সুডোকু

আকরাম সাহেবকে কুইজ বিভাগের প্রধান হিসেবে বদলি করা হয়েছে শিক্ষা বিভাগ থেকে। দেশের জনপ্রিয় সংবাদপত্রে চাকরি করেন তিনি। সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কুইজ বিভাগে নানা ধরনের গল্প চালু আছে। বিশেষ করে প্রতিদিন যে সুডোকু ছাপা হয়, তা নিয়ে। অনেক গালগল্প, অনেক সত্যি-মিথ্যে। কিছু কিছু উত্তরদাতা নাকি একবারেই ছটফটে। সঠিক বা বেঠিক হোক, প্রথমবারেই পুরস্কার না পেলে দ্বিতীয়বার আর উত্তর পাঠায় না। আবার কেউ কেউ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস অপেক্ষা করে। কেউ কেউ আবার ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, বছরের পর উত্তর পাঠাচ্ছে, মাঝেমধ্যে হয়তো পুরস্কারও পাচ্ছে। আবার হাতে গুনে কয়েকজন আছে, যারা প্রতিটি কুইজের উত্তর পাঠায়, কিন্তু কোনো দিনই উত্তর সঠিক হয় না। এমনই এক পাঠক আছে, সুডোকু বিভাগ চালু হওয়ার পর টানা উত্তর পাঠিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এক দিনও উত্তর সঠিক হয়নি।

ব্যাপারটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে আকরাম সাহেবের। লোকটার প্রতিটি উত্তর তিনি চেক করলেন। কোনো দিনই মেলে না উত্তর। এর মানে হয়!

একদিন নিবিষ্ট মনে বসে ছিলেন আকরাম সাহেব। লোকটার ব্যাপারে বড্ড কৌতূহল হচ্ছে। তখন অফিস সহকারী একবোঝা কাগজ দিয়ে গেল। এর মধ্যে সেই লোকটার চিঠি আছে। আকরাম সাহেব নিশ্চিত, আজও ভুল উত্তর দিয়েছে লোকটা। ঠিক তখনই সহসম্পাদক আজীজ রহমানের মেইল। আগামী তিন দিনের সুডোকু আর উত্তর পাঠিয়েছে। সুডোকুর পাতাটা ছেলেটাই দেখে। কী ব্যাপার? আগাম তিন দিনের সুডোকু তো কখনো পাঠায় না! তাহলে আজ কেন?

আকরাম সাহেব ফোন করলেন আজীজ রহমানের ডেস্কে। বললেন, ‘একটু আসবে আমার ডেস্কে?’

‘জি, আকরাম ভাই, আসছি’, জবাব এল ফোনের ওপাশ থেকে।

আজীজ সাহেব এল। মনটা একটু খারাপ। ‘মন খারাপ কেন?’ আকরাম সাহেব বললেন।

‘মেয়েটার শরীর খারাপ, জ্বর আর সর্দিতে কাবু করে ফেলেছে।’

‌‘ওহ, তাই বুঝি ছুটিতে যেতে চাও,’ ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন আকরাম সাহেব।

‘জি, তিন দিনের। তাই আগামী তিন দিনের সুডোকু আর উত্তর পাঠিয়ে দিয়েছি। সম্পাদককে জানিয়েছি। তিনি ছুটি মঞ্জুর করেছেন।’ নিজেই একের পর এক কৈফিয়ত দিয়ে গেল আজীজ রহমান।

‘ঠিক আছে, যাও, কাজের চেয়ে মেয়ের সুস্থতা বড়’, বললেন আকরাম সাহেব।

ধৈর্যশীল লোকটার উত্তরের মেইলটা আগেই খুলে রেখেছিলেন। আজীজ সাহেবের মেইলে চোখ রেখে আবার চোখ ফেরালেন উত্তরদাতার চিঠিতে। আকরাম সাহেবের চোখ ছানাবড়া‍! লোকটার উত্তর ভুল নয়, সে এক দিন আগে আগামীকাল যে সুডোকুটা ছাপা হবে, সেটা আজই পাঠিয়ে দিয়েছে।

আজীজ সাহেব পুরোনো সুডোকুর বান্ডিলটা আনতে বললেন অফিস সহকারীকে। তারপর গত সাত দিনের লোকটার পাঠানো প্রতিটা উত্তরের মেইল চেক করলেন। লোকটা কখনো ভুল উত্তর পাঠায়নি। প্রতিদিন পাঠিয়েছে তারপরের দিন যে সুডোকু ছাপা হবে, তার উত্তর।

আকরাম সাহেবের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। লোকটা কি ম্যাজিক জানে, নাকি টাইম মেশিন আছে। এক দিন পরে কী সুডোকু ছাপা হবে, লোকটা জেনে ফেলছে যেভাবেই হোক।

কয়েক দিন ঘুমাতে পারেননি আকরাম সাহেব। আজীজ সাহেব ফিরলে বললেন, এ সপ্তাহের সুডোকু যেন আগেভাগে করে রাখে। সেগুলো যেন আকরাম সাহেবকে জমা দেয়।

আকরাম সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, প্রতিদিনই লোকটা এক দিন পরের সুডোকুর উত্তর পাঠাচ্ছে। তখন আকরাম সাহেবের মনে একটা অন্যায় ভাবনা আসে, ‌আজীজ নিজেই লোকটাকে ফোন করে পরদিনের সুডোকু জানিয়ে দেয় না তো!

ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য আকরাম সাহেব আজীজ সাহেবকে বললেন, আগামী কয়েক দিন যেন সুডোকু সে তৈরি না করে। আকরাম সাহেব নিজ হাতে সুডোকু তৈরি করতে চান।

সুডোকু তৈরির লোক বদলে গেল ঠিকই, ধৈর্যশীল লোকটার ধরন বদলাল না। সে প্রতিদিনই ই–মেইলে উত্তর পাঠায় পরদিন ছাপা হবে এমন সুডোকুর।

আকরাম সাহেব জানেন, টাইম ট্রাভেল নামে একটা বৈজ্ঞানিক টার্ম আছে পদার্থবিজ্ঞানে। কিন্তু সেটা কেমন ব্যাপার, এ নিয়ে আকরাম সাহেবের কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, তার বন্ধু আবদুল মজিদকে ফোন দিলেন। তিনি ফোনের ওপাশ থেকে আকরাম সাহেবকে চারমাত্রিক জগৎ, প্যারালাল ওয়ার্ল্ড, থিওরি অব রিলেটিভিটি, টাইম ডায়েলেশন ইত্যাদি ছাইপাঁশ বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আকরাম সাহেবের মাথায় কিছুই ঢুকল না। আবদুল মজিদ তখন এইচ জি ওয়েলেসের টাইম মেশিন বইটি পড়তে বললেন। ব্যাক টু দ্য ফিউচার নামের সিনেমাটিও দেখতে বললেন।

বন্ধুর পরামর্শমতো বইটা পড়লেন আর সিনেমাটা দেখলেন। তারপর কিছুটা মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। কিন্তু গুগল ঘেঁটে দেখলেন টাইম মেশিন তো তৈরি দূরের কথা, এটা যে তৈরি করা সম্ভব—এই কথাই বিশ্বাস করেন না পৃথিবীর বেশির ভাগ বিজ্ঞানী! তাহলে লোকটা কে?

লেখক: শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, আকিজ কলেজিয়েট স্কুল, যশোর