বৈপরীত্য

আবোলতাবোল ভাবছি মহাকাশ নিয়ে, মহাবিশ্ব নিয়ে, গ্যালাক্সি নিয়ে। তখনই ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এল—‘স্যার কিছুক্ষণ আগে সৌরঝড় শুরু হয়েছে।’

আমি বিশেষ বিচলিত হলাম না। সৌরঝড়ে বেশি হলে হয়তো নেটওয়ার্ক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে আমি কী করব? যেখানে সারা বিশ্বে এখন আমার মতো হাতে গোনা কিছু হতভাগা বেঁচে আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হাস্যকর নয় কি?

ওয়াশরুমে গেলাম, কনকনে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলাম। নতুন পোশাক পরে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। নিজের বোকা-বোকা চেহারা দেখে নিজেই হাসলাম। কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে। আবারও হাসলাম। আশ্চর্য! আমার ডান দিকের একটা দাঁত ভাঙা, সে হিসাবে আয়নার আমির বাঁ দাঁত ভাঙা হওয়ার কথা, অথচ আয়নার আমার ছবি ঠিক ডান দাঁতেই ক্র্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ কচলে নিয়ে বাঁ হাত নাড়ালাম, আয়নার আমিও ঠিক বাঁ হাত নাড়ল!

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এটা স্বপ্ন না সত্যি! আমার প্রতিচ্ছবি মাথা নেড়ে বলল, ‘আমারও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।’ আমি বললাম, ‘এখানে আসলে হচ্ছেটা কী জানতে পারি?’

‘খুব বেশি কিছু নয়, সম্ভবত এ বিশ্বে আমিই প্রথম একটা ওয়ার্মহোল খুলতে সফল হয়েছি।’

আমি প্রতিবাদ করলাম—‘অসম্ভব! এটা নিয়ে আমি গবেষণা করছিলাম, আর একটা দিন হলে হয়ে যেত।’

‘তার মানে তুমি আমার এক দিন অতীতের প্যারালাল ফর্ম?’

আমি আর তর্ক করলাম না। বুঝলাম, আমার যেটুকু জ্ঞান, তার সবই ব্যাটা এক দিন আগে থেকে জেনে বসে আছে। বরং ওর জ্ঞান নিয়ে আমিই কিছু ফায়দা লুটতে পারি। আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য মুখিয়ে উঠলাম। বিজ্ঞানীসুলভ কৌতূহল ও লোভই এই জন্য দায়ী। আমি তার দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালাম।

এবার ও প্রথমে ধীরে ধীরে আমার জগতে তারপর আমি ওর জগতে আয়না ডিঙিয়ে প্রবেশ করলাম। কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল গায়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিচ্ছবির বাসা দেখলাম, হুবহু আমার বাসার মতো। বুকভরে নিশ্বাস টেনে নিয়ে ওদের আকাশের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম! কালপুরুষের হাতের ঢালটা বাঁ দিক থেকে ডানে এল কী করে! লুব্ধক তারার আলো অত ক্ষীণ কেন? আবার সেটা কালপুরুষের ডানে এল কোন হিসাবে?

যুক্তি দাঁড় করালাম, এ জগৎটা হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্য প্রান্তে। তাই তারাগুলো আমি বিপরীত দিক থেকে দেখছি বলেই হয়তো উল্টো দেখছি।

দশ মিনিট এদিক-ওদিক ঘোরার পর হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো। এত চঞ্চল প্রকৃতির শিশু আমি আগে দেখিনি, তবে আশ্চর্যরকমের সরল। যেমন, আমাকে শূন্যে ভাসতে দেখে সবাই কমবেশি বাঁকা চোখে তাকিয়েছে, কিন্তু এই মেয়েটির আগ্রহ কেবল আমার ভাসমান জুতার নিচ দিয়ে দৌড়ে খেলা করার। কোনো আশ্চর্যবোধ নেই তার, যেন হুট করে কোনো মানুষ উড়তে থাকা বেশ স্বাভাবিক বিষয়। নাম জিজ্ঞেস করতেই মিষ্টি করে হেসে বলল হেলেন। যুক্তি দাঁড় করালাম, এ জগৎটা হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্য প্রান্তে। তাই তারাগুলো আমি বিপরীত দিক থেকে দেখছি বলেই হয়তো উল্টো দেখছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন বাসার দিকে এগোচ্ছি, তখন দেখলাম সেই হেলেনকে তার মালিক মারতে মারতে বাসা থেকে বের করে আনছে। আমি তার চোখে সাহায্যের আকুতি দেখলাম। আমি সব মায়া ত্যাগ করে বিষণ্ন মনে আয়নার দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু মালিকের হাতে ছুরির ঝলকানি দেখে শান্ত থাকতে পারলাম না। যেভাবে হোক বাধা দিতে হবেই, হেলেনের ছোট মায়াভরা মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠল।

একটাই উপায় মালিককে স্পর্শ করতে হবে। আমি ম্যাটার আর সে অ্যান্টিম্যাটারে তৈরি। তাই স্পর্শ করলেই ধ্বংস হবে সে। ধ্বংস হব আমিও। কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। হেলেনকে বাঁচাতেই হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ১০ম শ্রেণি, বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম