দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড

বিজ্ঞানী নিলস বোর ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্র পড়াচ্ছিলেন। দুঃসংবাদটা সেখানেই পেলেন। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আক্রমণ করে আবার একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধে আইনস্টাইনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন রোজেন ও পোডোলস্কি নামে আরও দুজন বিজ্ঞানী। কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ডেসক্রিপশন অব ফিজিক্যাল রিয়েলিটি বিষয়ে এই লেখাটি বেরিয়েছিল ১৯৩৫ সালে আমেরিকার ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে। সেদিনকার মতো পড়াশোনা সব চুলোয় গেল। এর একটা মোক্ষম জবাব দিতে হবে। বোর ভাবতে শুরু করলেন, সেই সঙ্গে পায়চারি। এটা বোর সাহেবের ছেলেবেলার অভ্যাস। সব যুক্তিতর্ক তাঁর মাথার ভেতরে খেলা করে, কাগজ-কলমে এসব লিখতে তাঁর ভয়ানক আলসেমি। হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন এবং আলো ছড়ানো নিয়ে তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বটি নিজে না লিখে তাঁর প্রেমিকা ও ভাবি বধূ মারগ্রেদকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। প্রেমিকার ভালোবাসার এমন অপচয় আর কেউ কি কখনো করেছে! লিখতে আলসেমি, কিন্তু তর্ক করতে বোর সাহেবের জুড়ি নেই, তর্কে হার স্বীকার না করা পর্যন্ত তাঁর প্রতিপক্ষের নিস্তার নেই। একবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আরেক দিকপাল শ্রোডিংগারকে বাসায় ডেকে এনেছিলেন তর্ক করার জন্য। কয়েক দিনের ক্রমাগত তর্কে শ্রোডিংগার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে বোরের মমতাময়ী বউয়ের সেবা-যত্নে শ্রোডিংগার সুস্থ হয়ে ওঠেন!

কোয়ান্টাম তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ভুতুড়ে বিশ্বাসের ওপরে। যেমন ওয়েভ ফাংশন, অবস্থার জড়াজড়ি (Superposition of states) এবং ওয়েভ ফাংশনের পতন (Collapse of the wave function)। বস্তু ঢেউয়ের মতো আচরণ করে, ওয়েভ ফাংশন হলো সেই ঢেউ। একে বলা হয় সম্ভাবনার ঢেউ। একটি আধুলি ওপরে ছুড়ে দিলে তা ঘুরতে থাকবে, ওর দুটি সম্ভাবনা, হেড এবং টেইল ওয়েভ ফাংশনে জড়াজড়ি করে থাকবে। মাটিতে পড়লে ওর একটা সম্ভাবনাই শুধু বেঁচে থাকবে। দুটি সম্ভাবনা থেকে ওয়েভ ফাংশন একটি সম্ভাবনায় পতিত হয়েছে। ওয়েভ ফাংশনের এক অংশ কাল্পনিক, তাই সরাসরি মাপার উপায় নেই। এসবই ভূতে বিশ্বাস করার মতো। কিন্তু এই ভুতুড়ে তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী মারাত্মক নির্ভুল। একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর কথা ধরা যাক। ওর সব খবর মিলবে পরমাণুটির ওয়েভ ফাংশনের কাছে। একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনটি কয়েকটি কক্ষপথে ঘুরতে পারে। কোয়ান্টাম তত্ত্বমতে, ইলেকট্রনটি একই সঙ্গে সব কক্ষপথে ঘোরাঘুরি করে!

কিন্তু আমি যদি ইলেকট্রনটির অবস্থান মাপতে চাই তবে ওকে পাওয়া যাবে কোনো একটি বিশেষ কক্ষপথে। যদি ১০০টা পরমাণুর ওপরে আলাদাভাবে একই পদ্ধতিতে ১০০ জন বিজ্ঞানী পরীক্ষা করেন, তবে সবার ফল এক হবে না। কেউ দেখবেন ইলেকট্রন এক নম্বর কক্ষপথে ঘুরছে, কেউ তাকে পাবেন দুই নম্বর কক্ষপথে। বাস্তবতা বা সত্য বলতে তাহলে কিছু নেই, সবই নির্ভর করে দর্শক (observer) এবং তার যন্ত্রপাতির ওপরে! কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো আইনস্টাইন কখনো মেনে নিতে পারেননি।

১৯৩৫ সালে আইনস্টাইনের এই লেখাটি ছিল একটি কাল্পনিক পরীক্ষা বা থট এক্সিপেরিমেন্ট। এমন পরীক্ষায় যুক্তিতর্কের বেড়াজালে মনগড়া সব ঘটনা সাজানো হয়, যা থেকে তত্ত্বের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে নেওয়া যায়। সে যুগের যন্ত্রপাতি দিয়ে আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী মাপা সহজ ছিল না, তাই আইনস্টাইন কল্পনার আশ্রয় নিতেন। ‘আমি একজন শিল্পী, কল্পনার ঝুলি থেকে বের করি বিজ্ঞানের সত্য’, এই কথা আইনস্টাইন বারবার বলেছেন। এই কাল্পনিক পরীক্ষাটি অনেক নামে পরিচিত; দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড (Spooky action at a distance), আইনস্টাইন-পোডোলস্কি-রোজেন আপাতবিরোধী ঘটনা (Einstein-Podolosky-Rosen Paradox, or EPR paradox), এবং কোয়ান্টাম জড়াজড়ি (Quantum entanglement)। ইদানীংকালে এই কাল্পনিক পরীক্ষাটি ল্যাবে করা হয়েছে অনেকবার। এই পরীক্ষাটির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড়া, ইলেকট্রনের স্পিন, ফোটন কণার পোলারাইজেসান, ইত্যাদি সব জটিল ব্যাপার। তবে আমি অতি সাধারণ মানুষের ভাষায় লিখতে চাই, এটিকে একটি কাল্পনিক গল্প হিসেবে ধরে নিতে পারেন।

আমার সামনে একটা পুতুল রয়েছে। আমি একটি হাতুড়ি দিয়ে পুতুলের কান দুটি থেকে আলাদা করে ফেললাম। আমার কাছে এখন আছে একটি বাম কান এবং একটি ডান কান। কান দুটিকে চোখ বুজে দুটি আলাদা বাক্সে ভরে তালাবন্দী করে রাখলাম, কোন বাক্সে কী আছে তা আমার জানা রইল না। আমি একটি বাক্স নিয়ে বসে রইলাম পৃথিবীর এই কোনায়। আমার এক বন্ধু অন্য বাক্সটি নিয়ে চলে গেল হাজার কোটি বছর দূরের এক গ্যালাক্সিতে। আমাদের বাক্স এবং ওর ভেতরে লুকিয়ে রাখা কান কোয়ান্টাম কণিকা নয়। তবু ধরে নিচ্ছি যে কান দুটি কোয়ান্টাম কণিকা হিসেবে আচরণ করছে।

আমি এই কান দুটিকে আরেকটি ভুতুড়ে ক্ষমতা দিতে চাই, ওরা কথা বলতে পারে! আমার বাক্সবন্দী কানটি কী কথা বলছে তা একটু শোনা যাক, জানি না আমি বাম না ডান কান। জানা না জানার ঢেউয়ে দোল খাচ্ছি, হয়তো প্রকৃতিও জানে না। কখনো মনে হয় ডান, কখনো বা বাম।

বাইরের কেউ এসে বাক্স না ভাঙলে আমি জানতে পারব না আমি কে বা কী! ধরুন এই মুহূর্তে আমি আমার বাক্সটি খুলে ফেললাম। পেলাম ডান কান। আমার বাক্সবন্দী কানটি জানিয়ে দিল, আমি জেনে গেছি, আমি হলাম ডান কান। দূর গালাক্সিতে আমার বন্ধুর বাক্সবন্দী কান সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল সেই কথা, তার বাক্স খোলার আগেই সে জেনে গেল যে সে বাম কান। এবার আমার বন্ধু যদি তার বাক্সটি খোলে তবে তাকে বাম কানটি পেতেই হবে! আমার বাক্স খোলার ফলাফল কেমন করে যেন হাজার আলোক বছরের দূরের গ্যালাক্সিতে মুহূর্তে পৌঁছে গেছে! আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বমতে কোনো খবর আলোর চেয়ে বেগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে না। এখানে তো তাই হয়েছে!

১৯৫৫ সালে আইনস্টাইন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দূর থেকে কোয়ান্টাম কণিকাদের এই ভুতুড়ে যোগাযোগের ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে। আইনস্টাইনের হার হয়েছে কি? বাস্তবতা নিয়ে আইনস্টাইনের ধারণা পরাজিত হয়েছে, কিন্তু তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এখনো ভালোভাবেই বেঁচে আছে। এই ভূতের সংলাপ দিয়ে কোনো সত্যিকার খবর আলোর চেয়ে বেগে পাঠানোর পথ এখনো কেউ বাতলাতে পারেনি। বোর সাহেবের মতে দুটো কণিকাকে আলাদা করে ভাবাটাই ভুল, ওরা যত দূরেই থাক। তবু অনেক কথা থেকে যায়। মহাবিশ্বের দুই প্রান্তের দুটি কণিকা কেমন করে তাত্ক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করে? এমন কোনো পদ্ধতি যা বোঝার সাধ্য মানুষের নেই! ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগের মহাবিস্ফোরণের মুহূর্তে এই মহাবিশ্ব ছিল একটি বিন্দু, আমরা সবাই সেখানে জড়াজড়ি করে ছিলাম, সেই নাড়ির বাঁধন এখনো অটুট আছে। কেমন করে কে জানে!

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র