স্থান ও সময় যেভাবে মিলিত হল

মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নেই স্থান এবং সময়ের মিলন হয়ে গেছে৷ ওদের আলাদা নামে না ডেকে এখন স্থান-কাল বলে ডাকা হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এদেরকে এক করার দলিল। ভীষণ সুন্দর এই দলিল অংকের ভাষায় লেখা। তবে প্রথমে আমরা অংক ছাড়াই দলিলটি বোঝার চেষ্টা করব। যখন একেবারেই উপায় থাকবে না, তখন অঙ্কের কাছে হাত বাড়াব৷

আইনস্টাইনের স্ত্রী এবং চার্লি চ্যাপলিন

‘আপনি কি আপনার স্বামীর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বোঝেন?’ সাংবাদিকেরা একবার আইনস্টাইনের স্ত্রী এলসাকে এই প্রশ্ন করেছিল৷ উত্তরে এলসা বলেছিলেন, ‘না, তবে আমি আমার স্বামীকে চিনি। ওকে বিশ্বাস করা যায়।’ অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন এবং আইনস্টাইন একবার একসঙ্গে হাঁটছিলেন। রাস্তার দুই ধারে লোকজন জড়ো হয়ে হাততালি দেওয়া শুরু করল। চ্যাপলিন আইনস্টাইনের কানে কানে বললেন, ‘ওরা হাততালি দিচ্ছে, কারণ ওরা আমার অভিনয় বেশ বোঝে এবং তোমার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব একটুও বোঝে না।’

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মানুষের সারা জীবনের অর্জিত ধারণা একেবারে পাল্টে দেয়, মানুষের সাধারণ জ্ঞানের নিকুচি করে। এই তত্ত্বের অঙ্ক যেমন জটিল, ধারণাগুলো তেমনি পাগলাটে। স্যার আর্থার এডিংটন একজন আপেক্ষিকতা বিশারদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। ১৯১৯ সালে এডিংটন লন্ডন রয়্যাল সোসাইটির মিটিংয়ে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা নিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। মিটিং শেষে বিজ্ঞানী লুডউইক সিলবার্স্টেইন, যিনি নিজেকে আপেক্ষিকতার পণ্ডিত মনে করতেন, জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটা কি সত্যি যে শুধু পৃথিবীর তিনজন মানুষ আপেক্ষিকতা বোঝে?’ এডিংটন বলেছিলেন, ‘আইনস্টাইন এবং আমি বুঝি, কিন্তু তৃতীয় মানুষটি কে?’

সে দিন আর নেই। আজকাল আমার মতো আনাড়িও আপক্ষিকতার তত্ত্ব লিখতে কলম ধরার সাহস করে! তবে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যায় না বোঝা সহজে! তিলে তিলে গড়ে ওঠা সারা জীবনের কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দেওয়া সহজ নয়। কাণ্ডজ্ঞান যা–ই বলুক, মহাবিশ্বের স্থান এবং সময় আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারেই চলে, এখনো এর কোনো ভুল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আইনস্টাইনের দুটি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আছে, প্রথমটি স্থান, কাল এবং আলোর কাণ্ড নিয়ে, ১৯০৫ সালে দেওয়া এই তত্ত্বের নাম বিশেষ আপেক্ষিকতা। ১৯১৫ সালে দেওয়া দ্বিতীয় তত্ত্বটিকে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বলে ডাকা হয়। আমরা প্রথমে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথা বলব।

স্থানের কথা

ইংরেজিতে স্পেস বলে যে শব্দ আছে, তার কোনো যুতসই বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। এখানে আমি স্পেসকে স্থান বলেই উল্লেখ করব। স্থানকে গজকাঠি দিয়ে মাপা যায়, কিন্তু আমি কী মাপছি? শূন্যতা? নাটকের রঙ্গমঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেন, পৃথিবীর নাট্যশালায় আমরা জীবন কাটাই, স্থানের অধিকার নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ-মামলা করি। মহাবিশ্বের রঙ্গমঞ্চে নক্ষত্র, নীহারিকা, গ্যালাক্সি ছুটে চলে। যদি মহাবিশ্ব থেকে সব গ্রহ, তারা, গ্যালাক্সি, কৃষ্ণগহ্বর, এমনকি প্রতিটি অণু, পরমাণু, কণিকাকে সরিয়ে ফেলি, তবে যা বাকি রইল, তা–ই কি স্পেস? ফাঁকা রঙ্গমঞ্চই কি স্পেস? ওখানে কিছু নেই, কিন্তু শূন্যতা আছে! আবার প্রতিটি গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, অণু, পরমাণুর প্রায় সবটাই শূন্যতা বা স্পেস। তোমার শরীরের ভেতরের সব শূন্যতা সরিয়ে ফেললে যা বাকি থাকবে, তা একটি তিলের চেয়ে ছোট্ট। কিন্তু স্পেস ছাড়া সেটাই বা থাকবে কোথায়?

স্পেসের চেয়ে রহস্যময় জিনিস আর নেই! স্পেস কেন আছে? ও না থাকলে কী হতো? স্পেস কি বাস্তব? ওকে কি ধাক্কা মারা যায়? ওর বুকে কি ঢেউ তোলা যায়? ওকে কি বাঁকানো যায়? ওর ভেতরে গর্ত খোঁড়া যায়? স্পেসকে কি সংকুচিত বা প্রসারিত করা যায়? সময়ের মতোই তুমি স্পেসের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ খুঁজে পাবে না। স্পেস সময়ের মতোই আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তুমি ক্যামেরা দিয়ে আমার ছবি তুলতে পারো, কিন্তু আমার ভেতরে যে স্থানজুড়ে আমি বিরাজ করছি, তার ছবি তো ক্যামেরায় আসবে না। ২০১৪ সালে আমেরিকার লাইগো ফাঁদে যখন মাধ্যাকর্ষণের ঢেউ ধরা পড়ল, তখন পৃথিবীজুড়ে হইচই শুরু হয়েছিল। এই ঢেউ তো স্পেসের কম্পন, স্থানের প্রতিটি বিন্দুজুড়ে ঘটেছিল এই কম্পন। এই ঢেউ তোমাকেও দোল দিয়েছিল, তুমি টের পাওনি। শুধু তুমি নও, এই পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, তারা—সবাই দোল খেয়েছিল। তবে এটা দোলনার দোল নয়, এই দোলে তুমি একটু লম্বা হচ্ছিলে, আবার একটু খাটো! মহাবিশ্বের দূরদূরান্তের সব খবর বয়ে নিয়ে আসে আলো। কিন্তু আলোকে সহজেই ঠেকানো যায়, দেয়াল ভেদ করে আলো ওপারে যেতে পারে না, কৃষ্ণগহ্বর আলোকে গিলে খায়। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ ঢেউকে ঠেকাবে কে? স্পেস মহাবিশ্বের কাঠামো, ওটা দুলতে শুরু করলে মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুতে কাঁপন ধরবে আর তা আমাদের জন্যে বয়ে আনতে পারে অনেক অজানা খবর।

সময়ের কথা

‘আড্ডা মেরে সময় নষ্ট না করে সময়টা কাজে লাগা, বই নিয়ে একটু বস,’ এমন বকুনি মার কাছে অনেক শুনেছেন। ‘আমার হাতে একটুও সময় নেই,’ এমন কথা অনেক বলেছেন। কিন্তু সময় আসলে কী? পদার্থবিদ জন হুইলার কৌতুক করে বলেছেন, ‘সময়ের জন্যেই তো সব ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে পারে না!’ তাই তো, সময় না থাকলে আপনার জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে একসঙ্গে হতো, জীবন বলে আর কিছুই থাকত না।

ঘড়ি আবিষ্কারের আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য সময় ছিল দিনের আকাশে সূর্যের অবস্থান, রাতে চাঁদের কলা, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ঋতুর আবর্তন, বীজ বোনা এবং ফসল কাটার মরশুম। সময়কে হাতের মুঠোয় ধরা যায় না, কান দিয়ে শোনা যায় না, জিহ্বা দিয়ে চেখে দেখা যায় না, নাক দিয়ে গন্ধ নেওয়া যায় না, চোখ দিয়ে দেখা যায় না। আপনি আমার ছবি আঁকতে পারন, সময়ের ছবি আঁকা যায় কি? সময় আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে, তবু আমরা সময়কে অনুভব করি। সময় কি বাস্তব? ওকে কি নিয়ন্ত্রণ করা যায়? ধরা যাক, আপনি এক বাতিকগ্রস্ত ছেলে, সবকিছুর মানে অভিধানে খুঁজতে চান। সময়ের সংজ্ঞা ডিকশনারিতে খুঁজতে গেলে দেখবেন লেখা আছে, ‘সময় হলো এমন কিছু, যা পর্যাবৃত্ত গতি (periodic motion) দিয়ে মাপা হয়।’ এবার যদি অভিধানে পর্যাবৃত্ত গতির মানে খুঁজতে যান, দেখবেন লেখা আছে যে এ হলো এমন গতি, যা সময়ের সঙ্গে বারবার একইভাবে চলে। মানেটা এই দাঁড়াল যে সময় বুঝতে পর্যাবৃত্ত গতি এবং পর্যাবৃত্ত গতি বুঝতে সময়কে টেনে আনা হচ্ছে। অর্থাৎ সময় কী, তা অজানাই রইল!

বয়স শুধু বেড়েই চলে। কুঁড়ি থেকে ফুল, ছেলে থেকে বড়ো। সময়ের তির অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে ছোটে। এই চলার গতি কি সবার জন্যে সমান? সবার হাতঘড়ি একই বেগে ঘোরে? যখন বলি, কাল সকাল ১০টায় দেখা করব, তখন আমরা ধরে নিই যে সবার ঘড়ি একই বেগে ঘুরবে। বিজ্ঞানী নিউটন তা–ই মনে করতেন। নিউটন লিখেছিলেন, ‘সময় অঙ্কের মতো বিশুদ্ধ, নিজেকে নিয়ে নিজেই মগ্ন, বাইরে থেকে কোনো কিছুই ওর ওপরে প্রভাব ফেলতে পারে না এবং একই বেগে প্রবাহিত হয়। সময় শর্তহীন, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, নিশ্চিত, সময়ের প্রবাহের ওপর কারও হাত নেই।’ নিউটনের ধারণাগুলো ভুল, আইনস্টাইন এসে জানিয়ে দিলেন।

স্থান-কালের কথা

বোকা লোকদের স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান নেই। কখন কোথায় কী যে করে আর কাকে যে কী বলে বসে! পদার্থবিদ্যায় স্থান-কালকে স্পেস-টাইম বলে ডাকা হয়। কিন্তু ওরা এক হয়ে গেছে, ওরা হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ায়। কান টানলে যেমন মাথা আসে, স্থান ধরে চলা শুরু করলে সময় ধীরে চলে! এমন কথা কে কবে ভেবেছিল! সময় এবং স্থান একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমি যাকে স্থান বলে ভাবছি, আরেকজন ছুটে চলা দর্শক তাকে সময় বলে ভাবতে পারে। এই যেমন আলোর কথা ধরা যাক। আলো সময় বলে কিছুই বোঝে না। আলোর হাতে ঘড়ি পরালে সে ঘড়ির কাঁটা একদম ঘুরবে না! আর আলসে আমি বিছানায় শুয়ে যখন হাই তুলছি, তখন আমার হাতঘড়ির কাঁটা দ্রুততম বেগে ঘুরছে। বিছানা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেই আমার হাতঘড়ি ধীরে চলা শুরু করবে, আমার চলার বেগ ঘড়ির চলার বেগকে কমিয়ে দিয়েছে। ওদিকে আবার চলার সঙ্গে সঙ্গে স্থান সংকুচিত হয়, দূরত্ব কমে যায়, আমার পায়ের জুতো ছোট হয়ে যায়। এসব সত্যি সত্যি হয়, তবে আমার হাঁটার বেগ আলোর তুলনায় এতই কম যে পরিবর্তনগুলো ধরা পড়ে না।

বোকা লোক কী যে বলে, তা সে নিজেই জানে না। পদার্থবিদদের একই দশা। পদার্থবিদেরা স্থান, সময়, পদার্থ, এবং শক্তি নিয়ে কথা বলেন। একজন আনাড়ি পদার্থবিদ হিসেবে বলতে পারি যে আমি এর কোনোটাই বুঝি না। আমি শুধুই এদের মাপতে জানি। যাঁরা বোঝেন বলে দাবি করেন, তাঁদেরকে আমি সন্দেহ করি। এক পদার্থবিদ বলেছিলেন, ‘কোনো কিছু যতই বেশি জানবে, সে ততই রহস্যের আঁধারে হারিয়ে যাবে।’ যেমন স্থান, সময় এবং স্থান-কালের মিলন।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র