আবদুল আহাদ ও ভিনগ্রহের প্রাণী

আবদুল আহাদ সাহেবের মনটা আজ ভালো নেই। আজ তিনি তাঁর শিক্ষকজীবনে দ্বিতীয়বারের মতো স্কুল কামাই করেছেন। প্রথম কামাই যেদিন তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেদিন স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও তাঁর মনটা খুঁতখুঁত করছিল। সেদিন হেডমাস্টার এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে। আহাদ সাহেব তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আজ স্কুলে যেতে পারলাম না। কাল গিয়েই দরখাস্ত দেব।’

হেডস্যার রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি মানুষটা বাড়ির কথা ভাবেন না।’

আহাদ লজ্জা পেয়েছিলেন। তবু পরদিন ঠিক সময়ে স্কুলে গিয়েছিলেন। মানুষ মরণশীল—এই সত্য মেনে নিয়েছিলেন। তারপর থেকে সংসার নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়নি। কাজের লোক সব দেখাশোনা করে। তিনি শুধু নিয়মমতো স্কুলে যান এবং স্কুল থেকে ফিরে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে বা গবেষণা করে সময় কাটান।

আহাদ সাহেব আজ স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, ঠিক তখন পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই বৃষ্টি শুরু হলো। তিনি ভাবলেন, ছাতা মাথায় দিয়ে বেরোবেন। কিন্তু একটু পরেই শিলাবৃষ্টি শুরু হলো।

ভাবলেন, বৃষ্টিটা কমলে একবার স্কুলে গিয়ে হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। তিনি স্কুলের পোশাক পাল্টে ঘরের পোশাক পরলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল ঘরের কোণে, খরগোশের ওপর। খরগোশটার কিছু একটা হয়েছে। আগের মতো আর দৌড়ে বেড়ায় না, শুধু ঝিমোয়। আহাদ সাহেব ভাবলেন, আজই এর ঝিমোনোর কারণ বের করতে হবে এবং এটাকে সুস্থ করতে হবে।

তিনি অনেকক্ষণ খরগোশকে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু মনে হলো না চেনা কোনো রোগ হয়েছে খরগোশটার। শেষমেশ খরগোশটাকে ছেড়ে বই নিয়ে বসলেন। বই পড়ে পুরো দিনটাই কাটিয়ে দিলেন।

পরদিন সকালে আকাশ অনেক পরিষ্কার। স্কুলে গেলেন আহাদ সাহেব। কিছুক্ষণ পর হেডস্যার এলেন। আহাদ সাহেব হেডস্যারের রুমে ঢুকে সালাম দিলেন। তারপর দুটো দরখাস্ত এগিয়ে দিলেন। হেডস্যার বললেন, ‘কিসের দরখাস্ত?’

‘একটা গতকালের কামাইয়ের জন্য, আরেকটা আমার দুই দিন ছুটি চাই, সে জন্য।’

হেডস্যার খুব অবাক হলেন, ‘আপনার ছুটি চাই?’ আহাদ সাহেব মাথা নাড়ালেন।

তিনি দুই দিন ছুটি নিলেন শুধু খরগোশটির সেবা করার জন্য।

বাড়ি ফিরে অনেক ঘেঁটে দেখলেন কিন্তু খরগোশটার রোগ কী, তা ধরতে পারলেন না। পরদিন সন্ধ্যায় রোগটা ধরে ফেললেন। সম্পূর্ণ নতুন একটি রোগ। তিনি খরগোশকে নিজের বানানো ওষুধ খাইয়ে দিলেন। রাতে খেয়েদেয়ে তিনিও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমালেন।

ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলেন আহাদ সাহেব। অনেক লোক তাঁকে কংগ্রেচুলেশন জানাচ্ছে। কিন্তু মানুষগুলো অস্বাভাবিক—প্রত্যেকের একটা করে লেজ আছে। তারপর সেই অদ্ভুত প্রাণীরা স্পেসশিপে চড়িয়ে তাঁকে অন্য গ্রহে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু তিনি নিজের বাড়িতে নেই। তার চারপাশে অনেক মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল স্বপ্নে দেখা মানুষের মতো। সবারই একটা করে লেজ। আহাদ সাহেব ভাবলেন, স্বপ্নের ঘোরটা বোধ হয় এখনো কাটেনি।

তাঁর মনোভাব বুঝে ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘স্বপ্ন নয় আহাদ সাহেব, এখন আপনি পৃথিবীতে নেই, আমাদের গ্রহে। এর নাম এলি-১১।’

আহাদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আমাকে এখানে কে আনল?’

‘আমরাই এনেছি।’

‘কেন আমাকে এখানে আনা হয়েছে?’

সেই লোকটা জবাব দিল, ‘একটু বিশ্রাম নিন, তারপর আমরা সব বুঝিয়ে বলছি।’

আহাদ সাহেব বললেন, ‘আমি এখন সুস্থ আছি। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আপনারা বলুন।’

লোকটি বলল, ‘আমাদের গ্রহের প্রাণীরা হঠাৎ একটা অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সে জন্যই আপনাকে আনা।’

‘কিন্তু আপনাদের আমি সুস্থ করব কীভাবে?’ বললেন আহাদ সাহেব।

‘আপনি সে রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন।’

‘আমি আবিষ্কার করেছি! কখন, কীভাবে?’ অবাক হলেন আহাদ সাহেব।

লোকটি বলল, ‘আমরা এ রোগের ভাইরাস আপনার খরগোশের ওপর প্রয়োগ করেছিলাম। তাই সে অসুস্থ হয়েছিল। আমরা জানতাম, আপনি সারিয়ে তুলবেন। এখন ওষুধটা যদি আমাদের বানানো শেখান, তাহলে এ গ্রহের অনেক প্রাণীর জীবন বেঁচে যাবে।’

আহাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওই এ কথা!’

লোকটি বলল, ‘আপনি আমাদের শেষ ভরসা। আমাদের রক্ষা করুন।’

আহাদ সাহেব ভাবলেন, এত কষ্ট করে যখন নিয়ে এসেছে, তখন ফর্মুলাটা বলেই যাই। তিনি ওষুধ তৈরির ফর্মুলাটা শিখিয়ে দিয়ে এলেন তাদের।

সকালবেলা তাঁর ঘুম ভাঙল কাজের লোকের ডাকে। কাজের লোক বলল, ‘স্যার নয়টা বাজে, আজ এখনো শুয়ে আছেন? শরীর খারাপ নাকি?’

আহাদ সাহেব লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘না, আমি ঠিক আছি, তুমি যাও।’

কাজের লোক চলে গেল। তিনি বারান্দায় বের হলেন, দেখলেন খরগোশটি ঘাস খাচ্ছে। কী অসাধারণ দৃশ্য!