গুপ্ত কণিকাদের কাণ্ড

মহাবিশ্বের মাঝে এক ছায়া-মহাবিশ্ব বাস করে। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের চেয়ে এই না দেখা ছায়া-মহাবিশ্বের ভর অনেক বেশি। এই অজানা মহাবিশ্ব অচেনা সব পদার্থ দিয়ে তৈরি। সেগুলো ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত পদার্থ বলে পরিচিত। গুপ্ত হলেও সেগুলো কিন্তু কালো নয়। কালোকে সহজেই চেনা যায়, কয়লা কালো, ভ্রমর কালো, শ্রাবণের মেঘের রং কালো। মহাবিশ্বের এই গুপ্ত পদার্থের স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ কিছুই নেই। ওরা যে আছে গুপ্ত কণিকারা সে কথা জানিয়ে দেয় শুধুই মহাকর্ষ বলের খেলা দেখিয়ে। মহাশূন্যে আছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। কোটি কোটি নক্ষত্র নিয়ে গ্যালাক্সিগুলো ছোটাছুটি করে, বনবন করে ঘোরে। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে যে পদার্থ আছে তার মহাকর্ষ বল থেকে এই গতিবেগ সম্ভব নয়।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতে, পদার্থ আলোকে বেঁকে চলতে বাধ্য করে, দূরদূরান্তের আলো গ্যালাক্সির টানাটানি পেরিয়ে আমাদের কাছে এঁকেবেঁকে এসে পৌঁছায়। বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে যে পরিমাণ বাঁক পান, যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপা বাঁক তার চেয়ে অনেক বেশি। এ হয়তো সেই গুপ্ত পদার্থের কারসাজি! কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় বসে এবং কেমন করে যে ওরা টানাটানি করছে, সেসব খবর ওরা লুকিয়ে রেখেছে। ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম। এক বিলিয়ন বছর পর এই অচেনা গুপ্ত পদার্থ গ্যালাক্সি বানাতে হাত লাগিয়েছিল। মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল আলো দিয়ে। আলো থেকে পরে পদার্থ এবং গুপ্ত পদার্থের জন্ম। যে আলোটুকু বাকি রয়ে যায় তাকে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা পটভূমি বিকিরণ বলে ডাকা হয়। যে আলো আমরা চোখে দেখি তার তুলনায় এরা অনেক ধীরে ধীরে নাচে, এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১ মিলিমিটারের মতো। মহাবিশ্ব একসময় পিণ্ডময় হয়ে পড়ে—এখানে ঘন, ওখানে হালকা। তাপমাত্রাও তেমনি কোথাও কম কোথায়ও বা বেশি। বিজ্ঞানীদের ক্যামেরায় শিশু মহাবিশ্বের ঘনত্ব এবং তাপমাত্রার ছবি তোলা হয়েছে, ডাক্তার যেমন মায়ের পেটের ভেতরে ভ্রূণের ছবি তোলেন! সেই ছবিতে গ্যালাক্সিগুলোর আভাস পাওয়া যায়, সেখানে গুপ্ত পদার্থের অদৃশ্য আঙুলের ছাপ আছে।

মহাবিশ্বে এমন সব ভারী কণা থাকতে পারে যারা সহজে কাউকে ধাক্কা দেয় না, কেউ সহজে ওদের ধাক্কা দিতে পারে না। এ ধরনের কণিকাদের উইম্প (WIMP) বলে ডাকা হয়, পুরো নাম Weakly interacting massive particle (মিথস্ক্রিয়া না করা ভারী কণা)। মহাবিশ্বের সাধারণ পদার্থ ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি। নিউট্রন ও প্রোটন আবার কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। এদের ব্যারিওন (Baryon) বলে ডাকা হয়। গত এক শ বছরে একটু একটু করে ব্যারিওন কণাদের স্বভাব-পরিচয় সব জানা হয়ে গেছে। এখন বিজ্ঞানীরা লেগেছেন গুপ্ত পদার্থের পেছনে, যাদের নন-ব্যারিওন কণা বলে ভাবা হচ্ছে। কারও কারও হিসাবমতে, মহাবিশ্বের ৯০ শতাংশ পদার্থই এই রকম নন-ব্যারিওন পদার্থ দিয়ে তৈরি। তবে এ হিসাবের ওপর ভরসা করার দিন এখনো আসেনি, প্রায় সবকিছুই তো অজানা।

অচেনা কণিকা ধরার জন্য পদার্থবিদেরা অনেক রকম ফাঁদ তৈরি করেন। ফাঁদে ধরা না দিলে শক্তি থেকে ওদের বানানোর চেষ্টা করা হয়। ২০১২ সালে এমন করেই বানানো হয়েছিল হিগস বোসন কণিকা। কিন্তু আবিষ্কারের আগেই কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব থেকে হিগস বোসনের খুঁটিনাটি সব গুণ পদার্থবিদদের জানা ছিল। তাই ইউরোপের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে প্রায় আলোর বেগে ছুটে চলা দুটি প্রোটন কণার মুখোমুখি সংঘর্ষে যখন আরও অসংখ্য কণিকা তৈরি হলো, তখন তাদের ভিড়ের মাঝে হিগস বোসনকে খুঁজে নিতে বিজ্ঞানীদের তেমন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু গুপ্ত কণিকাদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না।

ওরা আছে, মহাবিশ্বের আর সবকিছুর ওপর ওরা মহাকর্ষ বল প্রয়োগ করে, এটুকুই শুধু আমাদের জানা! হ্যাড্রন কোলাইডারে ওদের বানানো গেলেও কোটি কোটি কণাদের ভিড়ে ওদের চিনব কী করে? ওরা আরশিনগরে বাস করা পড়শিদের মতো, একসঙ্গে বাস করি কিন্তু জানাজানি নেই একেবারে।

গুপ্ত কণিকারা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ পছন্দ করে না। ওদের এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে ওদের খুঁজে বের করা যায় কি? ধরা যাক, এক মাঠে অসংখ্য লোক এলোমেলোভাবে ছোটাছুটি করছে। আমি যদি চোখ বুজে মাঠের এপার থেকে ওপারে যেতে চাই তাহলে অনেকবার ধাক্কা খেতে হবে। ধরা যাক, একজন আছে যাকে গুপ্ত মানুষ বলে ডাকা যেতে পারে, সে ভিড় ঠেলে প্রায় ধাক্কাধাক্কি না করেই চলতে পারে, কেমন করে তা আমাদের নাই-বা রইল জানা। তাহলে এই মাঠে কে সবচেয়ে কম ধাক্কাধাক্কি করছে তার অনুসন্ধান করে সেই অচেনা গুপ্ত মানুষের খোঁজ মিলতে পারে। তবে মাঠটি কোনো নির্জন স্থানে হলে ভালো হয়, না হলে অসংখ্য বাড়তি সংঘর্ষের হিসাব মেলাতে হবে! আকাশ থেকে সারাক্ষণ ঝরছে কসমিক রশ্মি, আরও কত কণা-প্রতিকণাদের ঘোরাঘুরি। ওরা যেন অকারণ ঝামেলা না বাধায় তাই গুপ্ত কণিকা ধরার ফাঁদটি পাততে হবে মাটির অনেক গভীরে। বিজ্ঞানীরা তাই করেছেন।

গুপ্ত কণিকা ধরার আশায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ডাকোটা অঙ্গরাজ্যের একটি পরিত্যক্ত স্বর্ণখনিতে বিজ্ঞানীরা এমনই এক ফাঁদ পেতে বসে আছেন ৯ বছর ধরে। ভূগর্ভের দেড় কিলোমিটার নিচে গড়া গবেষণাগারে গুপ্ত কণিকা ধরার এই গবেষণার নাম ভূগর্ভে বিশাল জেনন পরীক্ষা, সংক্ষেপে লাক্স (LUX)। এখানে এক বিশাল পাত্রে মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৭০ হাজার গ্যালন তরল জেনন গ্যাস রাখা আছে।

যেকোনো চেনা কণা এই পাত্রের এপার থেকে ওপারে যেতে গেলে জেনন নিউক্লিয়াসের সঙ্গে কয়েকবার ধাক্কা খেতে বাধ্য, কিন্তু অচেনা গুপ্ত কণিকা ধাক্কা খাবে বড়জোর দু-একবার। এই ধাক্কাধাক্কির অনুপাত থেকে গুপ্ত কণিকাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানীদের দুর্ভাগ্য, এমন ধাক্কা আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি।

দার্শনিকের কাজ নাকি আঁধার ঘরে এক কালো বিড়ালের খোঁজ করা, যে সেখানে নেই! এখন বিজ্ঞানীরা ওই কাজে লেগেছেন। কোনো কোনো হতাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, গুপ্ত কণিকারা অন্য কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বে বাস করে। তাহলে এই পৃথিবীতে ফাঁদ পেতে কী লাভ? ওরা চিরদিন নাগালের বাইরে থেকে আমাদের কাজে নাক গলাবে!

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত