রায়চৌধুরী উচ্চতর লেখাপড়া ও ডিগ্রির জন্য কখনো বিদেশে যাননি। স্বনামধন্য কোনো অধ্যাপকের অধীনেও গবেষণা করেননি তিনি। যা কাজ করেছেন, দেশে বসে নিজে নিজেই করেছেন।
অমল কুমার রায়চৌধুরী বাংলাদেশের বিজ্ঞানী। উঁচু মানের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী তিনি। আপেক্ষিকতাভিত্তিক সৃষ্টিতত্ত্বে মৌলিক অবদান রেখেছেন। সৃষ্টিতত্ত্বে তাঁর নামে একটি গাণিতিক সমীকরণও রয়েছে। এটি ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’ নামে সুপরিচিত। এটি একজন বিজ্ঞানীর কত বড় সাফল্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন মানুষের কাজের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে গেলে বোঝা যায় মানুষটি কোন মাপের!
রায়চৌধুরী বাংলার ছেলে। ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বরিশাল শহরে তাঁর জন্ম। মৃত্যুবরণ করেন ২০০৫ সালের ১৮ জুন কলকাতায়। তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার একটি স্কুলের গণিতের শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। স্কুলজীবন শেষে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হন। রায়চৌধুরীর ইচ্ছা ছিল গণিত নিয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় পদার্থবিজ্ঞান পড়েন। গণিত না পড়ার পেছনের কারণ, তাঁর বাবা তত্কালীন গণিতে প্রথম শ্রেণির এমএসসি ডিগ্রি নিয়েও সারা জীবন একটি স্কুলে গণিতের শিক্ষকতা করে কাটিয়ে দিয়েছেন। রায়চৌধুরীর বাবা চাননি ছেলেও তাঁর মতো হোক।
রায়চৌধুরী উচ্চতর লেখাপড়া ও ডিগ্রির জন্য কখনো বিদেশে যাননি। স্বনামধন্য কোনো অধ্যাপকের অধীনেও গবেষণা করেননি তিনি। যা কাজ করেছেন, দেশে বসে নিজে নিজেই করেছেন। যেমনটি আমরা দেখেছি আরেক প্রখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ক্ষেত্রে। রায়চৌধুরী তাঁরই উত্তরসূরি।
রায়চৌধুরী দুই বছর কলকাতার স্যার আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে ১৯৫২ সালে আবারও আইএসিএসে স্থায়ীভাবে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
১৯৪৪ সালে রায়চৌধুরী পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে (আইএসিএস) যোগ দেন গবেষণা ফেলো হিসেবে। তখনকার দিনে ‘আইএসিএস’ বিজ্ঞানচর্চার একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ বলে গণ্য হতো। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির আদলে ভারতবর্ষে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকেই ১৮৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সেখানে বসে নোবেলজয়ী ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (সি ভি রামন) কাজ করেছেন। রায়চৌধুরী ওই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর কাজ করতে বলে। ফলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। তাঁর আগ্রহ ছিল তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে। বিশেষ করে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। সে সময় আইনস্টাইনের তত্ত্ব বিজ্ঞানজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর মধ্যে গুটিকয় কেবল তা বুঝতে পারতেন। কারণ, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে আইনস্টাইন যে জটিল গণিত ব্যবহার করেন, তা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। প্রবীণ অধ্যাপকেরা তাই এটা নিয়ে কাজ করতে তরুণদের নিরুত্সাহিত করেন। এ রকম দোটানার মধ্যে পড়ে ‘আইএসিএস’-এ চার বছর পার করেন তিনি। অথচ এ সময়ই ছিল তাঁর গবেষকজীবন গঠনের উপযুক্ত সময়। তবে রায়চৌধুরীও নাছোড়বান্দা! নিজের কাজের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস। এ সময় তিনি নিরুত্সাহিত না হয়ে বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্পূর্ণ নিজে নিজে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব শিখে ফেলেন। সেই সঙ্গে শেখেন ওই তত্ত্ব বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় গণিত। আর এই নিজ থেকে শেখাটাই তাঁর পরবর্তী জীবনের কাজের ভিত রচনা করে।
রায়চৌধুরী দুই বছর কলকাতার স্যার আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে ১৯৫২ সালে আবারও আইএসিএসে স্থায়ীভাবে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। আবারও কর্তৃপক্ষ সেই পুরোনো কাহিনি শোনায়! প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান তাঁকে ডেকে নিয়ে পরিষ্কার বলে দেন, কোনো প্রকার তত্ত্বীয় গবেষণা করা যাবে না। পরীক্ষামূলক কাজ করতে হবে। কী কাজ করতে হবে, তা-ও তাঁরা ঠিক করে দেন। দেখা গেল, তাঁকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে, সেটি তাঁর মনের বিরুদ্ধের কাজ। এরপরও শুধু চাকরি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওই সময় তিনি দুটি প্রবন্ধ রচনা করেন। এত সব বাধাবিঘ্নের মধ্যেও তিনি ১৯৫৩ সালে সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্র রচনা করতে সক্ষম হন। অথচ অন্য কেউ হলে চাপিয়ে দেওয়া কাজ সম্পাদনের আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু রায়চৌধুরী তা করেননি। এখানেই তিনি ব্যতিক্রম।
১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি দেশ-বিদেশে সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক কর্মবীর।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ যখন পশ্চিমা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল, তখন নিজ দেশের বিজ্ঞানীদের চোখ খুলতে লাগল। বিশেষ করে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী প্যাসকেল জর্ডান ও অটো হিকম্যানের মতো বিজ্ঞানীরা তাঁর কাজের প্রশংসা করেন। তাই তিনি ডক্টরেট অব সায়েন্স (ডিএসসি) ডিগ্রির জন্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ জমা দেন। তাঁর সেই প্রবন্ধ মূল্যায়নের জন্য আরেক বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানী জন হুইলারকে মনোনীত করা হয়। জন হুইলার এমন এক বিজ্ঞানী, যাঁর নামে কণাবাদী সৃষ্টিতত্ত্বে একটি সমীকরণ রয়েছে। আজ এটি বিখ্যাত ‘হুইলার-ডিউইট সমীকরণ’ নামে পরিচিত। সেই বিখ্যাত জন হুইলার রায়চৌধুরীর গবেষণামূলক প্রবন্ধের ভূয়সী প্রশংসা করার পর ১৯৬০ সালে তিনি ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
অবশেষে সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে রায়চৌধুরী ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি দেশ-বিদেশে সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক কর্মবীর। বিজ্ঞানজগতের একনিষ্ঠ সাধক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রায় তিন দশক শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণা করে গেছেন।
পরে এই রায়চৌধুরী সমীকরণ ব্যবহার করেই স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ—দুজন মিলে ‘মহাবিস্ফোরণ সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য’ প্রমাণ করেন, যা আজ ‘হকিং-পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য’ নামে বিখ্যাত।
রায়চৌধুরী অর্ধশতাধিক গবেষণাপত্রসহ ছয়টি উঁচু মানের গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গবেষণাপত্রগুলোর বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আইনস্টাইনের মৃত্যুর বছর, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সেই যুগান্তকারী গবেষণাপত্র। আর আইনস্টাইনের জন্মশতবর্ষে, অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ—থিওরিটিক্যাল কসমোলজি।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার পর ১৯৬৪ সালে বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানী চার্লস মাইজনারের আমন্ত্রণে এক বছরের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। তখন তিনি সায়েন্টিফিক হিরো, অর্থাৎ একটি গাণিতিক সমীকরণের স্রষ্টা। সেখানে রায়চৌধুরীর সঙ্গে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের প্রথম পরিচয় হয়। পরে অধ্যাপক ইসলাম তাঁকে বাসায় নিয়ে যান। অধ্যাপক ইসলাম সে সময় (১৯৬৩-৬৫) যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিজ্ঞানচর্চায় বাঙালিরা পিছিয়ে থাকলেও যে কয়জন বাঙালি বিজ্ঞানী বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়।
জে ভি নারলিকারের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস’-এর আজীবন ‘অনারারি ফেলো’ ছিলেন অমল কুমার রায়চৌধুরী। এস চন্দ্রশেখর, ডব্লিউ এ ফাউলার, এ হিউয়িস, এফ হয়েল, ডি এস কোঠারী, এ সালাম প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে নিয়ে গঠিত অনারারি ফেলোদের তালিকায় নারলিকার তাঁকে স্থান দিয়েছেন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, রতনে রতন চেনে। নারলিকার ঠিকই বাংলার রত্ন রায়চৌধুরীকে চিনেছিলেন এবং যোগ্যতম স্থানেই তাঁকে স্থান দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে ভারতের শ্রেষ্ঠ অবদান।’ আর অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিবর্তনে রায়চৌধুরী সমীকরণ একটি মাইলফলক।’
বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যা এখন বাজারে
বিজ্ঞানচিন্তার এ সংখ্যা কিনুন অথবা ৬ মাসের সাবস্ক্রিপশন নিন আজই। অর্ডার করতে ক্লিক করুন এই লিংকে। অথবা ফোন করুন ০১৭৩০০০০৬১৯-এই নম্বরে।
রায়চৌধুরী সমীকরণ
বিজ্ঞানচর্চায় বাঙালিরা পিছিয়ে থাকলেও যে কয়জন বাঙালি বিজ্ঞানী বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। এঁরা বিজ্ঞানজগতের একেকটি স্তম্ভ। এ রকমই আরেকটি স্তম্ভ বরিশালের, তথা বাংলার কৃতী সন্তান আমাদের অমল কুমার রায়চৌধুরী। যাঁকে ‘বাংলার আইনস্টাইন’ বললেও খুব একটা ভুল হবে না তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত রায়চৌধুরী সমীকরণের জন্য। এই রায়চৌধুরী সমীকরণই ছিল হকিং-পেনরোজের হাতিয়ার, যা ব্যবহার করে তাঁরা বিখ্যাত ‘সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য’ প্রমাণ করতে সক্ষম হন। এ বাংলায় জন্মগ্রহণ করেও যে আইনস্টাইন, হকিং ও পেনরোজের সমপর্যায়ের কাজ করা যায়, রায়চৌধুরী তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সৃষ্টিতত্ত্বচর্চায় আইনস্টাইন, হকিং ও পেনরোজের নামের সঙ্গে বাংলার রায়চৌধুরীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সংশ্লিষ্ট গ্রন্থপঞ্জি: বাংলার আইনস্টাইন অমল কুমার রায়চৌধুরী, শরীফ মাহমুদ ছিদ্দিকী, অনুপম প্রকাশনী, ২০১৩