হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান কখনো কখনো কল্পনাকেও হার মানায়। বিজ্ঞান আমাদের সব বাস্তবতার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্নটা আমাদের এই বাস্তবতার কতটুকু সেটা নিয়েই! আমাদের অস্তিত্ব আর বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে শেখাচ্ছে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল।

একটি ত্রিমাত্রিক ছবি, একটি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে আঁকার কৌশলই হলো হলোগ্রাফি। আর হলোগ্রাফ হলো দ্বিমাত্রিক তলে আঁকা ত্রিমাত্রিক ছবি। কোনো হলোগ্রাফ বিভিন্ন কোণ থেকে দেখলে বিভিন্ন রকম দেখায়। অর্থাৎ একটি দ্বিমাত্রিক ছবির ভেতর ত্রিমাত্রিক ছবির সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আলোর ব্যাতিচার নকশাকে (ইন্টারফিয়ারেন্স প্যাটার্ন) ব্যবহার করে এ রকমটা করা সম্ভব হয়। দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠ থেকে কীভাবে ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেতে পারে তা সহজেই বোঝা যাবে। কোনো ত্রিমাত্রিক ঘন বস্তুকে আলোর সামনে রেখে সেটার ছায়া যদি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে ফেলা হয় এবং বস্তুটিকে যদি ধীরে ধীরে ঘোরানো শুরু করা হয়, তাহলে দেখা যাবে নির্দিষ্ট নিয়মে ছায়ার আকৃতি-প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। শুধু ছায়ার মাধ্যমেই পরে বস্তুটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এ তো গেল হলোগ্রাফের কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমি-আপনিসহ আমাদের মহাবিশ্বই সম্ভবত একটি হলোগ্রাফিক চিত্র।

হ্যাঁ। এই তত্ত্বমতে, আমাদের পুরো মহাবিশ্ব বিশাল হলোগ্রাফিক চিত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ আমরা যাকে চিরন্তন বাস্তব ভেবে আসছি, তা পরম বাস্তব নয়। এই হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল বলে, আমাদের মহাবিশ্বে ত্রিমাত্রিক স্থানে, যা কিছু ঘটছে তার সব তথ্যই একটি মহাজাগতিক দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে জমা আছে। আর সেই তথ্যের একধরনের হলোগ্রাফিক প্রকাশই হলো এই মহাবিশ্ব। অর্থাৎ আমরা যা কিছু দেখছি, তা মূলত একধরনের উচ্চমাত্রার বাস্তবতার প্রতিফলন।

এখন এই তত্ত্বের শুরুর দিকে আলোকপাত করা যাক। আমাদের মহাবিশ্ব সম্পূর্ণই একরকম হলোগ্রাফ—এই ধারণা মূলত কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত পদার্থবিজ্ঞান থেকে আসে। কোনো বস্তু কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হলে দুটি মূল ঘটনা ঘটে—বস্তুটির সমস্ত তথ্য কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যায়, আর কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পায়। কোয়ান্টাম মেকানিকসে সবকিছুকেই তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ কোনো ঘটনা বা বস্তুকে তথ্যের বিন্যাসরূপে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথম ঘটনাটি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সরাসরি লঙ্ঘন। কেননা বস্তুটির হারিয়ে যাওয়া তথ্যের মধ্যে এনট্রপিও একটি। কিন্তু তাপগতিবিদ্যা এনট্রপি বা অন্য কোনো তথ্যের হারিয়ে যাওয়াকে মানতে নারাজ। তা যদি হয়—এই যে দিগন্তের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার কি কোনো সম্পর্ক আছে? অনেকে তা-ই মনে করেন। হারিয়ে যাওয়া তথ্য কোনোভাবে হয়তো ঘটনা দিগন্তেই জমা হয়। ফলে ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পায় ঘটনা দিগন্তের।

১৯৯৩ সালে জেরার্ড টি হুফট ও লিওনার্ড সাসকিন্ড প্রস্তাব করেন, আমাদের মহাবিশ্বের সমগ্র তথ্যও কৃষ্ণগহ্বরের মতো সংরক্ষিত রয়েছে কোনো দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে। একটি স্থানে যতটুকু তথ্য থাকে, সেটি তার আয়তনের পরিবর্তে ওই অঞ্চলের সীমানার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর প্রমাণও তত দিনে পাওয়া গেছে, প্রকৃতি নিজেই কৃষ্ণগহ্বরে দ্বিমাত্রিক স্থানে তথ্য সংরক্ষণ করে।

হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপলের দুটি স্বীকার্য আছে। এক, কোনো তত্ত্ব (যেমন মহাকর্ষ তত্ত্ব) দিয়ে কোনো অঞ্চলকে (Space) বর্ণনা করা হলে, আর অন্য কোনো তত্ত্ব দ্বারা সমরূপ ঘটনার পৃষ্ঠতলকে বর্ণনা করা হলে তত্ত্ব দুটি সমতুল্য হবে।

দুই, কোনো দ্বিমাত্রিক স্থানে, এক বর্গ প্ল্যাঙ্ক ক্ষেত্রফলে সর্বোচ্চ একটি তথ্য থাকতে পারে, যেখানে ১ প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য = 1.6´10-35 মিটার। অর্থাৎ, আমরা যে ত্রিমাত্রিক জগতে বসবাস করছি, তার সব তথ্য যে মহাজাগতিক পৃষ্ঠে এনকোডেড আছে, সেই পৃষ্ঠের প্রতি বর্গপ্ল্যাঙ্ক ক্ষেত্রফলে সর্বোচ্চ একটি তথ্য রয়েছে।

এই স্বীকার্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপলকে দুভাবে বিবেচনা করা যায়। এক, আমাদের মহাবিশ্ব, চারমাত্রিক আর এর সব তথ্য ত্রিমাত্রিক কোনো স্থানে জমা রয়েছে। এটাকে বলা হয় সিনারিও ১। দুই, আমরা চারমাত্রিক মহাবিশ্বে আছি। সেটিই একটি বাউন্ডারি, যা পাঁচমাত্রিক মহাবিশ্বের সব তথ্য ধারণ করছে। দ্বিতীয়টি সিনারিও ২।

হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সঠিক কি না, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা কিন্তু কিছু তাত্ত্বিক প্রমাণ পেয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে কৃষ্ণগহ্বরের বক্রতা এতটাই বেশি, সেখানে তৃতীয় মাত্রা বলতে কিছুই নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপির পরিমাণ তার ঘটনাদিগন্তের পৃষ্ঠতলের সমানুপাতিক, আয়তনের নয়।

আরেকটি তাত্ত্বিক প্রমাণ হলো, Ads/CFT correspondence। এই তত্ত্বে চারমাত্রিক (তিনটি স্থানের, একটি কালের) গেজ তত্ত্বের সঙ্গে একটি পাঁচমাত্রিক (চারটি স্থানিক, একটি কালে) তত্ত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এই তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হলে হলোগ্রাফিক সিনারিও ২ অবশ্যই সম্ভব। আর একে সম্পূর্ণ গাণিতিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রমাণ করা গেলে, হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল শেষ পর্যন্ত গ-তত্ত্ব (Unified String Theory)-এর একটি মৌলিক নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

সেই সময় আর বেশি দূরে নয়, যখন সত্যিকার অর্থেই আমাদের অস্তিত্ব আর বাস্তবতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসতে হবে, নতুন করে সব সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়োজন পড়বে। কে আমরা? আমাদের অস্তিত্বের অর্থই বা কী? মহাবিশ্ব কি আসলে কোনো চারমাত্রিক বাউন্ডারি নাকি তিন মাত্রায় এনকোডেড তথ্যের প্রতিফলন? এসব প্রশ্ন যেন সেই মৌলিক এক প্রশ্নেরই ইঙ্গিত করে, কেন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে? কিন্তু অস্তিত্বের এই প্রশ্নের এখনো সংশয়ই একমাত্র উত্তর।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: বিবিসি ফোকাস