পদার্থের চতুর্থ রূপ

আজ পদার্থের চতুর্থ রূপের গল্প শোনাব, যার সঙ্গে ঘর বাঁধতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের দুর্ভোগের আর সীমা নেই। পদার্থের এই রূপের নাম প্লাজমা। ওকে বোতলে বন্দী করে পদার্থবিদেরা শক্তি বানাতে চান। কিন্তু ওকে আগলে রাখা যাচ্ছে না। কারণ, প্লাজমা আসলে পলকা, ভঙ্গুর, অথচ অশৃঙ্খল, বেপরোয়া, অপরাজেয়, অদম্য, অনধিগম্য।

পদার্থ পাঁচটি রূপে (states) বিরাজ করে: কঠিন, তরল, গ্যাস, প্লাজমা (plasma) এবং বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট (Bose-Einstein condensate)। পদার্থের চতুর্থ রূপ প্লাজমা নিয়ে গবেষণা চলছে প্রায় ৬০ বছর ধরে, প্লাজমা থেকে পাওয়া যেতে পারে অফুরন্ত শক্তি। বস্তুর বাইরের আবরণের মাঝে লুকিয়ে আছে অসংখ্য পরমাণু, এই পরমাণুগুলো ক্রমাগত দোল খাচ্ছে, দৌড় দিচ্ছে। বৈদ্যুতিক বল পরমাণুগুলোকে বেঁধে রেখেছে, পরমাণুর পায়ে একধরনের অদৃশ্য শিকল পরিয়ে রেখেছে। রসায়নবিদেরা এই শিকলের নাম দিয়েছেন রাসায়নিক বন্ধন (Chemical bond)। কঠিন বস্তুর শিকলের বন্ধন বেজায় শক্ত, তাই ওর একটা নির্দিষ্ট আকার এবং আয়তন আছে। তরল দশায় এই শিকলের বাঁধন পলকা, তাই ওর নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই, গ্যাসের বেলায় এই শিকল গেছে ছিঁড়ে, তাই ওর আকার, আয়তন কোনোটাই নেই। একটি কঠিন ক্রমাগত উত্তাপ দিলে পরমাণুগুলো জোরে ছোটাছুটি শুরু করে, শিকলে লাগে টান, শেষমেশ শিকলগুলো ভেঙে যায়। এভাবেই কঠিন বস্তু প্রথমে তরল হয়, তারপরে হয়ে যায় গ্যাস। এই গ্যাসের তাপমাত্রা বাড়িয়ে যদি এক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের দিকে নিয়ে আসা যায়? পরমাণুগুলো তখন পাগলের মতো ছোটাছুটি করে, একজন আরেকজনের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে। এমনকি পরমাণুর নিজের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। পরমাণুর মাঝে আছে নিউক্লিয়াস, সেখানে প্রোটন আর নিউট্রনের নিবাস, যার চারদিকে ঘুরছে ইলেকট্রন। বৈদ্যুতিক আকর্ষণ ইলেকট্রনগুলোকে আটকে রেখেছে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে। এই নতুন শিকল আরও মজবুত। যে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের যত কাছে, তার শিকলের বাঁধন ততই শক্ত। দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যে আগুন জ্বলছে, তা কোনো শিকলকেই পরোয়া করে না।

পদার্থের বিভিন্ন অবস্থা

এ যেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বন্দীশালা, ভীম কারার ভিত্তি নড়ে উঠেছে, সব শৃঙ্খল একসঙ্গে ঝনঝন করে বাজছে। ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর বাঁধন ছিঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসছে, ঢুকে পড়ছে অন্য কোনো পরমাণুর ঘরে। সেখানে কিছুক্ষণ নাচানাচি করে আবার ছুটছে অন্য কোনো পরমাণুর খোঁজে। এটাই হলো পদার্থের প্লাজমা রূপ। ইলেকট্রনহারা পরমাণুগুলো ধনাত্মক (positively charged) নিউক্লিয়াস, এরা একে অপরকে বিকর্ষণ করে। তবু প্রচণ্ড গতিতে চলা এই পাগলপারা নিউক্লিয়াসগুলো বৈদ্যুতিক বিকর্ষণের দেয়াল ভেঙে একে অপরের গায়ে প্রচণ্ড বেগে গুঁতো দেয়। এই গুঁতোগুঁতির লগ্নে ওরা বৈদ্যুতিক বলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রবল শক্তিধর নিউক্লিয়ার বলের হাতের মুঠোয় ঢুকে পড়ে। বৈদ্যুতিক বলের চেয়ে ১৩৭ গুণ শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের হাত থেকে তো আর নিস্তার নেই, এই বলের প্রচণ্ড চাপে দুটো নিউক্লিয়াস একসঙ্গে মিলেমিশে একটি নতুন নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। একেই বলে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। দুটি হালকা পরমাণু এভাবে জোড়া লাগিয়ে একটি ভারী পরমাণু বানালে কিছু পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আকাশের প্রতিটি নক্ষত্র এভাবেই শক্তি তৈরি করে।

সাধারণ তাপমাত্রায় চার ধরনের মৌলিক বলের খোঁজ মেলে, মহাকর্ষ, দুর্বল নিউক্লিয়ার, বিদ্যুত্চুম্বকীয় এবং শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। এর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ এবং বৈদ্যুতিক বলের গুঁতো আমরা সব সময় টের পাই। আমি চেয়ারে বসে আছি। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ আমাকে ওই কেন্দ্রের দিকে টানছে, চেয়ারটা আমাকে উল্টো দিকে ঠেলছে, এই বলগুলো আমি বেশ টের পাচ্ছি। এই দুটি পরস্পরবিরোধী বলের মাঝে একটা সমতা এসেছে, তাই আমি স্থির হয়ে বসে আছি। কিন্তু চেয়ারটি আমাকে ওপরের দিকে ঠেলছে কীভাবে? একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে চেয়ারটা একটা মরীচিকা। চেয়ারটা তৈরি কোটি কোটি পরমাণু দিয়ে, পরমাণু আবার তৈরি ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে। চেয়ারের আয়তনের তুলনায় এই কণাগুলোর আয়তন একেবারেই নগণ্য। যে কঠিন বস্তুটিকে আমি চেয়ার ভেবে বসে আছি, আসলে তা প্রায় একটি ফাঁকা জায়গা। একটা চাকুর ফলা আমের ভেতরে সহজেই ঢুকে পড়ে। কেমন করে? চাকুর ফলা যখন ঢুকছে, আমের পরমাণুগুলো সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিচ্ছে। আমি যাকে আম ভেবে বসে আছি, সে-ও ফাঁকা একটি স্থান, কতগুলো পরমাণু প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে এই ফাঁকা স্থানটিতে। আম, চেয়ার, আমি সবই মায়া। ‘Reality is an illusiion, albeit, a persistent one.’ আইনস্টাইন বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথের কথাও একটু শোনা যাক, ‘ঈশ্বর কাঁপিতেছে, আমি দেখিতেছি আলো, বাতাসে তরঙ্গ উঠিতেছে, আমি শুনিতেছি শব্দ; ব্যবচ্ছেদবিশিষ্ট অতি সূক্ষ্মতম পরমাণুর মধ্যে আকর্ষণ-বিকর্ষণ চলিতেছে, আমি দেখিতেছি বৃহত্ দৃঢ় ব্যবচ্ছেদহীন বস্তু।’ চেয়ার আমাকে ওপরে ঠেলছে কী করে? আসলে চেয়ার এবং আমি ঠেলাঠেলি করছি না, আমার শরীরের ইলেকট্রন ও চেয়ারের ইলেকট্রনগুলোর বৈদ্যুতিক বিকর্ষণকেই আমার আর চেয়ারের ঠেলাঠেলি ভেবে ভুল করছি। শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল বেজায় শক্তিমান, কিন্তু ওর প্রভাব নিউক্লিয়াসের ভেতরেই সীমাবদ্ধ, দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের প্রভাব বলয় আরও ক্ষুদ্র, প্রোটন, নিউট্রনের ভেতরের কোয়ার্কগুলো নিয়েই এই বল শুধু খেলা করে, বাইরের জগত্ নিয়ে ওর কোনো কৌতূহল নেই। বস্তুর প্লাজমা দশায় এই নিউক্লিয়ার বলগুলো ভয়াবহ ক্ষমতা নিয়ে জেগে ওঠে। শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল দুটো নিউক্লিয়াসকে একসঙ্গে ঠেসে ধরে, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল নিউট্রনকে বানায় প্রোটন, সেই সঙ্গে তৈরি হয় পজিট্রন, নিউট্রিনো, আর অঢেল শক্তি।

একটি বোতলের ভেতর যদি প্লাজমাকে ধরে রাখা যেত, তাহলে ওটা হয়ে যেত ছোট্ট একটা নক্ষত্র। এই পোষ মানানো নক্ষত্র থেকে জোগাড় হতো অফুরন্ত শক্তি। আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো এই বোতলে বন্দী থাকত দুই মহাপরিক্রমশালী দৈত্য, দুই নিউক্লিয়ার বল। একটা বোতলের ভেতরে প্লাজমা বানাতে হবে, তাকে কিছুক্ষণের জন্যে আটকে রাখতে হবে। এই গবেষণায় আমি জীবনের অনেকটা সময় পার করেছি, দেখেছি আমার সহকর্মীদের হঠাত্ খুশি এবং যন্ত্রণা। একটি নক্ষত্রের কেন্দ্রে যে আগুন জ্বলে, তার রূপ আমার চোখের সামনে ক্ষণকালের জন্য নাচবে, সে কী আনন্দ! বহু কষ্টে, বহু সাধনায় তৈরি করা গেল প্লাজমা, বোতলের ভেতরে একটি খুদে নক্ষত্র। আমার কিছু বন্ধু এই ক্ষণস্থায়ী প্লাজমা নক্ষত্রকে নারী (Eve) বলে ডাকত। ওদের আর কি দোষ, কবি নজরুল গেয়েছেন, ‘জাগো নারী, জাগো বহ্নি শিখা।’ ‘এসো আমার ঘরে এসো, আরেকটু থাকো, আরেকটু বসো, তোমাকে প্রাণ ভরে দেখি,’ কত রকম সাধাসাধি। কিন্তু ওকে ধরে রাখা যায় না, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ও যায় হারিয়ে। আমি মনে মনে রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম, ‘ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল, ও চুপিচুপি কি বলে গেল।’

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

* লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত