মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোট জিনিস

মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোট জিনিস কোনটি? প্রশ্নটি করা যত সহজ, তার উত্তর কিন্তু তত সহজ নয়। চলুন, আমরা নিজেরাই একটি উপায়ে চিন্তা করি। মানবদেহ নিয়েই ভাবা যাক না। আমাদের দেহ অনেকগুলো অঙ্গ নিয়ে গঠিত। এই যেমন হাত, পা, চক্ষু, যকৃৎ, কিডনি ইত্যাদি। এগুলো আবার অনেকগুলো উপাদান নিয়ে গঠিত। তবে একটি জায়গায় গিয়ে সব অঙ্গাণু সমজাতীয় হবে। সব অঙ্গাণুই অনেকগুলো কোষ নিয়ে গঠিত। শুধু মানুষই নয়, প্রায় যেকোনো জীবেরই অন্যতম মৌলিক (!) উপাদান কোষ।

মানবদেহে আছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ। কোষকে ভাঙলে পাওয়া যাবে পানি, লিপিড, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও নিউক্লিক অ্যাসিড। পানিকে ভাঙলে পাওয়া যাবে মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। সাধারণত তেল, চর্বি, মোম ও স্টেরলকে একসঙ্গে লিপিড বলে। সেই হিসেবে এর প্রধান উপাদান কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন।

প্রোটিনকে ভাঙলে পাওয়া যাবে অ্যামাইনো অ্যাসিড। আর লিপিডের মতোই অ্যামাইনো অ্যাসিডেও থাকে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন।

নিউক্লিক অ্যাসিড কোষের তথ্য বহনকারী প্রধান অণু। এর প্রধান অংশ হলো ডিএনএ ও আরএনএ। কিছু ভাইরাস ছাড়া প্রায় সব প্রাণীরই সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে ডিএনএ। ডিএনএর বংশগতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করা অংশের নাম আবার জিন। মানবদেহে প্রায় ৩০ হাজার জিন থাকে। নিউক্লিওটাইড নামের অণু দিয়ে ডিএনএ গঠিত। প্রতিটি নিউক্লিওটাইডে থাকে আবার একটি ফসফেট গ্রুপ, একটি শর্করা গ্রুপ ও একটি নাইট্রোজেন ক্ষার। ফসফেটে থাকে মৌলিক পদার্থ ফসফরাস ও অক্সিজেন। শর্করায়ও লিপিড ও অ্যাসাইনো অ্যাসিডের মতো কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থাকে।

তাহলে এখন মানবদেহের কোষের মৌলিক (!) উপাদানগুলো আমরা চিনলাম। তবে এগুলো তো হলো কোষে উপস্থিত মৌলিক পদার্থ। এর বাইরেও মানবদেহে বেশ কিছু মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়। তবে দেহের ৯৯ শতাংশ মৌলিক পদার্থই ৬টি উপাদানে গড়া। এরা হলো অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। প্রায় শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ আছে আরও পাঁচটি মৌল। পটাশিয়াম, সালফার, সোডিয়াম, ক্লোরিন ও ম্যাগনেশিয়াম।

মৌলিক পদার্থ নিয়ে ভাবলে মনে হবে মানবদেহ কত রকম জিনিস দিয়ে গঠিত! কিন্তু পরমাণুকে আরও ভাঙলে সে ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। অবশ্য একসময় তো পরমাণুর চেয়েও আরও বড় বড় জিনিসকে প্রকৃতির সব বস্তুর মৌলিক উপাদান মনে করা হতো। অ্যারিস্টটল মনে করতেন সবকিছুর পেছনে চারটি মৌলিক উপাদান কাজ করে। মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি। তবে ডেমোক্রিটাসের ধারণা আরেকটু উন্নত ছিল। কিন্তু সেটা নিখুঁত ছিল না। পরমাণু শব্দের ইংরেজি পরিভাষা অ্যাটম (atom) গ্রিক বিশেষণ atomos থেকে নেওয়া। নামটি তাঁরই দেওয়া। যার অর্থ যাকে আর ভাগ করা যায় না।

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে জন ডাল্টন পরমাণুবাদকে আরও শক্ত ভিত্তি দান করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, রাসায়নিক বস্তুসমূহ পরমাণু দিয়ে গঠিত। রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরমাণু ধ্বংস বা পরিবর্তিত হয় না। পরমাণু দিয়ে গঠিত যৌগিক পদার্থ যদিও পাল্টে যায়। কিন্তু বিক্রিয়ার আগে ও পরে মৌলগুলো একই থাকে। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে ডাল্টন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন বলে পরমাণু সম্পর্কে এটাই প্রথম সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণু অবিকৃত থাকে। তাহলে কি পরমাণু বস্তুর একেবারে মৌলিক উপাদান? মোটেও নয়। ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত যদিও সেটাই মনে করা হতো। ওই বছর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে থমসন তাঁর ক্যাথোড রশ্মির পরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কার করেন পরমাণুর অন্যতম কণা ইলেকট্রন। তার মানে পরমাণু আসলে পরম অণু নয়। একেও ভাঙা যায়। এ ছাড়া ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে নিউজিল্যান্ড বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণু নিয়ে অনেকগুলো পরীক্ষা চালান। আবিষ্কার করেন পরমাণুর কেন্দ্রের নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে পেলেন প্রোটনের দেখা। দেখার আগেই পেয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী ইউজিন গোল্ডস্টেইন। ১৮৮৬ সালে। তবে তিনি সেটাকে নিছক হাইড্রোজেন মনে করেছিলেন। তার পেছনের কারণটাও মজার। আসলে পর্যায় সারণির প্রথম মৌল হাইড্রোজেন একটিমাত্র প্রোটন দিয়ে গঠিত। ক্রমেই ভারী মৌলগুলোতে একটি করে প্রোটন বাড়তে থাকে। সাধারণ হাইড্রোজেনে আবার নিউট্রনও থাকে না। এটিই একমাত্র মৌল, যাতে কোনো নিউট্রন থাকে না। থাকে শুধু একটি প্রোটন। তাই সাধারণ হাইড্রোজেনের সঙ্গে প্রোটনের কোনো পার্থক্য নেই। এ কারণেই গোল্ডস্টেইন মনে করেছিলেন, পরমাণুতে কণার বদলে হাইড্রোজেন থাকে।

১৯২০ সালে রাদারফোর্ড প্রস্তাব করেছিলেন, পরমাণুর কেন্দ্রে প্রোটনের সঙ্গে চার্জহীন আরেকটি কণাও আছে। ১৯৩২ সালে সেই কণা ধরা পড়ে জেমস চ্যাডউইকের পরীক্ষায়। এ জন্য তিনি ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরস্কারও পান। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়, পরমাণু তিনটি মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত। ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। যেকোনো বস্তুকে ভাঙলেই শেষ পর্যন্ত এই কণাগুলোকে পাওয়া যাবে। আমরা অনেক সময় সব মানুষ সমান এই কথা প্রমাণ করতে বলি, সব মানুষের মধ্যেই থাকে একই রকম লাল রক্ত। তাহলে কেন এত ভেদাভেদ? কেন সাদা-কালোর বিভক্তি? ব্যাপার হলো, শুধু রক্ত কেন, আরও গভীরে গিয়ে ভাবলে সব মানুষই তো একই রকম কণা দিয়ে গঠিত পদার্থে তৈরি। তাহলে ভেদাভেদ আসলেই থাকা উচিত নয়।

কিন্তু তাহলে কি পরমাণুর এই তিনটি কণাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোট জিনিস? একটা সময় পর্যন্ত সেটাই সত্যি মনে করা হতো। কিন্তু সব বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে ইলেকট্রন, প্রোটনদের পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরও ভাঙার কৌতূহল মনে জন্মাতেই পারে। জয় হয়েছে সেই কৌতূহলেরও। ১৯৬৪ সালে দুজন বিজ্ঞানী স্বাধীনভাবে প্রস্তাব করেন কোয়ার্ক মডেল। তাঁরা হলেন মারে গেলম্যান ও জর্জ জুইগ। ১৯৬৮ সালের এক পরীক্ষায় দেখা যায়, প্রোটন আসলেই মৌলিক কণা নয়। এটি গঠিত আরও অনেক ছোট বিন্দুসদৃশ কিছু কণা দিয়ে। শুরুতে অবশ্য বিজ্ঞানীরা এদের কোয়ার্ক বলতে রাজি হননি। রিচার্ড ফাইনম্যান এদের নাম দিয়েছিলেন পারটন। পরে দেখা যায়, এই কণাগুলোই গেলম্যানদের প্রস্তাবিত কোয়ার্ক।

সে সময় দুই ধরনের কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়েছিল। আপ ও ডাউন কোয়ার্ক। পরে আরও চার প্রকার কোয়ার্ক পাওয়া যায়। ১৯৯৫ সালে সর্বশেষ কোয়ার্ক হিসেবে টপ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়। বাকি তিন প্রকার কোয়ার্কের নাম স্ট্রেঞ্জ, চার্ম ও বটম। প্রোটন ও নিউট্রন দুটোই কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত। প্রোটনে থাকে দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক। আর নিউট্রনে দুটি ডাউন ও একটি আপ কোয়ার্ক। তার মানে প্রোটন ও নিউট্রন দুটো কণাই অমৌলিক। তবে পরমাণুর কেন্দ্রের বাইরের দিকে থাকা ইলেকট্রনকে অমৌলিক বলার মতো কোনো তথ্য এখনো মেলেনি।

এখন পর্যন্ত আমরা তাহলে যা জানলাম, সেটি অনুসারে কোয়ার্ক ও ইলেকট্রনরা মৌলিক কণা। অবশ্য শুধু ইলেকট্রন বললে একটু ভুল থেকে যায়। ইলেকট্রনের সমগোত্রীয় আরও কিছু কণাও আছে, যারা মৌলিক। এদের এক নামে বলা হয় লেপটন। এরা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। চার্জধারী ও প্রশম বা চার্জনিরপেক্ষ। প্রথম কাতারে রয়েছে ইলেকট্রনসহ মিউওন ও টাউ। আর প্রশম বা চার্জহীন কণাগুলো হলো ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউওন নিউট্রিনো ও টাউ নিউট্রিনো।

এখানেই শেষ নয়। মৌলিক কণা (!) আছে আরও। হিগস বোসন ও গেজ বোসন। এর মধ্যে গেজ বোসন কণারা বলবাহী কণা হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের প্রতিটির জন্য একটি করে এমন কণা রয়েছে। সবল নিউক্লীয় বলের জন্য রয়েছে গ্লুওন কণা। দুর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য ডব্লিউ ও জেড বোসন, আর তড়িৎ–চুম্বকীয় বলের জন্য ফোটন বা আলোর কণা। অপর মৌলিক বল মহাকর্ষের জন্য প্রস্তাবিত বলবাহী কণা গ্র্যাভিটন এখনো স্বীকৃত কণা নয়। এদের বাইরে রয়েছে হিগস বোসন। যার অপর নাম ঈশ্বর কণা। মৌলিক কণিকাদের ভরের জন্য এই কণা দায়ী।

এত এত মৌলিক কণা প্রকৃতিতে। এখন পর্যন্ত এরা অন্য কোনো কিছু দিয়ে তৈরি বলে জানা নেই। তার মানে এদের মধ্যে যে সবার ছোট হয়তো সে-ই হবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোট জিনিস। কিন্তু এখানেই এক সমস্যা। ফোটন, নিউট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি মৌলিক কণাদের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। সবারই আছে নির্দিষ্ট চার্জ বা আধান, ঘূর্ণন, ভর, শক্তি। কিন্তু এদের সাইজ বা আকার অসংজ্ঞায়িত। কোয়ান্টাম মেকানিকসে কণাকে তরঙ্গ সমীকরণ আকারে দেখানো হয়। সাধারণত এদের আয়তনশূন্য একক বিন্দু কণা বিবেচনা করা হয়। আয়তনশূন্য ও ভর অশূন্য হলে কণার ঘনত্ব হয় অসীম। কারণ, ঘনত্ব পাওয়া যায় ভরকে আয়তন দিয়ে ভাগ করে। আয়তনশূন্য হলে ভাগ দিতে হয় শূন্য দিয়ে। অবস্থাভেদে যাকে অসীম বা অসংজ্ঞায়িত দুটোই বলা চলে।

গণিতবিদ বলুন কিংবা পদার্থবিদ, অসীম এড়িয়ে চলতে চান সবাই। কারও কারও মতে, ইলেকট্রনদের মতো কণাদের আকার জিজ্ঞেস করা একটি অর্থহীন প্রশ্ন। মূলত মৌলিক কণারা আসলে ভৌত অর্থে কোনো বস্তুই নয়। তাই সে অর্থেই এদের আকার নেই। যদিও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় আকার নামে বিমূর্ত একটি ধারণা আছে।

তাহলে সবচেয়ে ছোট কে? এর কয়েকটি সান্ত্বনা উত্তর আছে। আমরা প্রোটনের আকার জানি। যদিও প্রোটন আসলে যৌগিক কণা। ২০১৯ সালের দুটি আলাদা পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে প্রোটনের ব্যাসার্ধ শূন্য দশমিক ৮৩৩ ফেমটোমিটার। দশমিকের পর ১৪টি শূন্য দিয়ে ১ লিখলে যা হয়, ১ ফেমটোমিটার সমান তত মিটার। ভাবুন তাহলে কত ছোট! তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রোটনের চেয়ে ছোট আকারের এমন কোনো বস্তু নেই যার দৈর্ঘ্য আমরা পরিমাপ করতে পারি। ওদিকে কোয়ার্ক দিয়ে গড়া আরেক যৌগিক কণা নিউট্রন প্রোটনের চেয়ে সামান্য বড়। ব্যাসার্ধ শূন্য দশমিক ৮৫ ফেমটোমিটার।

তাহলে আসলেই কে সবচেয়ে ছোট বা তার কত তা জানার উপায় কী? এখন পর্যন্ত আসলে ইলেকট্রন ও কোয়ার্করা অবিভাজ্য কণা হলেও বিজ্ঞানীরা আসলে জানেন না এরাই প্রকৃতির সবচেয়ে ছোট সম্ভাব্য বস্তুকণা কি না। আগেই বলেছি, পরীক্ষায় দেখা যায়, ইলেকট্রন, কোয়ার্কদের মতো মৌলিক কণারা বিন্দুর মতো আচরণ করে। দখল করে না স্থান। ফলে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো জটিল হয়ে পড়ে। কারণ, আপনি একটি বিন্দুর দিকে অসীম পরিমাণ নিকটবর্তী হতে পারেন। ফলে ক্রিয়াশীল বলও হবে অসীম। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা অসীম নিয়ে এত বিব্রত।

সমাধান হয়তো আছে স্ট্রিং থিওরির কাছে। তত্ত্বটি বলছে, কণাগুলো আসলে বিন্দুর মতো নয়। বরং স্ট্রিং বা সুতা বা তন্তুর ফাঁসের (লুপ) মতো। তন্তুর ফাঁসের দিকে তো আর অসীম পরিমাণ যেতে থাকা সম্ভব নয়। কারণ, ফাঁসের একটি অংশ অন্য অংশের চেয়ে কাছে থাকবেই। এই ফাঁসের মাধ্যমে অসীম নিয়ে সৃষ্ট কিছু সমস্যার সমাধান করা যায়। এ কারণে স্ট্রিং তত্ত্বকে অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো, তত্ত্বটির পক্ষে কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই।

সমাধানের আরেকটি রাস্তা চিন্তা করা যায়। স্থান হয়তো অবিচ্ছিন্ন (continuous) ও মসৃণ নয়। হয়তো বিচ্ছিন্ন পিক্সেল বা কণা দিয়ে গঠিত। যাকে অনেক সময় বলা হয় স্থান-কালের ফেনা (space-time foam)। এভাবে ভাবলেও দুটো কণা একে অপরের অসীম পরিমাণ কাছাকাছি হতে পারে না। কারণ, তারা সব সময় বিচ্ছিন্ন ন্যূনতম কণার সাইজ পরিমাণ দূরত্বে আলাদা আলাদা থাকবে।

সবচেয়ে ছোট বস্তুর রহস্যের সমাধানের পথ এখানেই শেষ নয়। সবচেয়ে ছোট বস্তুটি হতে পারে ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রের সিঙ্গুলারিটি। ব্ল্যাকহোলে এত বেশি পরিমাণ পদার্থ খুব ছোট্ট জায়গায় এমনভাবে গুটিয়ে থাকে যে সবগুলো বস্তু ভেতরের দিকে গিয়ে সংকুচিত হতে হতে সবকিছু একটি বিন্দুতে গিয়ে অবস্থান নেয়। ফলে বিন্দুটির আকার হয় শূন্য। আর ঘনত্ব হয় অসীম। এ বিষয়ে একটু আগেও আমরা কিছুটা আলোচনা করেছি। মজার ব্যাপার হলো, ব্ল্যাকহোল থেকে আলো বের হতে না পারার সীমানা কিন্তু অনেক বড় হতে পারে। যার নাম ঘটনা দিগন্ত। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের নিজের আকার কিন্তু সেই বিন্দুই।

তবে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই বলছেন, ব্ল্যাকহোলের ঘনত্ব অসীম হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা দুটো তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকস। দুটো তত্ত্বের সম্পর্ক দা-কুমড়ার মতো। মৌলিক বল মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকতা। আর অপর তিন বল চলে কোয়ান্টাম মেকানিকস দিয়ে। একের জগতে অন্য তত্ত্ব কাজ করে না। তাই বিজ্ঞানীদের মতে, আসলে দুটো তত্ত্বের অনৈক্যের ফলেই অসীমের মতো ধারণার জন্ম হয়েছে। দুটো তত্ত্বকে ঐকতানে আনা সব পদার্থবিদেরই স্বপ্ন। স্বপ্নময় সেই সমন্বিত তত্ত্বের নাম কোয়ান্টাম মহাকর্ষ। হয়তো কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব পাওয়া গেলেই ব্ল্যাকহোলের সত্যিকারের রহস্য উন্মোচিত হবে।

পদার্থবিদ অ্যান্ডি পার্কার বিবিসিতে এ নিয়ে মহাবিশ্ব কত ছোট নামে একটি অনুষ্ঠান করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না ব্ল্যাকহোলের ঘনত্ব অসীম হতে পারে। হয়তো সেটা কোয়ার্কের চেয়েও অনেক অনেক ছোট। হতে পারে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য আমরা দেখেছি, সেটা তার চেয়ে কোটি কোটি গুণ কিংবা তার চেয়েও ছোট।’

এটা হয়ে থাকলে সিঙ্গুলারিটির আকার হবে স্ট্রিংয়েরই সমান। অবশ্য যদি স্ট্রিং বলতে সত্যিই কিছু থেকে থাকে।

আবার এমনও হতে পারে, স্ট্রিং, সিঙ্গুলারিটি বা মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোট কণা সবাই প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমান। কোয়ান্টাম মেকানিকসে প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ধ্রুবক। এর মান হলো দশমিকের পর ৩৪টি শূন্য দিয়ে তারপর ১৬। গালভরা শব্দ দিয়ে বললে সংখ্যাটি হবে ১.৬ × ১০-৩৪। তাত্ত্বিকভাবে মনে করা হয়, এর চেয়ে ছোট কোনো দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে কোনো যন্ত্র দিয়েই প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্য মাপা সম্ভব নয়। অনিশ্চয়তা নীতির একটি সরল রূপ হলো, অতিপারমাণবিক কণাদের অবস্থান ও বেগ একই সঙ্গে মাপা যায় না। এর একটি যত ভালোভাবে বের করা হবে, অপরটি তত অনিশ্চিত হয়ে যাবে। আসলে প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যই বলে কতটুকু অনিশ্চিত হবে। কণার বেগ মাপলে এর অবস্থান প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের চেয়ে সূক্ষ্ম করে মাপা সম্ভব নয়। তাহলে কী দাঁড়াল? মহাবিশ্বে প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের চেয়েও ছোট কিছু থাকলেও সেটা আমরা মাপতেই পারব না। কারণ, এর চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যে মহাবিশ্ব হয়ে যাবে সম্ভাবনানির্ভর ও অনির্ণেয়। তার মানে আপাতত প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যই আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোট জিনিসের সম্ভাব্য আকার।

তবে এ বিষয়ে আরও পরিষ্কার উত্তর পেতে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব খুব প্রয়োজন।

লেখক: প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা ক্যাডেট কলেজ

সূত্র: স্টাডি ডট কম, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, সক্রেটিক ডট অর্গ, লাইভসায়েন্স ডট কম, স্ট্যানফোর্ড এজু, বিবিসি ডট কম, স্পেস ডট কম