হকিংয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত পেপার

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুবরণ করেন এ বছরের ১৪ মার্চ। এ পদার্থবিজ্ঞানীর সবচেয়ে বেশি অবদান কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বে। তাঁর মৃত্যুর পরও প্রকাশিত হয় একটি গবেষণাপত্র। গত ২৭ এপ্রিল বিশ্বখ্যাত জার্নাল স্প্রিঞ্জার-এ প্রকাশিত হয় এই গবেষণাপত্রটি। শিরোনাম—‘আ স্মুথ এক্সিট ফ্রম ইটারনাল ইউনিভার্স’। গবেষণাপত্রটির মূল বিষয়বস্তু মহাবিশ্বের আকার ও আকৃতি। বর্ণনা করা হয়েছে ইটারনাল ইনফ্লেশন বা চিরন্তন স্ফীতির বিষয়। সহ-লেখক থমাস হারটগ। হারটগের পিএইচডি সুপারভাইজার ছিলেন হকিংই।

১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আছে বিগ ব্যাং নামের এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম মহাবিশ্বের। জন্মের সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে মহাবিশ্ব হঠাৎ করে বিশাল বড় হয়ে যায়। এ ঘটনার নাম ইনফ্লেশন বা স্ফীতি। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের আকার বেড়ে গিয়েছিল ১০২৬ গুণ। ১-এর পরে ২৬টি শূন্য দিলে যা হবে, এই সংখ্যাটি তত বড়। স্ফীতির সবচেয়ে সরল রূপ অনুসারে এটি মাত্র ৯×১০-৩৩ সেকেন্ড সময় ধরে চলেছিল। দশমিকের পরে ৩২টি শূন্য দিয়ে ৯ লিখলে হবে এই সংখ্যাটি। স্ফীতির পরও মহাবিশ্বের প্রসারণ অব্যাহত ছিল। তবে প্রসারণের বেগ অনেকখানি কমে এসেছে। কিন্তু স্ফীতি একসময় থেমে গেল কেন? সঠিক কারণটি এখনো অজানা।

স্ফীতি সংঘটিত হওয়ার সময় মহাবিশ্ব ছিল অনেক ছোট। এত ছোট যে স্ফীতির পরও মহাবিশ্বের আকার হয়েছিল মাত্র একটি কমলালেবুর মতো। স্ফীতি চলাকালে তাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়মগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কথাবার্তাকে সাধারণ বুদ্ধির সঙ্গে মেলানো যায় না। কোয়ান্টাম কণিকারা বহুদূরে থেকেও একে অপরের খোঁজ জেনে যায়। একই সঙ্গে থাকতে পারে বহু জায়গায়। বলা নেই কওয়া নেই, হাজির হয়ে যেতে পারে শূন্য থেকে। এই ঘটনার নাম কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এটা যদি প্রাথমিক মহাবিশ্বে কাজ করে থাকে, তাহলে মহাবিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে স্ফীতি ঘটবে অন্য অঞ্চলের চেয়ে দ্রুত।

তার মানে কোনো অঞ্চলে থেমে গেলেও অন্য কোনো অঞ্চলে ঠিকই চলতে থাকবে স্ফীতি। এ ধারণাটিকেই বলা হচ্ছে চিরন্তন স্ফীতি। এর আরেকটি অর্থ হলো, আমরা বাস করছি বহু মহাবিশ্বের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি জায়গায়। যেখানে স্ফীতি থেমে গেছে। তৈরি হয়েছে গ্রহ-নক্ষত্র। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একের পর এক মহাবিশ্ব তৈরি হয়ে চলেছে। স্ফীতি ঘটছে।

এমন একটি মহাবিশ্ব হবে খুবই অসম। মানে একেক দিকে একে রকম। এ বিষয়টিই গবেষণাপত্রের প্রতিপাদ্য। মহাবিশ্বকে যদি বেলুনের মতো ভাবা হয়, তাহলে বেলুনের বিস্ফোরণ হবে একটি সুষম স্ফীতির উদাহরণ। কিন্তু চিরন্তন স্ফীতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হবে বেলুনের একটি অংশের মতো। বেলুনের একটি অংশে বন্ধ হবে স্ফীতি। কিন্তু অন্য অংশে স্ফীতি অবিরত থাকবে। বেলুনের পৃষ্ঠের আকৃতি হয়ে যাবে কাঁটার মতো।

মাল্টিভার্স বা বহু মহাবিশ্ব এবং চিরন্তন স্ফীতির ধারণাগুলো তত্ত্ব হিসেবে খুবই শক্তিশালী। কিন্তু তবু এগুলো মহাবিশ্বের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এগুলো সত্য হলে একটার পরিবর্তে মহাবিশ্বের সংখ্যা হবে বহু। অসীম। কিন্তু কখনো আমরা কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বের দেখা পাইনি। এ বিষয়েই হকিং ও হারটগ একটি নমুনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

গবেষণাপত্রে নো বাউন্ডারি প্রোপোজালটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এটিও প্রারম্ভিক মহাবিশ্ববিষয়ক একটি অনুমান। বর্তমানে আমরা মহাবিশ্বের জন্মের ১০-৪৩ সেকেন্ড আগের কিছু জানি না। এ সময়টিকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক যুগ। আর এই প্ল্যাঙ্ক যুগ সম্পর্কেই কথা বলে প্রস্তাবটি। ইতিপূর্বে আরেক বিজ্ঞানী জেমস হার্টেলের সঙ্গে যৌথভাবে প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন হকিং। তাঁরা বলেন, ‘আমরা যদি সময়ের কাঁটায় ভর করে মহাবিশ্বের পেছন দিকে যেতে থাকি, তবে একসময় গিয়ে দেখা যাবে সময় আর নেই। আছে শুধু স্থান। মহাবিশ্বের সূচনা যে বিস্ফোরণের মাধ্যমে তার আগে সময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে মহাবিশ্বের শুরু বিষয়টাই অর্থহীন হয়ে পড়ে।’

তাই হার্টল-হকিংয়ের প্রস্তাব অনুসারে, আমরা শুরু বলতে যা বুঝি সেই অর্থে মহাবিশ্বের কোনো শুরু নেই। তাঁদের মতে, মহাবিশ্ব স্থান ও কাল উভয় দিক থেকেই ছিল একটি সিঙ্গুলারিটি। ফলে এই মহাবিশ্বের কোনো শুরু নেই। আবার এটি বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েলের মতো স্থির মহাবিশ্বও নয়। মহাবিশ্বের প্রসারণ ও গতিময়তা প্রমাণিত হওয়ার পরও ফ্রেড হয়েল স্থির মহাবিশ্বের পক্ষে কথা বলে গেছেন। বলেছিলেন, মহাবিশ্ব সব সময় একই রকম আছে, থাকবে। নেই কোনো শুরু এবং শেষ। অন্য দিকে হকিংদের মহাবিশ্বের স্থান বা কালের কোনো সীমানা নেই। এই যা। মানে সেই সময় মহাবিশ্ব ছিল কিনারহীন এক গোলকের মতো।

পরে বিজ্ঞানীরা দেখেন, এ ধারণার কিছু অদ্ভুত ফলাফল আছে। এটি অনুসারে মহাবিশ্বের সংখ্যাও দাঁড়ায় অসীম বা বহু। এই ধারণা অনেক সমস্যা তৈরি করে। তার মধ্যে বড় একটি হলো এটি যাচাই করা হবে কীভাবে? শুধু আমাদের মহাবিশ্বই তো কত বড়। এমনকি শুধু দৃশ্যমান মহাবিশ্বেরই ব্যাস ৯ হাজার ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ। সেখানে আরও মহাবিশ্ব কোথায় আছে কে জানে? ফলে এটি যাচাই করা অসম্ভব।

কিন্তু হকিং দমার পাত্র নন। এক বছর আগে তিনি হারটগকে বলেন, ‘চলো তো, মহাবিশ্বকে পোষ মানানোর চেষ্টা করি।’ ফলে দুজন মিলে চেষ্টা করলেন নো বাউন্ডারি প্রোপোজালকে কীভাবে আরও সুসংগত ও যাচাইযোগ্য কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা যায়। ফলে বর্তমান পেপারে নো বাউন্ডারি প্রোপোজাল থেকে একটু সরে এসেছেন তাঁরা। আর এভাবেই নতুন প্রস্তাবে সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংখ্যাও কমে এসেছে। আগে যেটাকে অসীম মনে করা হতো, এখন দেখা যাচ্ছে সেটা সসীম ও গণনাযোগ্য হতে পারে।

তাঁরা ব্যবহার করেছেন হলোগ্রাফি পদ্ধতি। আমরা বিভিন্ন জিনিসে হলোগ্রাম দেখে থাকি। হলোগ্রাম বানানোর প্রযুক্তি হলো হলোগ্রাফি। এ প্রক্রিয়ায় ত্রিমাত্রিক গাণিতিক উপায়ে দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে প্রক্ষেপ করা হয়। এভাবেই তাঁরা দেখতে চেয়েছেন কেমন দেখায় মহাবিশ্বকে। একটি মাত্রা উঠিয়ে দিয়ে ব্যাপারটি চিন্তা করা তুলনামূলক সহজ।

এরপর খতিয়ে দেখলেন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের সম্ভাবনা। চিন্তা করলেন বহু মহাবিশ্বের সম্ভাবনা। যা হবে কাঁটাময় বেলুনের মতো। এটাকে তুলনা করলেন মসৃণ বেলুনের মতো। দেখলেন, মহাবিশ্ব মসৃণ হলেই বেশি মানায়। তার মানে চিরন্তন স্ফীতির বিষয়টি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। এরপর তাঁরা বলছেন, মহাবিশ্ব একের বেশি থাকতে পারে। তবে সেটা অসীম নয়।

পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে, নতুন ধারণাটি মজার হলেও যুগান্তকারী নয়। এখনো এটিকে যাচাই করার উপায় বলা হয়নি। নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির কসমোলজিস্ট ক্যাটি ম্যাক বলছেন, তাঁরা যেটা করেছেন সেটা একটি প্রাথমিক নমুনা। এখনো পরিপূর্ণ এবং মানানসই নয়। তাঁরা স্বীকারও করেছেন, এখনো অনেক কিছু করা বাকি আছে। আর আসলে বিষয়গুলোর সত্যিকার জবাব পেতে হলে দরকার পদার্থবিদ্যার সার্বিক কোনো তত্ত্ব। যে তত্ত্বে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও সাধারণ আপেক্ষিকতা। প্রকৃতির সব মৌলিক বল যখন গেঁথে যাবে একই সুতোয়।

এটা হকিংয়ের শেষ প্রকাশিত গবেষণাপত্র হলেও তিনি মৃত্যুর আগে আরও অনেকগুলো পেপারের কাজ করছিলেন। তাঁর নিজের পেপারের মাধ্যমেই উত্থাপিত একটি বিষয় হলো ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স। কোনো তথ্য আসলেই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যেতে পারে কি না, এটাই হলো প্যারাডক্সটির মূল প্রশ্ন। প্যারাডক্সটির সমাধানে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যালকম পেরি ও হার্ভার্ডের অ্যান্ডি স্ট্রোমিংগারের সঙ্গে কাজ করছিলেন। তার মানে এটাই হকিংয়ের শেষ গবেষণাপত্র নয়।

সূত্র: স্প্রিঞ্জার ডট কম, সায়েন্স অ্যালার্ট ডট কম