ফিউচার সার্ক্যুলার কলাইডার

বর্তমানে কণাপদার্থবিজ্ঞানের কথা উঠলেই চলে আসে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার-এলএইচসির কথা। ২০০৮ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই এটি চলে এসেছে কণাপদার্থবিজ্ঞানের আলোচনার একদম সামনের সারিতে। এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দেশের শত শত বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী মিলে খুব সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ কষে এটি নির্মাণ করেছিলেন। ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, যা সবার কাছে সার্ন (CERN) নামে পরিচিত, এর সবচেয়ে বড় অর্জন এই কলাইডার। সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত এই কলাইডার এমন সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূলে ছিল, যেগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর গবেষণা করেছেন কিন্তু কোনো সমাধান পাননি। এমন সূক্ষ্ম সব বিষয়ের সমাধানে এটি সাহায্য করেছে, যেসব বিষয় চোখে তো দূরের কথা অতি শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপেও দেখা যায় না। এই কলাইডারের অন্যতম বড় অবদান হিগস–বোসন কণার আবিষ্কার। দীর্ঘদিন ধরে পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অসম্পূর্ণ ছিল এই কণার অভাবে। এর আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বড় একটা অসম্পূর্ণতা দূর হয়ে যায়।

কলাইডারের বাংলা করলে দাঁড়ায় সংঘর্ষকারক কিংবা চূর্ণিকারক। অণু-পরমাণু স্তরে চূর্ণ কেন দরকার, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কোনো কিছুকে বুঝতে হলে তার নাড়িনক্ষত্র খুলতে হয়, ভেতরটা দেখতে হয়। এই জগৎকে বুঝতে হলে জাগতিক নিয়মনীতিকে বুঝতে হলে জগতের ক্ষুদ্রতম অংশের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। নক্ষত্রের কাজ কী, আচরণ–বৈশিষ্ট্য কী, গ্যালাক্সির কাজ কী, আচরণ–বৈশিষ্ট্য কী—তার উত্তর আছে নক্ষত্রের গাঠনিক উপাদান অণু-পরমাণুর মধ্যে। এখন যদি জাগতিক নিয়মনীতি ও ঘটনা-বৈশিষ্ট্যের আরও গভীরে যেতে চায় কেউ, আরও নিগূঢ় রহস্যের সমাধান খোঁজে কেউ, তাহলে তাকে যেতে হবে পরমাণুর আর‌ও গভীরে। বিশ্লেষণ করতে হবে তার ভেতরটাকে। একে তো আর কাটাছেঁড়া করা যাবে না, করতে হবে চূর্ণ। মাটির ব্যাংক ভাঙলে যেমন এর ভেতরের পাঁচ টাকার পয়সা, দুই টাকার পয়সা, এক টাকার পয়সা কতগুলো আছে, তা জানা যায়, তেমনই পরমাণু ভাঙলে জানা যায় এর নানা বৈশিষ্ট্য। পরমাণুকে আবার চাপ দিয়ে কিংবা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করে চূর্ণ করা যায় না। তীব্র গতিতে (প্রায় আলোর গতিতে) দুটি পরমাণুর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটাতে পারলে ভাঙা যাবে তাদের। আর একটি কলাইডার মূলত এই কাজই করে। বায়ুশূন্য একটি ব্যবস্থায় অতি শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে বিশেষ উপায়ে কণার সংঘর্ষ ঘটায় এবং জানান দেয় অনেক অধরা তথ্য। সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বেশ সাফল্যের সঙ্গে এই কাজ করে এসেছে।

এলএইচসির সাফল্যের পর এবার বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আরও ভালো কিছুর দিকে। এলএইচসির চেয়েও আরও বড় এবং আরও উন্নত একটি কলাইডার তাঁরা তৈরি করবেন। এর নাম ফিউচার সার্ক্যুলার কলাইডার বা FCC। এলএইচসিকে যদি সাধারণ পেরেক মারার হাতুড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এফসিসিকে বলতে হবে পাথর ভাঙার বড় হ্যামার। এলএইচসির চেয়ে এর আকৃতি বড় হওয়ায় এবং এর শক্তি বেশি হওয়ায় এর ভেতরে পরমাণুকে আরও বেশি বেগে সংঘর্ষ ঘটানো যাবে। সংঘর্ষ যত জোরে হবে, এর নাড়িনক্ষত্র তত বেশি বের হবে।

এখন পর্যন্ত এলএইচসিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে শক্তিশালী কলাইডার। এতে যে চক্রাকার রিংয়ের ভেতরে পরমাণুর সংঘর্ষ ঘটানো হয়, তার পরিধি ২৭ কিলোমিটার। উৎপন্ন করতে পারে প্রায় ১৪ টেরা-ইলেকট্রনভোল্ট। বিজ্ঞানীদের পরিকল্পিত এফএফসি যখন নির্মিত হবে, তখন এর চক্রাকার রিংয়ের পরিধি হবে ১০০ কিলোমিটার এবং উৎপন্ন করাতে পারবে ১০০ টেরা-ইলেকট্রনভোল্ট। এতে জড়িত প্রকৌশলীরা বলছেন, এতে থাকবে প্রযুক্তির আধুনিকতম ভ্যাক্যুয়াম সিস্টেম (সম্পূর্ণ চক্রাকার রিং বায়ুশূন্য থাকতে হয়), ১৬ টেসলা হাই-ফিল্ড একসিলারেটর চুম্বক, অতি-পরিবাহী পদার্থ, উন্নত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিস্টেম, ক্রায়োজেনিক শীতলীকরণ ব্যবস্থাসহ আরও আধুনিক সুবিধা।

যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত এই মেগা প্রজেক্টের নির্মাণ সম্পন্ন হবে ২০৩৫ সালে এবং এটি নির্মাণ করতে খরচ হবে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। উন্নত এই প্রজেক্ট নির্মাণ শেষ হলে উত্তর মিলতে পারে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক অজানা রহস্যের, যে রহস্য দীর্ঘদিন ধরে ধাঁধায় ফেলে রেখেছে বিজ্ঞানীদের। কয়েক প্রজন্ম ধরে বিজ্ঞানীরা এর উত্তর খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। এর মধ্যে আছে ডার্ক ম্যাটার সমস্যা ও প্রতিপদার্থ সমস্যা। নজিরবিহীন শক্তিতে পরমাণুকে চূর্ণ করা গেলে দেখা মিলতে পারে এমন সব মৌলিক কণার, যেগুলো সম্পর্কে এখন পর্যন্ত শুধু অনুমানই করা হয়েছে কিন্তু পাওয়া যায়নি কোনো পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ। এসব অনুমান করা মৌলিক কণার দেখা পাওয়া গেলে মিলতে পারে অনেক সমস্যার সমাধান। এই মহাবিশ্বের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ কেন ডার্ক ম্যাটারের দখলে, পুরো মহাবিশ্বে প্রতিপদার্থের চেয়ে সাধারণ পদার্থের পরিমাণ কেন বেশি, প্রতিপদার্থের ছোঁয়ায় পুরো মহাবিশ্ব উবে না গিয়ে কেন বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে, সেসব মিলিয়ন ডলার প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে ফিউচার সার্ক্যুলার কলাইডার থেকে। হয়তো জানা যাবে স্বয়ং হিগস–বোসন গঠিত কী দিয়ে, তা–ও।

বিশ্বব্যাপী ৭০টির বেশি প্রতিষ্ঠান এবং কয়েক হাজারের বেশি বিজ্ঞানী এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করবেন। সবাই মিলে খুঁজবেন মহাবিশ্বের অতি-ক্ষুদ্র জগৎ থেকে অতি-বৃহৎ জগতের নানা রহস্যের সমাধান।

লেখক: শিক্ষার্থী,

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস ও সার্ন