সেইটাই

কদিন ধরেই গ্রামের পাশের মাঠে আকাশে হঠাৎ করে ঘন মেঘ জমে যাচ্ছে। গ্রামের লোক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পায় না। মেঘ কিন্তু শুধু ওই অংশেই হয়, তাদের গ্রামের আকাশ পরিষ্কার। সবাই বলাবলি করে, পৃথিবীর অবস্থা টাইট। আবহাওয়া যে কী হয়েছে, কেউ বলতে পারে না। শীতের সময় শীত পড়ে না, বর্ষার সময় ঠিকমতো বৃষ্টি হয় না। চিন্তিত মুখে সবাই মাথা দোলায়। আসলে মেঘের আড়ালে কী হচ্ছে, তা গ্রামের মানুষ কদিন পরেই টের পায়।

সেইটাই, তার নাম। প্রথম কদিন কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। না তার ভাবসাব, না তার কথাবার্তা। তখনই মনা মুন্সী বলে, ‘এ তো মনে হয় উত্তর পাড়ার সেই কুদ্দুস পাগলা।’

কে যেন সায় দেয়, ‘ঠিকই বলেছেন মুন্সী চাচা, সেই বলে তো মনে হচ্ছে।’

বছর ছয় আগে পুব পাড়ায় এক পাগল ছিল, তার নাম কুদ্দুস। সে কোথা থেকে এসে যে পাড়ার বারোয়ারি পূজামণ্ডপের বারান্দায় থানা গেড়েছিল, কেউ তা বলতে পারে না। সারা দিন ঘুরে বেড়াত গ্রামময় আর রাতে ঘুমাত গিয়ে মণ্ডপের বারান্দায়। তার ছিল আবার মুখভর্তি দাড়ি। হঠাৎ করে একদিন সে গায়েব হয়ে যায়। প্রায় বছর পাঁচেক হবে সে লাপাত্তা। আজ যাকে দেখা যাচ্ছে, তার অবশ্য দাড়ি নেই। কিন্তু চেহারায় বেশ মিল। আর সে যখন আবোলতাবোল শব্দ উচ্চারণ করছিল, তখনই মনা মুন্সী তার সন্দেহের কথা বলে। ঠিক দুই দিন পরই অবশ্য সে সহজ বাংলায় উচ্চারণ করে, ‘আমার নাম সেইটাই।’

ফাজিল মোজাম বলে, ‘সে তো আমরাও বলছি, তোর নাম সেইটেই আছে। তুই হলি সেই কুদ্দুস পাগলা।’

কিন্তু সে বারবারই বলতে থাকে, ‘না না, আমার নাম সেইটাই।’

লোকজন হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, ‘আরে, তা তো আমরাও মানছি।’

সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান, বেশ বুঝতে পারে এই লোকগুলোর সঙ্গে বৃথা তর্ক করে কোনো লাভ নেই। মোটামুটি এখানে টিকতে হলে এদের কথাবার্তায় তাল দিয়ে যেতে হবে। তার এখন কুদ্দুস পাগলা হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। অথচ সে কিনা তার গ্রহের একজন নামকরা মহাকাশবিজ্ঞানী। গাধা মিউটিটার জন্য আজ তার এই দুর্দশা। মিউটি তার সঙ্গে স্কাউট শিপে আসা রোবটটা। এদের বুদ্ধিবৃত্তি একটু নিচু পর্যায়ের। ইচ্ছা করেই এই মানের রোবট এখানে দেওয়া হয়। এদের দিয়ে বিভিন্ন অচেনা গ্রহে করানো হয় নানা রকম বিপৎসংকুল কাজ। বুদ্ধিবৃত্তি উঁচু পর্যায়ের হলে আবার সমস্যা হয়। নানা রকম বিচার–বিবেচনা করে তারা কাজ করে। ফলে কিছু কাজ পণ্ড হয়। তাদের গ্রহে আবার রোবটদের আইন বেশ কড়া। মিউটির গ্রেডের পরের থেকে যেকোনো রোবটের ক্ষয়ক্ষতির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে রীতিমতো জবাবদিহি করতে হয়। তা ছাড়া সম্ভবত মিউটির সার্কিটে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। সতর্কতার আবার কয়েকটা স্তর আছে। তেমন কোনো ঘটনার ফলে প্রাথমিক স্তরের সতর্কতা নেওয়ার পর তার কাজ হচ্ছে পুরো বিষয়টা ভালো করে নিরীক্ষা করা। তারপর দরকার হলে দ্বিতীয় স্তরের সতর্কতা নেবে এবং ক্রমান্বয়ে চূড়ান্ত সতর্কতা। কিন্তু মিউটির লজিকে কিছু সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই। মাঝেমধ্যেই সে প্রাথমিক স্তর থেকে সরাসরি চূড়ান্ত সতর্কতায় চলে স্তরে স্তরে। যা–ই হোক, এবারও সে রকম একটা ঝামেলা হয়েছে। ঘটনাটা তিন দিন আগের।

তাদের মাদারশিপ এই সৌরমণ্ডলে ঢোকার পর তারা এক এক করে বিভিন্ন গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। তিন দিন আগে একটা স্কাউট শিপে চড়ে তারা নামে পৃথিবীতে। অনেক ডেটা নিয়ে সেটা পরীক্ষা করে জায়গা চিহ্নিত করে অবতরণের জন্য। জায়গাটা আসলে জঙ্গল। তবে পুরোপুরি জঙ্গল নয়, গ্রামের বাইরে একটা বুনো জায়গা। চারপাশে আম–কাঁঠাল আর নারকেলগাছের ছড়াছড়ি। সেসব গাছের নিচেটা নানা রকম ঝোপঝাড়ে ভরা। স্কাউট শিপটাকে তারা গাছপালার ফাঁকে এক টুকরা খালি জায়গাতেই নামিয়েছে। নামার পর ঘণ্টা দুয়েক তারা নিয়েছে নামার প্রস্তুতির জন্য। এর মধ্যেই দেখেছে বাইরে ঘোরাফেরা করছে ছুঁচালো মুখের চার পায়ে চলা কিছু জীব। সেগুলোর আবার লোমশ একটা করে লেজ আছে পেছন দিকে। সেইটাই ভেতর থেকে যতটা পারা যায় এদের পরীক্ষা করে দেখে। যদিও ভালো করে বুঝতে হলে তাকে বাইরে গিয়ে যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। অনুমান করছে, এদের বুদ্ধিবৃত্তি নিম্ন পর্যায়ের। তবুও কেন যেন সেইটাইয়ের মনে হলো এদের সঙ্গে একটা শ্রেণির বেশ মিল আছে। তাদের দেশের সরকারি দপ্তর পরিচলনার কাউন্সিলররা যেন এদের মতোই। যা–ই হোক, সেইটাই তার যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। মিউটি বের হয় তার পেছন পেছন। তারপর স্কাউট শিপের দরজার কাছে যে যোগাযোগযন্ত্রের অ্যানটেনা আছে, সেটাকে চালু করে দেয়, যাতে তারা দূরে চলে গেলেও স্কাউট শিপের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে আর তার মাধ্যমে মূল মাদারশিপের সঙ্গে।

সেইটাই সেই প্রাণীগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। ভয়ে প্রাণীগুলো ধীর পায়ে আরও ঘন জঙ্গলের দিকে সরে যেতে থাকে। বড় একটার সঙ্গে ছোট ছোট চারটে প্রাণী। এমন সময় একটা আওয়াজ কানে আসে সেইটাইয়ের। প্রাণীগুলোর মধ্যে হঠাৎ বেশ চাঞ্চল্য দেখা যায়। দ্রুত তারা পাশের এক ঝোপের আড়ালে চলে যায়। তারপর সেধিয়ে যায় গর্তের ভেতরে। আর তখনই সেইটাই পাঁচ-ছয়টা নতুন ধরনের প্রাণী হাজির হয় সেখানে। দুই পায়ে চলা প্রাণীগুলো একেবারে তাদের মতোই দেখতে। কিন্তু উচ্চতা তাদের দেশের পূর্ণাঙ্গদের অর্ধেক হবে। হই হই করতে করতে তারা এগিয়ে আসে সেই গর্তটার দিকে।

সেইটাই তাড়াতাড়ি একটা বড় গাছের আড়ালে লুকায়। পেছন ফিরে দেখে স্কাউট শিপ বা মিউটিকে দেখা যাচ্ছে কি না। নিশ্চিন্ত হয় ওরা বড় কয়েকটা গাছের আড়ালে পড়েছে বলে। সঙ্গে সঙ্গে মিউটিকে সংকেত পাঠায়, আপাতত শিপের দরজার কাছ থেকে না নড়ার জন্য। তার যন্ত্রের অ্যানটেনাটা দুপেয়ে প্রাণীগুলোর দিকে তাক করে এদের বুদ্ধিবৃত্তি নির্ণয় করার চেষ্টা করে সেইটাই। যদিও তাদের পরনে কাপড় আর হাতের ব্যবহার দেখে অনেকখানিই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সেই প্রাণীগুলো একটু পরই আবার হইচই করতে করতে ফিরে যায়। যে পথে এসেছিল সেই পথে।

সেইটাই তাড়াতাড়ি শিপে ফিরে যায়। তাকে আরও কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, এখন বোঝা যাচ্ছে এই গ্রহে মোটামুটি বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। তারা কতখানি বুদ্ধিমান বা বিজ্ঞানে তারা কতদূর এগিয়েছে, তা দেখতে হবে। এর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে এদের কাছাকাছি থাকা। সে জন্য সেইটাই একটা আলখাল্লামতো বানায়। নিজের স্পেস স্যুট পাল্টে আলখাল্লাটা পরে নেয়। সেটা দেখতে একটু আগে দেখা প্রাণীগুলোর কোমর থেকে ঝোলা কাপড়ের মতো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার সেই দুপেয়েদের আওয়াজ পাওয়া যায়। সেইটাই তাড়াতাড়ি নেমে আসে শিপের বাইরে। মিউটিকে বলে আসে, পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন সে শিপের দরজার কাছেই থাকে। মিউটি একটা সার্ভার এনে তার অ্যানটেনার মুখটাকে তাক করে দেয় সেইটাইর দিকে।

তারা সাধারণত যত দূরে যায়, পথে পথে ছোট কানেকটিভ অ্যানটেনা বসিয়ে যায়। সেগুলোর মাধ্যমে তাদের যোগাযোগযন্ত্রগুলো সার্ভারের সঙ্গে বা বলা চলে স্কাউট শিপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তবে এ রকম ছদ্মবেশ ধরতে না হলে মাঝখানের কানেকটিভ অ্যানটেনা লাগে না। কারণ, তখন হাতে থাকে শক্তিশালী যোগাযোগযন্ত্র। এখন সেইটাইয়ের কাছে যে যোগাযোগযন্ত্র আছে, তা খুবই ছোট। সেটা তার কানের পেছনে চামড়ার তলায় বসানো।

সেইটাই কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরই দেখে, এবার দুপায়ের প্রাণী আরও কয়েকটা বেড়েছে। তারা দৌড়ে গিয়ে সেই গর্তের মুখে শুকনা কতগুলো উদ্ভিদের টুকরা ঢুকিয়ে দেয়। আর সেইটাই আশ্চর্য হয়ে দেখে, তারা ছোট্ট একটা বাক্স বের করে তা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় উদ্ভিদগুলোতে। তার মানে এরা আগুনের ব্যবহার জানে এবং ভালোভাবেই জানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা ভরে গেল ধোঁয়ায়। সেইটাই বেশ বুঝতে পারছে, কী ঘটছে। স্কাউট শিপের রাডার জায়গাটা স্ক্যান করে তাকে জানিয়েছে, কী ঘটছে ওখানে। মাটির নিচে চারপেয়ে প্রাণীগুলো এতক্ষণ ঘাপটি মেরে থাকলেও ধোঁয়ার ধাক্কায় বের হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

হঠাৎ একটা বিপ বিপ আওয়াজ শুনে পেছন ফিরল সেইটাই। অবাক হয়ে দেখে, তাদের স্কাউট শিপটা তীব্র বেগে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিচে মিউটি বা সার্ভারের চিহ্ন নেই। তার মানে সেগুলো শিপের ভেতরে। সেই আওয়াজ শুনে দুপেয়ে প্রাণীগুলোও ফিরে তাকিয়েছিল। সম্ভবত শিপটা তাদের ঠিকমতো চোখে পড়েনি। তবে সেইটাইকে দেখতে পায় ভালোমতোই। ও কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফেরে সামনের দিকে। দুপেয়ে প্রাণীগুলো তখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।

মুহূর্তে সেইটাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, কী করতে হবে? সে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে। তাদের চোখের বিহ্বলতা তখনো কাটে না। দুজনকে দেখে পেছন ফিরে প্রাণপণে দৌড় দিতে। একটু একটু করে সে এগিয়ে যায় প্রাণীগুলোর দিকে। আবার একটু থেমে তাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে। এমনি করে যখন তাদের কাছাকাছি পৌঁছায়। দু-একটি দুপেয়ে পিছিয়ে যায়, তবে বাকিরা দাঁড়িয়ে থাকে সাহস করে। সেইটাই হাতের ইশারায় তাদের বোঝাতে চায় যে সে তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। সে তাদের বন্ধু হতে চায়।

দোপেয়েরা কী বুঝল কে জানে, ওদের চেহারা থেকে অস্বস্তিটা কেটে যায়। সেইটাই হয়তো কিছু বলত, কিন্তু ওর কথা তারা বুঝতে পারবে না। সে বরং তাদের পুরো কথা না বুঝলেও কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারছে। তার কানের যোগাযোগযন্ত্রটার আরেকটা কাজ হচ্ছে দ্রুত যেকোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার বোঝার মতো করে উপস্থাপন করা। আপাতত সেটা ডেটা সংগ্রহ করছে, তারপর কাজ শুরু করবে। এমনকি তখন সে যা বলতে চায়, সেটাকেও সেই ভাষায় কীভাবে বলতে হবে, তা বলে দেবে। এই কাজগুলো হবে একেবারে নিঃশব্দে। তার মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে। আপাতত ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া উপায় নেই। সেই চেষ্টাতেই ছিল সেইটাই। এর মধ্যে পালিয়ে যাওয়া দুপেয়েগুলো আবার ফিরে এসেছে। শুধু তা–ই না, তাদের পেছন পেছন এসে হাজির হয়েছে আগেরগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ আকৃতির দুই পায়ের প্রাণী।

একই রকম দেখতে, শুধু আকৃতিটা বড়। এবার সেইটাই বুঝতে পারে, এটাই এই প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ মাপ। তারপর তারা কাছে এসে তাকে কী কী সব জিজ্ঞেস করে? কিন্তু সেইটাই সেসবের কিছুই বুঝতে পারে না। তার যন্ত্র তখনো ডেটা সংগ্রহ করছে। তারপর বিশ্লেষণ করবে, তবে ভাষা বোঝা বা বলার পালা। সে এখনো দুদিনের মামলা। এই সময়ই মনা মুন্সী তার সন্দেহের কথা বলে।

সেইটাই তখন থেকে কুদ্দুস পাগলা হয়েই আছে। এই এলাকার বাইরে বেশি দূরেও যেতে পারছে না। স্কাউট শিপ ফিরে এসে তাকে এখানেই খুঁজবে। তার যোগাযোগযন্ত্র বেশি শক্তিশালী নয়। বেশি দূরে গেলে স্কাউট শিপ আবার তাকে খুঁজে পাবে না। তার ধারণা, স্কাউট শিপ ফিরে যাওয়ার পর সবকিছু বিশ্লেষণ করতে সময় লাগবে। যখন বুঝতে পারবে, সেইটাই পৃথিবীতে বেঁচে আছে, তখন ফিরতি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করবে। অতএব মাদারশিপ থেকে ফিরতি পথ ধরে এখানে পৌঁছাতে স্কাউট শিপের অনেক দিন লেগে যেতে পারে।

সেইটাইয়ের সকালে ঘুম ভাঙে পাখিদের কিচিরমিচিরে। তখনো সে ওঠে না। আসলে তার ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তিনটা–চারটা বাজে। রাতের বেলা সে তার ছোট যন্ত্রটা দিয়ে নানা রকম সিগন্যাল পাঠাতে থাকে, যদি খবর পেয়ে তার শিপ পৌঁছানোর আগেই অন্য আরেকটা স্কাউট শিপ চলে আসে। তবে সে সম্ভাবনা কম। স্কাউট শিপে যেহেতু অটো পাইলট দেওয়া আছে, সেটা তার শক্তির পুরোটা ব্যয় করবে মাদারশিপে পৌঁছানোর জন্য। মিউটি নিশ্চয়ই শিপে উঠেই ইমার্জেন্সি সুইচ টিপে দিয়েছে। তাহলেই শিপটা অতি জরুরি না হলে শুধু মাদারশিপকে তাদের ফিরে আসার খবর দিয়েই দ্রুত ছুটবে সেদিকে। মাদার শিপ খবর বিস্তারিত না পেলে নতুন স্কাউট শিপ পাঠাবে না।

তবু সেইটাই খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো আশা ছাড়তে পারছে না। প্রতিদিনই ঘুমাতে প্রায় ভোর হয়ে যায়। সারা রাত চলে তার অনুসন্ধান। যোগাযোগযন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল পাঠাতে থাকে একের পর এক। রাতে করতে হয়, কারণ, দিনের বেলা কোনো স্কাউট শিপ আসবে না স্বাভাবিক কারণেই। রাতে আবার বুঝেসুজে সিগন্যাল পাঠাতে হয়। কারণ, যদি কোনো শিপ এসেই পড়ে, তাহলে তাকে তার অবস্থানের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে মেসেজ পাঠাতে হবে। তা না হলে তাকে খুঁজে পাবে না। আর বিস্তারিত মেসেজ পাঠাতে খরচ হয়ে যায় প্রচুর এনার্জি। দিনে হলে দিব্যি সে এনার্জি পূরণ হয়ে যেত সোলার পাওয়ার থেকে। কিন্তু রাতে হলে এই সমস্যা। তারপরও তার সোলার প্যানেল এত সূক্ষ্ম যে বড় চাঁদ উঠলে তাই দিয়েই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। কিন্তু কপাল খারাপ, এখন চলছে অমাবস্যা।

সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলেও শুয়ে শুয়ে ঝিমায় সে। কিন্তু একটু পরে ছেলেমেয়েদের জ্বালাতনে উঠে পড়তে হয় তাকে। স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলেগুলো তাকে দেখলেই হইচই শুরু করে। সেইটাইয়ের দিকে ঢিল ছুড়ে মারে। সেদিন অল্পের জন্য তার কপাল ফাটেনি। এখনই যদি যদি ঘুম থেকে না ওঠে, বজ্জাত ছেলেগুলো ঢিল মেরেই যাবে।

সেইটাইয়ে দিনটা কাটে পাগলামি করে। মানে সে তো পাগলামি করে না, পাগলামির অভিনয় করতে হয়। এই তো সেদিন স্কুলের মাঠে এক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। কবে নাকি এ রকম অনুষ্ঠানে কুদ্দুস পগলা নেচেছিল। এখন মুশকিল হলো, তাকেও নাচতে হবে। লোকজন নাছোড়বান্দা—নাচতেই হবে পাগলার মতো নাচ। সেইটাই যত বলে সে নাচ কী জিনিস জানে না, ততই তারা আরও শক্ত করে ধরে। কাতুকুতু দেয়, লাঠি দিয়ে খোঁচা মারে। বাধ্য হয়ে তাকে উঠতে হয়। কিন্তু নাচ কী জিনিস, তা তো তার জানা নেই। একটু চুপচাপ থেকে লোকজনের মাথা থেকে ছড়ানো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে তার যোগাযোগ মডিউলটা দিয়ে। তা থেকে কিছুটা আন্দাজ করে, নাচটা কী ধরনের কাজ। তারপরই শুরু হয় তার উদ্ভট নৃত্য। লোকজন হেসে গড়িয়ে পড়ে। এ ওকে খোঁচা মেরে দেখায়, দেখ দেখ, কেমন নাচে। এদিকে নাচতে নাচতে সেইটাইয়ের জিব বের হয়ে আসে। সেদিন বহু কষ্টে তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছিল।

আরেক দিন গ্রামের মোড়লের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। কুদ্দুস পাগলাও আছে বিয়ের আসরে। সেইটাই অবশ্য আসতে চায়নি, এ রকম লোক জমায়েতে তাকে বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়। কিন্তু লোকজন কি আর ছাড়ে! গ্রামের একটা অনুষ্ঠান আর গ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাগল সেখানে আসবে না, তা তো হতে পারে না। সবাই তাকে ঠেলাঠেলি করে নিয়ে আসে মোড়লের বাড়িতে। অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে ওরা, এর নাম কুদ্দুস পাগলা। কিন্তু তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। লোকজন একটু দমে যায়। কিন্তু তাদের কিছু দেখিয়ে চমকে না দিতে পারলে তো গ্রামের ইজ্জত থাকে না। একজন বলে, আরে সেবার এক বিয়েতে কুদ্দুস পাগলা না বিশাল খাওয়া দিছিল! ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আয়োজন। ওর জন্য এক গামলা ভাত আর বিশাল এক বাটি মাংস এনে হাজির করে একজন। সেই সঙ্গে মুড়িঘন্ট আর দই। সেইটাই তো খাবারের পরিমাণ দেখে বার কয়েক হেঁচকি তুলে আমগাছতলায় শুয়ে পড়ে। তাই দেখে হো হো করে হেসে ওঠে লোকজন।

লোকজন ধরেই নিয়েছে, সেইটাই এখন উঠে খেতে বসবে। কিন্তু তাকে দীর্ঘক্ষণ উঠতে না দেখে লোকজনের আবার মাথায় বাড়ি! পাগলা তো তাদের একেবারে পথে বসিয়ে ছাড়বে। দুজন গাট্টাগোট্টা লোক গিয়ে সেইটাইকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে আসে। বসিয়ে দেওয়া হয় আলাদা একটা জায়গায়। সেইটাইয়ের মাথায় বাজ পড়ে! এমনিতেই তাদের গ্রহের খাওয়া একেবারে ওজন করা। কার কত ওজন, সেটার ওপর নির্ভর করে কাকে কতটুকু কী জিনিস খেতে হবে, তা ঠিক করাই থাকে। একটা প্যাকেট খাওয়ার সময় চলে আসে হিসাব করা জিনিস নিয়ে। শুধু আগে থেকে বলে দিতে হয়, কোনটা কী ধরনের স্বাদ হবে। স্বাদেরও কোড নম্বর আছে, শুধু খাদ্য অনুযায়ী স্বাদের কোড জানিয়ে দিলেই হলো। পৃথিবীতে তার খাওয়া, ওজন—সব গোল পাকিয়ে গেছে। খাদ্যের মধ্যে ফলটলগুলোই হজম হয় শুধু। এখানকার রান্না করা জিনিস খাওয়া তার জন্য সমস্যার। মাঝেমধ্যে তাকে খেতে হয়েছে। কিন্তু সুবিধা হয়নি, পেটে ঢুকে বড়ই গোলমাল শুরু করে দেয়। আর আজ যা তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে, তা খেলে তাকে আর কষ্ট করে স্কাউট শিপের সন্ধান করতে হবে না।

কিছুটা খাওয়ার পর তার অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। সে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। এমন সময় গাঁট্টাগোট্টাদের একজন এসে তার মাথায় টোকা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মগজে ঝনঝন করে এমন ঘূর্ণি ওঠে যে সেইটাইয়ের মনে হলো সে মহাশূন্যে হাইপার জাম্প দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ছিল, খুললেই যেন দেখতে পাবে অন্য এক জগৎ। কিন্তু চোখের পাতা ফাঁক করতেই দেখে ঠিক তার নাকের কাছে লোকটা ভাতের থালাটা ধরে আছে। বাধ্য হয়ে আরও খানিকটা তাকে খেতে হয়। তারপর আর সম্ভব হয় না। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। হঠাৎ সেইটাইয়ের মাথায় এক বুদ্ধি খেলে যায়। শীতপ্রধান অঞ্চলের জন্য তার শরীরে এমন একটা ডিভাইস সেট করা আছে, যা দিয়ে সময়মতো শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে ফেলা যায়। সে তাড়াতাড়ি সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরই তার গায়ের তাপ বেড়ে গেল অনেক। যে লোকটা কাছে ছিল, সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। অন্যরা কাছে এসে দেখে শরীরের তাপ অনেক। গায়ের কাছে গেলেই টের পাওয়া যাচ্ছে। ভয়ে সবাই সরে যায়। সেইটাইও ঘণ্টাখানেক সেখানে মড়ার মতো পড়ে থাকে। তারপর যখন দেখে তার দিকে কারও আর নজর নেই, তখন ধীরেসুস্থে উঠে অন্য দিকে চলে যায়। কিন্তু তার পেটে যা ঢুকেছিল, তাতেই তার সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দিতে সে রাত কেটে যায়। সেদিন আর স্কাউট শিপের ডাকে কোনো সাড়া দিতে পারে না।

সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তার দিন তিনেক পরে। গ্রামের এক মাথায় সেই জঙ্গল আর অন্য মাথায় একটা বিশাল বিল। সেই বিলে বছরের এই সময় মাছ ধরার একটা উত্সব হয়। গ্রামের সব লোক মিলে বিলটাকে সেঁচে ফেলে। তারপর শুরু হয় মাছ ধরা। প্রথমে বড় মাছ, তারপর কাদামাখা পানির মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে নানা ধরনের ছোট ছোট মাছ। এই সময় সবাই কাদা মেখে একেবারে ভূত হয়ে যায়। চারদিকে সাজসাজ রব পড়ে যায়। সামনের বুধবার সেই মাছ ধরার দিন। যে যার জাল, পোলো ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে।

সেইটাই একদিন বিকেলে স্কুলের মাঠের পাশে বসে বসে ফুটবল খেলা দেখছে, একটু দূরে কয়েকজন মিলে বসে আলাপ করছে সামনের মাছ ধরার উত্সব নিয়ে। সাধারণ লোকের ওই দূরত্বে তাদের আলাপ শোনার কথা নয়। কিন্তু সেইটাইয়ের যোগাযোগ মডিউলটা বিশেষভাবে তৈরি। সময়মতো কোনো একটা জায়গায় টার্গেট করলে এক শ গজ দূরের কথাও সে শুনতে পায়। একটু পরই তাদের আলাপ আগের বছরগুলোয় চলে যায়। একজন বলে ওঠে, ‘মনে আছে, একবার সেই বিলের মাঝখানে কুদ্দুস পাগলা মাছ ধরতে ধরতে লুঙ্গি হারিয়ে ফেলেছিল?’

অন্যরা সায় দেয়, তাদের মনে আছে। হাসিতে গড়িয়ে পড়ে সবাই। সেবার কুদ্দুস পাগলা মহা ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। কোমরসমান কাদাপানিতে কোথায় যে তার লুঙ্গি খুলে গিয়েছিল, তার খেয়ালও নেই। অনেক্ষণ আসলে সে বুঝতেই পারেনি। তারপর যখন খেয়াল হয়, তখন সে কোমরপানি ভেঙে হাঁটা ধরে বিলের অন্য পাড়ে। দুষ্টু ছেলেরা টের পেয়ে তার পিছু নেয়। সে পড়িমরি করে বিলের অন্য পাড়ে পৌঁছে নেমে পড়ে নদীতে। সাঁতরে গিয়ে ওঠে ওপারে। সারা দিন সেখানে কাটিয়ে ফেরে বিকেলে। পরনে তার সুপারিগাছের পাতার খোলস। বিল থেকে রাস্তাটা এসে হাটে উঠেছে। তার ও মূর্তি দেখে হাটের লোক ভেঙে পড়ল। হাসাহাসি আর খোঁচাখুঁচিতে তার পাতার খোলস খুলে পড়ার দশা। শেষে একজন মুরব্বি উদ্ধার করে। একটা পুরোনো লুঙ্গি দেয় কুদ্দুস পাগলাকে পরতে।

এই কথা শোনার পর থেকে সেইটাইয়ের মাথার চুল সব অ্যাটেনশন হয়ে আছে। কী করে এর থেকে ছাড়া পাবে, সেই চিন্তায় মাথা ঘেমে উঠেছে। তবে মনে হয় তার ভাগ্য ভালো। সেদিন ভোররাতে অন্তত সেইটাইয়ের তা–ই মনে হয়। ভোর হওয়ার একটু আগে হঠাৎ তার কাছে মেসেজ আসে। স্কাউট শিপ তাকে শনাক্ত করতে পেরেছে। দ্রুত সে তার অবস্থানের বিশদ বিবরণ দিয়ে মেসেজ পাঠায়। তারাও পাল্টা মেসেজ পাঠায়। কিন্তু ঠিক তখনই পূর্ব দিক ফরসা হয়ে ওঠে। সূর্যের আলো ফুটে উঠেছে। স্কাউট শিপ নামতে নামতে একেবারে পরিষ্কার হয়ে উঠবে চারদিক। স্কাউট শিপ ফিরে চলল। যাওয়ার সময় জানিয়ে গেল, পরদিন মাঝরাতেই তারা আসছে। কিন্তু সেইটাই আর জানাতে পারে না, আগামীকাল না, আজই তাদের নামা দরকার। কারণ, আগামীকালই সেই মাছ ধরার উত্সব।

কী করবে সেইটাই কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে মনে তার নিজের অবস্থাটা কল্পনা করে শিউরে ওঠে। একটা গ্রহের নামকরা মহাকাশবিজ্ঞানী কাপড়চোপড় ছাড়া কাদাপানির ভেতর দৌড়ে বেড়াচ্ছে! এর মধ্যেই বিলের ধারে লোকজন জমা শুরু হয়ে গেছে। কেউ জাল, কেউ পোলো নিয়ে হাজির হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলের দল শুধু হাতেই এসেছে। তাদের থেকে একটু দূরে সেইটাই দাঁড়িয়ে আছে। সে আসলে এখানে আসতেই চায়নি। কিন্তু কয়েকজন লোক গিয়ে একরকম জোর করে তাকে এখানে ধরে এনেছে। বারবার আপত্তির মুখে তাকে লোভ দেখিয়েছে, ‘চিন্তা করিস না পাগলা, তোরে চার সের ওজনের আস্ত একটা রুই মাছ খাওয়াব।’

এই কথা শুনে ঘাবড়ে যায় সেইটাই। আবার সেই পর্বত পরিমাণ খাওয়ার বিপদ। এমন সময় কে একজন খবর আনে মোড়ল সাহেবের পেটের অসুখ। তাই আজকের বদলে আগামীকাল মাছ ধরা হবে। বহুদিন সেইটাই এত খুশি হয়নি। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়।

সবাই চলে মোড়লকে দেখতে। সেইটাইও যায় পেছন পেছন। মোড়ল বসে ছিল বারান্দায়। কে একজন তাকে পড়া পানি খাওয়াচ্ছে। পানি খাওয়ার পর মোড়ল জানায়, ‘আজকের মধ্যেই সেরে যাবে, কাল মাছ ধরা হবে। তোমরা চিন্তা কোরো না।’

সেইটাই জানত, পানি পড়া দিয়ে কাজ হবে না। আসলে তার পেটের অসুখ হয়েছে খাওয়ার পানি থেকে। ছোট্ট এ গ্রামে একটামাত্র টিউবওয়েল। তাতেও প্রায়ই পানি ওঠে না। লোকজন বাধ্য হয়ে তখন পুকুরের পানি খায়, আর পেটের অসুখ বাধায়। যা–ই হোক এই কারণেই এ যাত্রা বোধ হয় সেইটাই বেঁচে গেল।

সেদিন ঠিক মাঝরাতে গ্রামের ঠিক পাশের মাঠটাতে এসে নামে স্কাউট শিপটা। মিউটি নেমে আসে কাঁচুমাচু মুখে। সেইটাই মিউটিকে বলে, তোমার শাস্তি হচ্ছে এখানে একটা কাজ করতে হবে।

গ্রামের একমাত্র টিউবওয়েলটা তুলে এমন জায়গায় বসাতে হবে যেখানে ভালো পানি পাওয়া যায়। শাস্তি বললেও মিউটির জন্য এটা কোনো কাজই নয়। সে প্রথমে জায়গাটা স্ক্যান করে বের করে, কোথায় পানির স্তর ভালো। তারপর আগের জায়গা থেকে তুলে টিউবওয়েলটাকে সেখানে পুঁতে দেয়। সবকিছু করতে তার সময় লাগল ১৫ মিনিট। তারপর সেইটাইকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে স্কাউট শিপ। ভিউ হোল দিয়ে সেইটাই আরেকবার জায়গাটাকে দেখে নেয়। ঘুমে ডুবে আছে গোটা গ্রাম। কাল সকালে উঠে দেখবে, হায় হায়, কুদ্দুস পাগলা তো আবার গায়েব। কেউ কেউ সেদিনের মাছ ধরার অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার কথা মনে করে আফসোস করবে। সবচেয়ে আশ্চর্য হবে, যখন দেখবে টিউবওয়েলটা আপনাআপনি আরেক জায়গায় চলে গেছে। আর তা দিয়ে হুশ হুশ করে ঠান্ডা পানি বের হচ্ছে।