিক্রয়ের ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। কোনো বিক্রেতা যদি চান যে জৈবপদ্ধতিতে উত্পাদিত পণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি না রেখে প্রচলিত পদ্ধতিতে উত্পাদিত পণ্যের দামের সমান রাখবেন, সে ক্ষেত্রে তিনি পাঁচ ডিজিটের কোডের পরিবর্তে চার ডিজিটের কোড ব্যবহার করতে পারেন। কাজেই প্লু কোড দেখে এক শ শতাংশ নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই যে পণ্যটি আসলে কীভাবে উত্পাদন করা হয়েছে। তবে এত দিন যে স্টিকারগুলোকে আর দশটা স্টিকারের মতো মনে হয়েছে, কোনো ফল খাবার আগে এবার নিশ্চয়ই একবার অন্তত ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেবেন!

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত।