গত শতাব্দীর ৭০ দশকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন হিগস-বোসনের। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম স্কটল্যান্ডের এডিনবরার তত্কালীন অধ্যাপক পিটার হিগস। আরও ছিলেন টম কিবল, ফিলিপ অ্যান্ডারসন, কার্ল হেগেন, ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট, রবার্ট ব্রাউট ও জেরাল্ড গুরালনিক।
প্রশ্নটা ছিল, বস্তু কণারা ভর পায় কোত্থেকে? ধরে নেওয়া হলো, প্রকৃতিতে এমন একটা অতিরিক্ত কণা আছে, যার নিজের ভর আছে এবং সে শূন্যের মধ্যে খানিকটা শক্তি ছড়িয়ে রাখে। শূন্য অবস্থায় শক্তি বিরাজ করা কোয়ান্টাম তত্ত্বে নতুন কথা নয়। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর মূল সুর।
প্রশ্ন হলো ভর কী? কোনো স্থির বস্তুকে বাহ্যিক কোনো বলের (Force) সাহায্যে ধাক্কা দিলে সে কত তাড়াতাড়ি গতি পাবে, তা নিশ্চিত করে তার ভর। ভর যত বেশি হবে, সে গতি পাবে তত ধীরে। ধরা যাক, শুকনো স্বাভাবিক রাস্তায় একটা লোক হাঁটছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর হাঁটার গতি স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তায় যদি হাঁটুসমান পানি জমে থাকে, তবে তাঁর হাঁটার গতি আর আগের মতো থাকবে না। বেশ কমে যাবে। আবার পানির বদলে রাস্তায় যদি মধু জমে থাকে, তবে হাঁটার গতি কমে যাবে আরও বেশি।
হিগস বোসন কণা শূন্যের মধ্যে শক্তি ছড়িয়ে রাখে। জমাট শক্তির এই ক্ষেত্রকে বলে হিগস ফিল্ড। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিস্ফোরণের পর মূল কণিকাগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। তখন এরা সবাই ভরশূন্য ছিল। আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে—বস্তু ও শক্তি আসলে সমার্থক বিষয়। তাই জমে থাকা শক্তিও জমে থাকা বস্তুর মতো। সেই জমাট শক্তিকে ঠেলে সামনে এগোতে গেলে সব কণারই স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়, তারপর ভরহীন সেই কণাদের ছুটতে হবে শূন্যের মধ্যে জমাট শক্তির ওই বাধা ঠেলে। অর্থাৎ হিগস ফিল্ডের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় মূল কণারা হিগস ফিল্ডের জমাট শক্তির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। ফলে তার গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কণাগুলোকে তখন ভারী মনে হয়। এভাবেই কণারা ভর লাভ করে। এই বিষয়টাই প্রমাণ করে তাদের ভর আছে।
আলোর কণা ফোটন ভরহীন কেন? কারণ, ফোটন শুধু তারই সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অংশ নেয়, যার নিজস্ব বৈদ্যুতিক চার্জ আছে। হিগস-বোসন চার্জহীন কণা। তাই তার শূন্যে ছড়ানো জমাট শক্তিও কোনো চার্জ বহন করে না। এ কারণেই আলোর কণা তার মধ্য দিয়ে চলতে গেলে বাধা পায় না। তাই ফোটন কণার স্থির ভর শূন্য।
হিগস বোসনের কল্যাণে দুর্বল নিউক্লীয় তত্ত্বটির যে কাঠামো দাঁড়িয়েছিল এবং তা থেকে যেসব ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, গত দুই দশকে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পাওয়া যায়নি স্বয়ং কণাটিকেই। ২০০৮-এ এলএইচসি চালু হয়। তার আগেই এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ছিল হিগস-বোসন কণা খুঁজে বের করা।
এলএইচসির সাইক্লোট্রনে প্রবল গতি নিয়ে প্রোটন কণার স্রোত ছোটাছুটি করে পরস্পরকে ধাক্কা মারে। তা থেকে তৈরি হয় বহু রকমের কণা। কিছু ভারী কণাও তৈরি হয়। তবে তারা অস্থায়ী। দ্রুতই সেই কণা কয়েকটা হালকা কণার জন্ম দিয়ে নিজে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিগস কণার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার কথা। সাইক্লোট্রনে জন্ম নেওয়া নানা ধরনের কণাকে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের উত্স যে অন্য কণা নয়, হিগস কণা—এটা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল পদার্থবিদদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা এখন শতভাগ নিশ্চিত, নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস-বোসন। হিগস-বোসন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানজগতে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত। জবাব মেলে বহুদিনের একটা প্রশ্নের—বস্তুর ভরের উত্স কী।