কাজকে ভালোবেসে পরিশ্রম করলে আমরাও সফলতা পাব

প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী এম সাইফ ইসলাম। ১৯৮৭ সালে তুরস্কে মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করতে যান তিনি। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি শেষে কর্মজীবন শুরু করেন। তথ্যপ্রযুক্তি আর ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে তাঁর বর্তমান গবেষণা। ২০১৮ সালে দেশে এসেছিলেন এই বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানচিন্তা আর কিশোর আলোর যৌথ উদ্যোগে এক পাঠক আড্ডায় অংশ নেন তিনি। সেসময় সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদনা দলের সদস্য ইবরাহিম মুদ্দাসসেরমৃন্ময় কুণ্ডু

খালেদ সরকার
প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের পড়াশোনা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। কখন মনে হলো যে আপনি প্রকৌশলী হবেন?

সাইফ ইসলাম: প্রকৌশল কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের বাইরের বিষয় নয়। পদার্থবিজ্ঞান নদীর মতো বিস্তৃত। এর একেকটি ধারায় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা থাকলে এগুলো আয়ত্ত করা তেমন কঠিন কোনো বিষয় নয়। যখন পিএইচডি করতে যাই, তখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান আমাকে খুবই সাহায্য করেছে। আমি যখন মাস্টার্স শেষ করে বাইরের বিভিন্ন দেশে পিএইচডির জন্য আবেদন করি, তখন পদার্থবিজ্ঞানের জন্য খুব বেশি সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমি যখনই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলোতে আবেদন করেছি, সেখানে বেশ ভালো আর্থিক সহায়তাসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। এটা কিন্তু পিএইচডি করার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া তখন আমেরিকায় খুবই জনপ্রিয় বিষয়গুলোর একটি ছিল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। তখনই বিষয় পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: বর্তমানে কী নিয়ে গবেষণা করছেন? আপনার গবেষণার বিষয়বস্তু কী?

সাইফ ইসলাম: আমার গবেষণার একটি বড় অংশ সেন্সর নিয়ে। সেন্সর কীভাবে কাজ করে, সেন্সর দিয়ে আমরা কী কী জিনিস বুঝতে পারি, সে বিষয়গুলো নিয়েই আমার গবেষণা। ধরা যাক, একজন কোনো বিশেষ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তার নিশ্বাস থেকে সেই রোগের জীবাণু বের হয়। হয়তো কয়েক মিলিয়ন পরমাণুর মধ্যে মাত্র পাঁচ-ছয়টি ওই রোগের জীবাণু থাকবে। মিলিয়ন পরমাণুর মধ্য থেকে পাঁচ-ছয়টি জীবাণু খুঁজে পাওয়া কিন্তু ভীষণ কঠিন। আমরা যদি সেন্সর দিয়ে এটা শনাক্ত করতে পারি, তাহলে খুব সহজেই প্রাথমিক অবস্থায় রোগটা শনাক্ত করা যাবে। ফলে দ্রুত চিকিত্সার ব্যবস্থা করা যাবে।

যানবাহনের সেন্সর নিয়েও গবেষণা করি। কুয়াশাচ্ছন্ন এলাকায় হেডলাইট খুব কাজের নয়। আশা করছি, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে হেডলাইট ছাড়াই গাড়ি চলবে। এ ছাড়া পথচারী বা রাস্তায় অন্য যেকোনো বস্তুকে শনাক্তের জন্যও গাড়িতে সেন্সর ব্যবহার করা যেতে পারে। এ জন্য এখন লাইডার ব্যবহার করা হয়। তবে এগুলো খুব কম আলোয় তেমন কার্যকর নয়। আমরা চেষ্টা করছি অন্ধকারেও ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারে এমন সেন্সর বানানোর। তা ছাড়া এসব সেন্সরের কাজ এবং গতি বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দিয়েছি আমরা।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে প্রচুর পরিমাণে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এগুলোর কর্মদক্ষতা খুবই কম। ভবিষ্যতে সৌরকোষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে আপনাদের কোনো গবেষণা আছে কি?

সাইফ ইসলাম: সিঙ্গেল ক্রিস্টাল সিলিকন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। সেগুলোর কর্মদক্ষতা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। তবে বাজারে যেসব সোলার প্যানেল পাওয়া যায়, সেগুলো তৈরি হয় চীনে। এগুলো মাল্টিক্রিস্টাল বা ন্যানোক্রিস্টাল সিলিকন। এগুলোর কর্মদক্ষতা ১৫ শতাংশ হলেও পরে তা হ্রাস পেয়ে প্রায় ১০ শতাংশে নেমে আসে। এগুলোতে নানা রকম রঙিন ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এসব সোলার প্যানেলের দাম খুব বেশি-সাধারণ সোলার প্যানেলের চার গুণ। কীভাবে এই সোলার প্যানেলগুলোকে একটা কার্পেটের মতো রোল করে রাখা যায় কিংবা বাসার জানালায় ব্যবহার করা যায়, সেই জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়, আবার শক্তিও সংগ্রহ করা যায়, সেটা নিয়েও বড় পরিসরে কাজ হচ্ছে। ফোটন ট্র্যাপিং নামে একটি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি আমরা। এর সাহায্যে ফোটন সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। সাধারণত সূর্য থেকে আসা ফোটনের মাত্র ২০ শতাংশ আমরা সংগ্রহ করতে পারি। আমরা চেষ্টা করছি ৮০ শতাংশ ফোটন সংগ্রহ করার। এই কাজটা কঠিন নয়, তবে ব্যয়বহুল। তাই কম খরচে এই প্রযুক্তি মানুষকে উপহার দেওয়ার জন্য কাজ করছি আমরা।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: সূর্যের বর্ণালিতে দৃশ্যমান আলো ছাড়া আরও নানা রকম আলোকতরঙ্গ আছে। বর্তমানে মূলত দৃশ্যমান আলোকতরঙ্গের ওপর নির্ভর করেই সৌরকোষ তৈরি করা হয়। অন্যান্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে সৌরকোষগুলোর কর্মদক্ষতা বাড়াতে সীমাবদ্ধতা কী?

সাইফ ইসলাম: এই ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের আলোর ফোটন কণার শক্তির মানও আলাদা। সিলিকন সর্বোচ্চ ১ মাইক্রন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো থেকে ফোটন সংগ্রহ করতে পারে। এরপর আছে জার্মেনিয়াম। এটি প্রায় ১ দশমিক ৭ মাইক্রন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো থেকে ফোটন সংগ্রহ করতে সক্ষম। তবে সূর্যের আলোয় কিন্তু এর থেকেও বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আছে, সেগুলো থেকে ফোটন কণা সংগ্রহ করা গেলে আরও শক্তি সংগ্রহ করা সম্ভব। চীনে যে সাধারণ সৌরকোষগুলো তৈরি হয়, সেগুলো কিন্তু শুধু একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু কিছু গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নানা রকম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহে সক্ষম এমন সোলার প্যানেল বানাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো এগুলোর কর্মদক্ষতা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এগুলোর দাম আকাশচুম্বী। ফলে সাধারণ মানুষের হাতে এই প্রযুক্তি তুলে দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলা চলে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে একটি মজার গবেষণা চলছে। আমাদের পৃথিবী সারা দিন নানা রকম শক্তি সংগ্রহ করে। আবার দিন শেষে এসব শক্তি কিন্তু মুক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। এটাকে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ বা ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন বলা হয়। সূর্যের আলোর অধিকাংশের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যেখানে প্রায় ৫০০-৬০০ ন্যানোমিটার, সেখানে এই ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১০ হাজার ন্যানোমিটারের কাছাকাছি। সারা রাতে পৃথিবীর প্রতি বর্গমিটার এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ ওয়াট শক্তির বিকিরণ ঘটে। অন্যদিকে দিনে সূর্যের আলোয় প্রতি বর্গমিটার এলাকা থেকে শক্তি সংগ্রহ করা যায় ১০০০ ওয়াটের মতো। এখন আমরা যদি এমন কোনো প্যানেল বানাতে পারি, যেটা ১০ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করতে পারে, তাহলে আমরা রাতেও প্রতি বর্গমিটার এলাকা থেকে প্রায় ৩ ওয়াট শক্তি সংগ্রহ করতে পারব। সেটা রোদ, বৃষ্টি এমনকি কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বন্ধ হবে না।

প্রশ্ন:

বিজ্ঞানচিন্তা: বিজ্ঞানচিন্তার তরুণ পাঠকদের জন্য আপনার পরামর্শ?

সাইফ ইসলাম: ম্যারাথনের দৌড়বিদদের কথাই ধরা যাক। ওদের অনেকেই দেখা যায় ফিনিশিং লাইনের কয়েক মিটার দূরে এসেই হাল ছেড়ে দেয়। আমি এখনকার তরুণদের অনেকের মধ্যেই এ বিষয়টা দেখি। অনেকেই খুব ভালোবেসে পড়াশোনা করতে করতেই হঠাৎ একদিন বলে বসে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনেক গণিত করতে হয়, এত পড়াশোনা করতে হয়। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়লেই কষ্ট কম। অনেকে তাই শেষ মুহূর্তে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে দেয়। সে কিন্তু পুরো রাস্তা প্রায় শেষ করে এসেছে। শেষ সময়ে নিজের কাজের প্রতি অবিচল থাকতে পারেনি, তাই সে সফলতা পায় না। তাই তরুণদের আমি বারবার বলি যে লেগে থাকতে হবে। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম বলেন, ‘মেধা বলতে কিছু নাই। এটা মূলত নিয়মিত পরিশ্রমের ফসল।’ আমি নিজেও এই কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তাই আমি মনে করি, নিজেদের কাজকে ভালোবেসে পরিশ্রম করলে আমরাও সফলতা পাব।